হাওরের হাতছানি-২
শহুরের গ্রাম দরশন
দুপুরের ভাতঘুম থেকে উঠে আমরা বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি। রিসোর্টকর্মীরা রুমে রুমে নক করে খবর দিল, নিচে টমটম তৈরি। আমাদের কক্ষগুলো দোতলায়। বড় জানালা দিয়ে সামনের রাস্তার দুয়েকটি ইজিবাইক চলাচল অদূরের ফাঁকা মাঠ, দূরগ্রামের সবুজ দেখা যায়। অন্যদিকে গ্রাম্য টিনের ঘরবাড়ি। নিচে নেমে দেখি, রিসোর্টের গেটমুখে ইজিবাইক দাঁড়ানো, টমটমের দেখা নেই। প্রসঙ্গ তুলতেই বলা হলো, ইজিবাইককেই অনেকে টমটম বলে। ভাবলাম, ঘোড়ার গাড়ির টমটম হলেই বোধ হয় গ্রামপর্যটনের সঙ্গে মানানসই হতো। তবে আজ ঘোড়াও যে বাংলার গ্রামগুলো থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে!
হাওর ও গ্রামপর্যটন বিস্তারে জালালপুর ইকো রিসোর্ট
পরিকল্পনামতো, বৃন্দভ্রমণের পুরুষদল ইজিবাইকে উঠে বসল, মেয়েরা হেঁটে হেঁটে পাড়া বেড়াতে যাবে—যার পোশাকি নাম ভিলেজ ওয়াকিং ট্যুর। ইজিবাইক আমাদের নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম আর ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে যাত্রা শুরু করল। আমাদের বলতে পুরুষদলে আমি, কবি কামরুল হাসান ও ভ্রমণবিদ সৈয়দ জাফর। ফাঁকা মাঠের মধ্যে ইজিবাইক থামিয়ে অদূরের সবুজ গ্রামকে পটভূমি করে আমরা কিছু ছবি তুললাম। পথিমধ্যে একটি গ্রাম্যবাজার। দোকানের সাইনবোর্ড দেখে বুঝলাম, এর নাম দশপাখি বাজার। বৈকালিক হাটে হাটুরের সংখ্যা খুব বেশি না। তরতাজা শাক সবজি, ডিম, দুধ, মাছ নিয়ে পাংশুমুখে বসে আছে অজস্র বিক্রেতা। ক্রেতার সংখ্যা কম হওয়ায় তাদের এই বিরসবদন। চলতিপথে ইজিবাইকের মধ্য নানা আলাপ হচ্ছে। আলোচনার বিষয় পুরো এলাকাটি হাওর অববাহিকা বলে এখানে মেঘবৃষ্টির আশীর্বাদ সবসময়। চারদিকে ‘ভেজিটেশন’ বা সবুজপ্রকৃতির মায়াময় রূপ অপরূপ।
আমাদের আজকের গাইড রিসোর্টের ম্যানেজার জিহান। যাওয়ার পথে সে গ্রামগুলোর নাম বলে যাচ্ছিল। পর্যটকদলে সে আজ অফিসিয়াল ফটোগ্রাফার। কিছুক্ষণের মধ্যে অদূরে দৃষ্টগোচর হলো একটি নতুন সেতু। আশপাশের সবচেয়ে পরিচিত জায়গা পাইকান বাজার। লোকেদের কাছে পাইকানবাজার শেখ রাসেল সেতু হিসেবে জায়গাটির পরিচয়। নিচ দিয়ে স্রোতহীন মজা নদী। গুগলে নাম খুজে পেলাম না। লোকজন বলল, এটা আড়িয়াল খাঁ নদী। এতে পানির চেয়ে কচুরিপানা বেশি। বুঝলাম স্রোতের শক্তি নেই বলে কচুরিপানার এতটা দাপট। যা উল্লেখের তা হচ্ছে, সবুজ প্রকৃতির মধ্যে কংক্রিটের ব্রিজে লাল রঙ করে দেশের পতাকার থিমটি উদ্ভাসিত করা হয়েছে। নদীর নাম গুগলে নেই, স্থানীয়রা বলল, আড়িয়াল খাঁ। সেতুটির অন্য বৈশিষ্ট্য এটি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী আর নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলাকে যুক্ত করেছে। দু’জেলার সীমান্তসেতু। জেলাসীমান্ত দেখার জন্য এখানে সেতুটিতে সকাল বিকাল ভিড় করে থাকে মানুষ। মনে পড়ল আমার সুইজারল্যান্ডের সীমান্তশহর বাজেল (Basel) ভ্রমণের কথা। বাজেলে রাইন নদী ঘেঁষা একটি জায়গা তিনদেশের সীমান্তবিন্দু। বর্ডার ট্রায়াঙ্গেল বলা হয় থাকে। ত্রিকোণাকৃতি স্তম্ভের তিনদিকে সুইজারল্যান্ড, জার্মানি ও ফ্রান্সের নাম। পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলেছে সুইজারল্যান্ড।
সেতু পেরিয়ে মনোহরদী তথা নরসিংদী জেলার পাইকান বাজার এলাকায় পৌঁছালাম। মানুষের পর্যটন আগ্রহকে আমলে নিয়ে বছরখানেক আগে এখানে গড়ে তোলা হয়েছে ‘জলতরঙ্গ’ নামের পার্ক। মজা নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা চরের ওপর রেস্টুরেন্ট, গোলাকৃতি একাধিক ওয়াচটাওয়ার, নৌকা ঘাট, ফুলবাগান, বিচ চেয়ার নিয়ে জলতরঙ্গ। ছোট্ট কাঠের সেতু পেরিয়ে ২৫ টাকার টিকেট কেটে ঢুকতে হয়। চেয়ার বা ওয়াচ টাওয়ারে বসে শেখ রাসেল সেতুটি নব্বুই ডিগ্রি কৌণিকে চমৎকার দেখা যায়। সবুজ পটভূমিতে লাল সবুজ রঙে সাজানোয়, সেতুর সঙ্গে পার্কের রঙসাজুয্যও নজর কাড়ে। আমাদের এর কিছুই জানা ছিল না। এসেছি জালালপুর ইকো রিসোর্টের গ্রাম পর্যটন ট্যুরের অংশ হিসাবে। রিসোর্টের প্যাকেজের মধ্যে সেতু-পার্ক অন্তর্ভুক্ত থাকায় হাওর দর্শনার্থীরা রিসোর্টের অতিথি হলেও গ্রামস্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে।
আমরা সেতুতে ছবি তুলি। পার্কে ঢুকে কিছু খাই। ওয়াচ টাওয়ার ও বিচ চেয়ারে বসে নদী দেখি। ফেরার পথে প্রবেশমুখের গ্রাম্য চা দোকানে বসে দুধ চা খাওয়ার ছুতোয় অলস আড্ডায় মেতে থাকা গ্রাম্যবুড়োদের সঙ্গে গল্প করি। ইজিচালক সোহেল তাড়া দেয়, দূরের আকাশে মেঘ জমছে, যে কোনো সময় ঝুপ করে বৃষ্টি নামতে পারে।
ফিরতি পথে একদল হাঁসের ছন্দময় চলা আমাদের চোখে প্রশান্তি ঢেলে দেয়। দশপাখি গ্রামের শেষপ্রান্তের একটি গ্রাম্য পুকুরপাড়ে এই খামার। দেখি বাম দিকের ফাঁকা মাঠ থেকে উদোম গায়ের দুই হাঁসরাখাল একপাল হাঁস তাড়িয়ে রাস্তার দিকে আসছে। হাঁসদলের চলার ছন্দ তৈরি করেছে বিরল এক দৃশ্য। গাড়ি থেকে নেমে উল্লসিত হয়ে আগুয়ান হাঁসের দলটির ভিডিও করতে থাকি। স্থানীয় গ্রাম্য মানুষের কাছে এই দৃশ্য আটপৌরে... তাদের কাছে আমাদের উল্লাসমুখরতা নতুন। আমরা যখন হাঁসদলের চলাছন্দ দেখি, তারা তখন অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকেন আমাদের। মাঠ থেকে রাস্তায় উঠে হাঁসদল সামনে দিয়ে ডান দিকের পুকুরে নেমে ডুবসাঁতার খেলায় মেতে উঠল। দুই উদোম গা’কে জিজ্ঞেস করতেই জানাল, হাঁসের সংখ্যা চারশো। মাঠ থেকে রাতের খাওয়ার খেয়ে তাদের ফিরিয়ে আনা হলো। গোসল সেরে এখনই উঠে যাবে পুকুরপারের খামারঘরে।
পর্যটকদলের কামরুল হাসান আপাদমস্তক কবি ও ভ্রমণলেখক। বহুদর্শী হলেও যা কিছু দেখেন, সদ্যভূমিষ্ঠের মতো বিস্ময়াভিভূত হয়ে দেখেন, নোট নেন। হাঁসবৃত্তান্তের নোট নেওয়া শেষ হলে আবার ইজিবাইকে চাপি। রিসোর্টগ্রাম জালালপুর এলে ইজিবাইক থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে রিসোর্টে পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ইজিচালক সোহেল ও গাইড জিহানকে বিদায় দিই। সামনে জালালপুর হাইস্কুল। বৈকালিক খেলা শেষ করে ছেলেরা ঘরে ফিরতে উদ্যত। জনে জনে সাইকেল। সৈয়দ জাফর একজনের হাত থেকে সাইকেল চেয়ে নিয়ে মাঠের মধ্যে চালাতে শুরু করলেন। দেখাদেখি আমিও। চার যুগ পরে কৈশোরে ফিরে যাওয়া। ভালোই লাগল। কবি কামরুল হাসান বসে থাকবেন কেন! তিনি একটিতে চাপলেন। তিন বুড়োর সাইকেলকাণ্ডে উপস্থিত স্কুলবালকরা খুব মজা পেল। একজন জিজ্ঞেস করল, আঙ্কেলরা বুঝি রিসোর্টে আছেন। তাদের আলাপচারিতা ও শরীরী ভাষা আমাদের বোঝাল, রিসোর্টের সুবাদে হালে তারা জালালপুরে নিত্যনতুন মানুষ দেখছে। তারা একেকজন একেকরকম। মানুষের সঙ্গে আলাপ করে তাদের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হচ্ছে। রিসোর্টকে তারা গ্রামের আশীর্বাদ হিসেবে নিয়েছে।
আমরা এখানকার দু’দিনের যোগী। হেঁটে গন্তব্যের পথ ধরেছি। দিগন্তরেখায় তখন সান্ধ্য রক্তিমাভা। গ্রামের মিনার থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আজান।