৩০ বছর পর নৌকায় ভোট দেবে গাংনীর আ.লীগ!
সত্তরের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে (এমএনএ) নির্বাচিত হয়েছিলেন মেহেরপুরের গাংনীর নুরুল হক। ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে মেহেরপুর-২ (গাংনী) আসনের জন্ম হলে তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয় এবং পরবর্তী নির্বাচনে ১৯৮৬ সালেও এমপি নির্বাচিত হন। এরপর দু’বার নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। ১৯৮৬ সালের পর থেকে দীর্ঘ এই ৩০ বছরের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানা কারণে নেতাকর্মীরা বিনা বাধায় সকলে মিলে এক সঙ্গে নৌকায় ভোট দিতে পারেননি।
তবে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সেই চিত্র পাল্টে গেছে। দুই গ্রুপের স্থানীয় হেভিওয়েট প্রার্থীকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহিদুজ্জামান খোকনকে। তাকে ঘিরেই দলের উভয় গ্রুপের নেতাকর্মীরা এখন ঐক্যবদ্ধ। মনোনয়ন বঞ্চিত কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না।
ফলে এবারের নির্বাচনে প্রাণ খুলে নৌকায় ভোট দিতে প্রস্তুত গাংনীর আওয়ামী লীগ। এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন উপজেলা থেকে শুরু করে গ্রাম ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা। জয়ের ব্যাপারেও তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।
দলীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের এবারের প্রার্থী সাহিদুজ্জামান খোকন দীর্ঘদিন ধরে উপজেলা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি দলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। এক সময়ের তুখোড় ছাত্র নেতা। তিনি এমএ খালেক গ্রুপে থাকলেও গ্রুপিং রাজনীতিতে খুব বেশি সক্রিয় ছিলেন না। সব পক্ষের লোকজনের সঙ্গেই তার ভালো সম্পর্ক ছিল। তাই এবারে তিনি মনোনয়ন পাওয়ায় উভয় গ্রুপের লোকজন ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংসদ মকবুল হোসেন মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। শেষ পর্যন্ত তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নৌকার পক্ষেই কাজ করছেন। এমএ খালেক ও মকবুল হোসেন ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় মাঠ পর্যায়েও পড়েছে ইতিবাচক প্রভাব। তৃণমূলের গ্রুপিংও নিরসন হয়েছে। কোনো গ্রুপ কিংবা পক্ষ নয়, সবাই এখন নৌকার পক্ষেই প্রচারণা ও ভোট চাইছেন। এছাড়াও ক্ষমতায় না আসলে অস্তিত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে আশঙ্কায় নৌকার প্রতীককে বিজয়ী করতে মরিয়া আওয়ামী লীগ।
এ প্রসঙ্গে সাংসদ মকবুল হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় থাকার জন্য যা যা করণীয় তাই করছি। আমাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। তারপরেও আমি নৌকা প্রতীক বিজয়ী করার সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।’
মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ খালেক বলেন, ‘শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের হাল ধরার পর এখানে নৌকা জেতেনি। তাই এবারে আমরা বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনাকে এ আসনটি উপহার দেব।’
জানা গেছে, দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। এ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জিল্লুর রহমান ১৭ হাজার ৯৬৫ ভোট পেয়ে এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ (মিজান) প্রার্থী জালাল উদ্দিন ৭ হাজার ৪৪০ ভোট পেয়ে তৃতীয় আর আওয়ামী লীগ (মালেক) প্রার্থী ইনামুল হক ৫ হাজার ৩০৯ ভোট পেয়ে চতুর্থ হন। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ দুই প্রার্থীকে ভোট দেয়।
১৯৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। ফ্রিডম পার্টি এবং আ.স.ম রবের নেতৃত্বে ৭৬ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নেয়। ভোট ডাকাতির মধ্য দিয়ে ফ্রিডম পার্টির বজদুল হুদা (বঙ্গবন্ধু হত্যায় ফাঁসি কার্যকর) এ আসনটিতে জয়লাভ করে। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি।
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ২৭ জানুয়ারি। এ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী আব্দুল গনি ২৯ হাজার ৬৪৯ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের হিসাব উদ্দিন ২৮ হাজার ৪৭৪ ভোট পান। এ নির্বাচনেও জয়ের মুখ দেখেনি আওয়ামী লীগ।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মকবুল হোসেন ৪৫ হাজার ৮২০ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী আব্দুল গনির প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩৩ হাজার ৮৬১টি। আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসাব উদ্দিন মাত্র ১ হাজার ৭৭১ ভোট পান। অবশ্য এ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর টেলিভিশন মার্কাকেই নৌকা প্রতীক মনে করে ভোট দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।
ওই সময়ের ভোটের মাঠের অন্যতম নেতা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম শফিকুল আলম জানান, ১৯৯৬ সালে ঐক্যবদ্ধভাবে থানা আওয়ামী লীগের ৫১ জনের মধ্যে ৪৮ জন মকবুলের পক্ষে ছিলেন। মকবুলের টেলিভিশন মার্কাকে নৌকা প্রতীক মনে করেছিলেন। পোস্টারে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু লেখা এবং বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিল। প্রার্থী হিসাব উদ্দিনও মকবুলকে সমর্থন দিয়েছিলেন।
২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী আব্দুল গনি ৮৬ হাজার ৭৫০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী মকবুল হোসেনের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৬৩ হাজার ৩৩২টি। এ নির্বাচনের সময় দলীয় কিছু কোন্দল এবং প্রতিপক্ষের হামলা ও বাধা দেয়ার কারণে নির্বিঘ্নে নৌকায় ভোট দেয়া যায়নি বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ওই সময়ের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী নেতৃত্ব প্রদানকারী কয়েকজন নেতা।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিএনপি প্রার্থী আমজাদ হোসেন ৮৬ হাজার ৭৬৮ ভোট পেয়ে জয়ী হন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী মকবুল হোসেন পেয়েছিলেন ৮৪ হাজার ২৭৯টি ভোট। ব্যবধান ছিল মাত্র ২ হাজার ৪৮৯ ভোট। এ নির্বাচনে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে অনেকেই নৌকায় নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেননি বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি বিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) প্রার্থী মকবুল হোসেন। ফুটবল প্রতীকে তার প্রাপ্ত ভোট ৪৬ হাজার ৭৭০টি। অপরদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এমএ খালেক নৌকা প্রতীকে পান ৩৬ হাজার ৪৮৯ ভোট। এ নির্বাচনেও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র ও নৌকায় ভোট দেয়।