সৌদিতে নারী কর্মীরা শুধু নির্যাতন নয়, মায়া-মমতাও পান

  • জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সৌদিতে নারী কর্মীরা শুধু নির্যাতন নয়, মায়া-মমতাও পান, ছবি: বার্তা২৪

সৌদিতে নারী কর্মীরা শুধু নির্যাতন নয়, মায়া-মমতাও পান, ছবি: বার্তা২৪

মক্কা মোকাররমা ( সৌদি আরব) থেকে: সৌদি আরব থেকে নারী কর্মীদের অনেকে যখন নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছেন, তখন বিপরীত স্রোতে দাঁড়ানো সাতক্ষীরার জোহরা খাতুন (৩৫)।

তার নিয়োগ কর্তা তাকে মক্কায় পাঠিয়েছিলো হজপালন করতে। মক্কার আজিজিয়া এলাকায় কেবল জোহরা একা নন, তার মতো বেশ কয়েকজন প্রবাসী গৃহকর্মীর দেখা মিললো। যারা বাংলাদেশ থেকে আসা নারী হাজীদের সঙ্গে একই সঙ্গে হোটেলে ছিলেন। হজও পালন করেছেন একইসঙ্গে।

বিজ্ঞাপন

তাদের স্বতঃস্ফূর্ততা আর হাসিখুশি মুখ দেখে হিসেবটা ঠিক মেলানো যাচ্ছিলো না। সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা নারীদের নির্যাতন আর বেশ কিছু ক্ষেত্রে পাশবিকতা, নিষ্ঠুরতা আর নির্মমতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যেন এই নারীরা।

তাদের সবাই বলছিলেন, তারা বেশ আছেন। ভালো যে আছেন, তার প্রমাণও মিললো। কিছুক্ষণ পর পরই অনেকের নিয়োগকর্তার স্ত্রী ফোনে কুশল জানতে চাচ্ছিলেন। জিজ্ঞেস করছিলেন, তারা কোনো অসুবিধা অনুভব করছে কি-না ইত্যাদি।

"আমার মালিক সত্যিই ভালো মানুষ। আমারে তার মেয়ের মতোই দেখে। সত্যিই ভালো মানুষ। হজের সমস্ত খরচ তো দিয়েছেই, আবার হাতে নগদ কিছু অর্থও দিয়েছে। আমার মায়ের গতবার যে কঠিন অসুখ হলো, তার চিকিৎসার জন্যেও দিয়েছে দুই লাখ টাকা।

আর দেশে ইসমাঈল নামের তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া ছেলের লেখাপড়ার যাবতীয় খরচ দেয় আমার নিয়োগকর্তা। বেশ বিনম্র কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই বলছিলেন সাতক্ষীরা, শ্যামনগর থানার নূরনগর গ্রামের আতিয়ার মহাজনের মেয়ে জোহরা খাতুন।

স্বামী পরিত্যক্ত জোহরা খাতুন দুই বছর সাত মাস ধরে সৌদি আরবে আছেন।

আরবি ভাষা রপ্ত করে ফেলেছেন বেশ। নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন এখানকার পরিবেশের সঙ্গে।

সাত বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৫ সালে নারীকর্মী পাঠানোর মধ্য দিয়ে সৌদি আরবে পূনরায় উন্মুক্ত হয় বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির বাজার।

সৌদি নিয়োগকারী সংস্থার নিজ খরচে (অবশ্য দালালরা গড়ে ৫০ হাজার টাকা নেন) ২০১৫ সাল থেকে ২ লাখেরও বেশি নারী শ্রমিক পাঠানো হয় সৌদি আরবে৷

পরিসংখ্যান বলছে, তাদের মধ্যে নির্যাতনসহ নানা করণে ৪০ হাজারের মতো নারী শ্রমিক সেখান থেকে ফেরত এসেছেন৷

সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীদের চাহিদার যোগান দিতে দেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিনাখরচে এক মাসের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া বিদেশে পাঠানোর আগে তাদের স্বল্পখরচে বাংলাদেশে সরকারি ২৬টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আরবি ভাষা, গৃহস্থলীর কাজকর্ম এবং সৌদি নিয়মকানুন শেখানো হয়।

সৌদিতে আসার পর একজন গৃহকর্মীকে যাচাই করার জন্য নিয়োগকর্তা তিন মাস সময় পান৷ এর মধ্যে ওই গৃহকর্মী যদি অদক্ষ বলে বিবেচিত হন, তাহলে তারা রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে গৃহকর্মীকে ফেরত পাঠান দেন। গৃহকর্মীর অযোগ্যতার কারণ জানিয়ে দূতাবাস বরাবর নোটিশও পাঠানো হয়৷ এরপর নিয়োগকারী অফিস থেকে গৃহকর্মীদের নিজ নিজ দূতাবাসে হস্তান্তর করা হয়৷ তারপর দূতাবাসের রিয়াদ এবং জেদ্দায় অবস্থিত দু'টি সেফ হোমে নিয়ে তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়৷

সূত্র মতে, কাজে অস্বীকৃতি, বাংলাদেশে যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব, ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা এবং সৌদি আরবের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা কর্মীর অদক্ষতা বলে বিবেচিত হয়। এর বাইরে মানসিক ও শারিরীক নির্যাতনের কারণে অনেক কর্মী নিজেই কাজ ছেড়ে পালিয়ে আসেন।

সৌদি আরবের শ্রম বাজারে এই মুহূর্তে প্রায় ১৩ লাখ বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় কর্মরত রয়েছেন। দেশে ফিরে যাওয়া নারীদের একটি বড় অংশই বলছেন, নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন তারা।

নারী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ এনে ২০১১ সালে ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কাসহ অনেক দেশ সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দেয়৷ ২০০৮ সালে বাংলাদেশের জন্য শ্রমবাজারের দুয়ার বন্ধ করে সৌদি আরব।

সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানোর শর্তে ২০১৫ সালে খুলে দেওয়া হয় বাংলাদেশের শ্রম বাজার।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় অবশ্য বলছে, দেশটিতে কর্মরত নারী শ্রমিকদের ২০ ভাগ সমস্যায় থাকলেও অবশিষ্টটরা নিরাপদেই আছেন।

এই ২০ ভাগের ভালো না থাকার কারণ হিসেবে ২০১৫ সালে শ্রমিক পাঠানোর চুক্তিতে নানা ধরনের দুর্বলতার কথা বলছেন অভিবাসীদের কল্যাণে কাজ করেন এমন একটি সংস্থা।

তাদের মতে, চুক্তি অনুযায়ী চাকরির প্রথম তিন মাস পর্যন্ত শ্রমিকের দায়দায়িত্ব রিক্রুটিং এজেন্সিকে বহন করতে হয়। তারপর গৃহকর্মী শ্রমিকের দায়দায়িত্ব আর রিক্রুটিং এজেন্সির থাকে না। শর্তে নিয়োগকারী রাষ্ট্রেরও কোনো দায় নেই। যার খেসারত দিতে হচ্ছে অসহায় নারী শ্রমিকদেরই।

কেবল জোহরা একা নন, তার মতো মমতাজ, রেহানা, মরিয়ম ও শাহিদার মতো জেদ্দায় খাদ্দামা ভিসায় আসা নারী কর্মীরা জানান, তারা ভালো আছেন, বেশ আছেন।

তাহলে আপনার মতো নারীরাই বা কেন টিকতে না পেরে দেশে ফিরে যাচ্ছে?

জবাবে জোহরা জানান, আসলে যে নির্যাতন হয় না তা নয়। কিন্তু সকল সৌদিই এক রকম নয়। তাদের মধ্যে অনেকে আছেন, যারা আমাদের মায়া-মমতায় আপন করে নিয়েছেন।

আমরাও কাজে-কর্মে তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করেছি। নইলে আমাদের টিকে থাকা তো সম্ভব হতো না।

এখানে এলে এখানকার রীতিনীতি জানতে হবে। এখানকার খাবার ও পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে হবে।

এটা যারা পারেন না, তাদের এখানে টিকে থাকার প্রশ্নই ওঠে না।

জোহরা জানান, আমরা তিন চতুর্থাংশ নারী যে এখানে ভালো আছি। তা তো আপনারা লেখেন না। কিন্তু যারা ফিরে যায়, তাদের কথাই কেবল তুলে ধরায় আমাদের স্বজনরাও উদ্বিগ্ন থাকেন। আমরা আশ্বস্ত করি, না; চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমরা খেয়ে-পড়ে ভালো আছি।

আচ্ছা! নিজের স্বামীর পরিবারেও তো অনেকে টিকতে পারে না! আর এটা তো বিদেশ। ভিন্ন পরিবেশ। এখানে টিকে থাকতে হলে এখানকার রীতিনীতি, ভাষাজ্ঞান আর আদব-কায়দাটাও জানা জরুরি- যোগ করেন জোহরা।