‘এ্যালা হামার কাছে কায়ো ভোট চায় না’
প্রতীক বরাদ্দের ১২ দিন অতিবাহিত হলে এখনো কোন প্রার্থী বা সমর্থক ভোট চাইতে যাননি ভোটারদের বাড়িতে। আগের মতো প্রার্থীদের নেই দৌড়ঝাঁপও। যেন ঢিলেঢালা প্রচারণাতেই চলছে ভোট উৎসব।
এ অবস্থা দেখে ক্ষুব্ধ রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের পলিপাড়া গ্রামের মোর্শেদা বেগম। তার বয়স প্রায় পয়তাল্লিশ। করেন কৃষি কাজ।
আলুর বস্তা বাঁধতে বাঁধতে মোর্শেদা বেগম বলেন, ‘আগের মত এ্যালা (এখন) আর ভোটত মজা নাই বাহে। মার্কা ব্যারাইলে বাড়ি বাড়ি মানুষ আসি ভোট চাছিল। দোয়া করার জনতে মাথাত হাত বোলে নিছিল। আর এ্যালা হামার (আমার) কাছে কায়ো (কেউ) ভোট চায় না। ডিজিট্যাল হইচে তো মাইকোত ভোট চাইলেই হয়।’
পালিপাড়া গ্রামের আরেক ভোটার ইমাম আলী। তিনি বলেন, ‘ভোট নাগলে দিন রাইত নেতারা বাড়িত আসছিল। হ্যান্ডসেপ করি বুকোত টানি নিয়্যা ভোটের কথা কছিল। এ্যালা নেতাক ঘরে খুব দেখা যাওছে না। হাট বাজার আর বন্দোরোত মিটিং মিছিল করি ওমরা ভোট খ্যালেচোল। আর যামাকগুল্যাক মার্কা দিয়্যা মাটোত ছাড়ি দেছে, তামারগুল্যারো দেখা নাই।’
বদরগঞ্জ নাগেরহাট বাজারে কথা হয় আব্দুল সালাম বিশ্বাসের সঙ্গে। পেশায় তিনি সাংবাদিক। বার্তা২৪কে তিনি বলেন, ‘ভোট নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন আগ্রহ নেই। কোথাও পথসভা বা গণসংযোগ হলে মানুষ আর ছুটে যায় না। পনের বিশ বছর আগের ভোটের মত এখন সেই উৎসব নেই। তবে হাট বাজারে মানুষ সময় পেলেই ভোটের কথাজুড়ে দেয়।’
পীরগাছা উপজেলার তাম্বুলপুর ইউনিয়নের বগুড়াপাড়া গ্রামের সাজেদা বেগম। ভোট নিয়ে তেমন কোন ভাবনা নেই তার। পরিবারের কর্তার ইচ্ছাতেই বিগত সময়ের মতো এবারও ভোট দেবেন তিনি। সাজেদা বলেন, ‘হামাগেরে এখনো ডিসিশন হয়নি। যাই এলাকার উন্নতি করবি, হামরা তাকি ভোট দিমু।’
রংপুর সদর উপজেলার হরিদেবপুর ইউনিয়নের পানবাজার গ্রামে কৃষ্ণ রায় ও হিমাদ্রির সঙ্গে কথা হয়। তারা দু’জনই বাঁশ-বেঁত শিল্পের কারিগর। হিমাদ্রি বলেন, ‘ভোট নিয়্যা কি ভাবমো। মদ্দে (স্বামী) যাক ভোট দেব্যার কইবে, তাকে ভোট দেমো।’
রংপুর মহানগরীর শাপলা চত্ত্বর এলাকার এম এ মজিদ। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বাসা থেকে তার বাসার দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। এতো কাছাকাছি থেকে ভোটের উত্তাপ বা উৎসব কোনটাই অনুভব করতে পারছে না তিনি। প্রায় পঞ্চান্ন বছর বয়সের এ ভোটার বলেন, ‘এরশাদ সাহেবকে ছাড়া মানুষ কাকে ভোট দেবে। এখানো তো আর কোন ভালো হেভিওয়েট প্রার্থী নেই। কিন্তু এরশাদ সাহেবসহ অন্যদের প্রচার প্রচারণা দেখে তো মনে হচ্ছে ভোটের প্রয়োজন নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু মাইকিং আর পোস্টারিং করে ভোট উৎসব হয় না। বাড়ি বাড়ি আগে যেমন নারী-পুরুষরা দল বেধে ভোট চাইতে আসত, এবার সেই দৃশ্য এখনো চোখে পড়েনি। এও অবাক হওয়ার মত ঘটনা। ২০১৪ সালের নির্বাচন আর এ নির্বাচন তো এক নয়।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি মানুষের আস্থা কমে আসছে। এ কারণে ভোট উৎসবে দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থক ছাড়া সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ খুবই কম। এখন হাতের মুঠোয় মানুষ ভোটের সব খবর পাচ্ছে। প্রার্থীরাও ফেসবুক, ইউটিউব, লোকাল ডিস চ্যানেলে ভোট চাইছে। ডিজিটাল যুগে এমন প্রচারণার কারণে হয়তো আগের মতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাওয়ার পুরনো সেই স্মৃতিগুলো চোখের সামনে কম আসছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে ভোটের উত্তাপ যে একেবারেই নেই, তা নয়। উৎসবের রেশটা কোথাও বেশি কোথাও কম, মানুষ তা অনুভব করছে।’
এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনে রংপুর জেলার সংসদীয় ছয়টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৩ জন প্রার্থী। এ জেলাতে ভোটার সংখ্যা ১৯ লাখ ৪৯ হাজার ৬৫৩ জন। এরমধ্যে নারী ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৪৫৩ এবং ৯ লাখ ৬৫ হাজার ২০০ জন পুরুষ ভোটার।
রংপুর জেলায় ৮৪৪টি ভোট কেন্দ্র। এরমধ্যে রংপুরের একটি আসনের ১৭৫টি কেন্দ্রে ইভিএম-এ ভোট প্রদান করবে ভোটাররা।