ফের পাটকল শ্রমিকদের অনশন, অসুস্থ অর্ধশতাধিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, খুলনা
অনশনস্থলেই অসুস্থ শ্রমিকদের স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে

অনশনস্থলেই অসুস্থ শ্রমিকদের স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে

  • Font increase
  • Font Decrease

বকেয়া মজুরি পরিশোধ, পাট খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ, নতুন মজুরি কমিশন গঠনসহ ১১ দফা দাবিতে ফের আমরণ অনশন শুরু করেছে খুলনাঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকরা। আমরণ অনশনে অংশ নেওয়া প্রায় অর্ধশতাধিক পাটকল শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) অনশনের তৃতীয় দিনে শ্রমিকরা অসুস্থ হতে শুরু করলে প্রথমে তাদের অনশনস্থলেই স্যালাইন দেওয়া হয়। পরে কয়েকজন শ্রমিকের অসুস্থতা বাড়লে তাদের খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (খুমেক) ভর্তি করা হয়েছে।

খুলনাঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের আমরণ অনশন

খুলনাঞ্চলের ৯টি পাটকলের মধ্যে খালিশপুর, ক্রিসেন্ট, প্লাটিনাম, স্টার ও দৌলতপুর জুট মিলের প্রধান গেটের সামনের বিআইডিসি সড়কে প্রথম দফা আমরণ অনশনের প্যান্ডেলেই আবার দ্বিতীয় দফায় কর্মসূচি পালন করছে। রাতভর শীত উপেক্ষা করে অনশনস্থলে অবস্থান করছে হাজারো শ্রমিক। আমরণ অনশনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে জুট মিলে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে এ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। শ্রমিকদের অনশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শ্রমিক নেতা ও সিবিএ নেতৃবৃন্দ।

শ্রমিক নেতারা বলেন, অভুক্ত থেকে আমরণ অনশনে অংশ নেওয়ায় ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে বিভিন্ন মিল থেকে প্রায় অর্ধশতাধিক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েছে। প্রাথমিকভাবে অনশনস্থলে অসুস্থ শ্রমিকদের স্যালাইন দেওয়া হলেও গুরুতর অসুস্থদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও ক্রিসেন্ট জুট মিলের সাবেক সিবিএ সভাপতি মুরাদ হোসেন বার্তা২৪.কম-কে বলেন, যেকোনো মূল্যে শ্রমিকরা এবার মজুরি কমিশনের বাস্তবায়ন চায়। অসুস্থ হয়েও শ্রমিকরা অনশনস্থল থেকে কোথাও যায়নি। জীবনের বিনিময়ে হলেও তারা তাদের দাবি পূরণ করতে চায়।

স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে শ্রমিকদের

প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিক নেতা খলিলুর রহমান বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ক্ষুধার যন্ত্রণা আর তীব্র শীতের দাপটে আমরণ অনশনে অংশ নেওয়া শ্রমিকরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অনশনে থাকা অধিকাংশ শ্রমিকই দুর্বল। যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

জানা যায়, এর আগে গত ২৩ নভেম্বর থেকে ১১ দফা দাবিতে আন্দোলনে নামে খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকরা। বিক্ষোভ মিছিল, শ্রমিক ধর্মঘট, গেটসভা, বিক্ষোভ সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে ১০ ডিসেম্বর দুপুর থেকে আমরণ অনশনে বসে শ্রমিকরা। ওই কর্মসূচি খুলনা অঞ্চলে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলের মধ্যে ৮টি পাটকলের শ্রমিকরা অংশ নেন। শুধু যশোরের কার্পেটিং জুট মিলের শ্রমিকরা ওই কর্মসূচিতে অংশ নেননি। অনশনের ৩দিন পর ৩ ডিসেম্বর রাতে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে তিনদিনের জন্য আমরণ অনশন কর্মসূচি স্থগিত করেছিলেন শ্রমিকরা। রাত ১টার দিকে একে একে খুলনার বিভিন্ন পাটকলের শ্রমিকরা ঘরে ফিরে যান। ওই রাতে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী। এ সময় তিনি ১৫ ডিসেম্বর শ্রমিকদের মজুরি কমিশন বাস্তবায়নে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা এবং বিকেলে বিজেএমসি সভাকক্ষে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে সভার কথা জানান। ওই সভা থেকে ভালো ফলাফল আসতে পারে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী শ্রমিক নেতাদের অনশন তুলে নিয়ে ঘরে ফিরে যেতে বলেন। ওই আশ্বাসের প্রেক্ষিতে প্রথম দফায় ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনশন স্থগিত করেছিলেন শ্রমিকরা। ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাতভর শ্রমিকদের সঙ্গে শ্রমিক নেতাদের দফায় দফায় আলোচনা চলে। এ সময় নেতারা চাইলেও শ্রমিকরা অনশন ভঙ্গ করতে নারাজ ছিলেন। তবে রাতেই তারা বাড়িতে ফিরে যান। শ্রমিকরা বাড়িতে ফিরলেও অনশনস্থলের প্যান্ডেল সেভাবেই থেকে যায়। ১৪ ডিসেম্বর থেকে একে একে খুলনা অঞ্চলের সকল পাটকলের উৎপাদনে যোগ দেয় শ্রমিকরা। তবে ১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠক ব্যর্থ হয়। পরে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চাওয়া হয় শ্রমিক নেতাদের কাছে। ওইদিন শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকেও ভালো কোনো ফল হয়নি। ওই বৈঠকে প্রতিমন্ত্রী ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চান। কিন্তু ২৬ ডিসেম্বরের বৈঠকে মজুরি কমিশনের বিষয়ে কোন সুরাহা না হওয়ায় ২৯ ডিসেম্বর থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন শ্রমিক নেতারা।

অনশনস্থলে স্লোগান দিচ্ছে শ্রমিকরা

উল্লেখ্য, খুলনা অঞ্চলে মোট রাষ্ট্রায়ত্ত নয়টি পাটকল রয়েছে। এর মধ্যে খুলনায় রয়েছে সাতটি ও যশোরে দুটি। খুলনায় থাকা পাটকলগুলো হলো ক্রিসেন্ট জুট মিল, খালিশপুর জুট মিল, দৌলতপুর জুট মিল, প্লাটিনাম জুট মিল, স্টার জুট মিল, আলিম জুট মিল ও ইস্টার্ন জুট মিল। আর যশোরের দুটি জুট মিল হলো কার্পেটিং ও জেজেআই।

   

‘আমাগো মতো শ্রমিকদের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নাই’



মেহেদী হাছান মাহীম, বার্তা ২৪. কম, ঢাকা
ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

‘আমাগো মতো শ্রমিকদের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নাই’ এমন বুকভরা আক্ষেপ নিয়ে নিজের কষ্টের কথা প্রকাশ করেছেন ষাটোর্ধ্ব বয়সের তছিরন বেগম। স্বামী অনেক আগে মারা গেলেও ছেলেই ছিল তার একমাত্র ভরসা। এখন সেই ছেলেও অসুস্থ। পরিবারের সকল দায়িত্ব এখন তছিরন বেগমের উপর। পরিবারের দায়িত্ব মেটাতে তছিরন বেগম এখন কাজ করছেন রাজধানী ঢাকার গাবতলী এবং আমিন বাজারের মধ্যস্থল দিয়ে বয়ে যাওয়া তুরাগ নদী সংলগ্ন কয়লা ব্যবসা কেন্দ্রে। দিনে বারো ঘন্টা মাথায় করে বোঝাই করে কয়লা টানার কাজ করেও তেমন কোনো টাকা পায়না তিনি। এরকম ঝুকিপূর্ণ কাজে জীবনেরও নেই কোনও নিশ্চয়তা।

পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। ১৮৮৬ সালে এদিনে শ্রমিকরা আমেরিকার শিকাগো শহরে তাদের কর্মক্ষেত্রে দৈনিক ১২ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন করেছে। সেদিন আন্দোলনের একপর্যায়ে পুলিশ শ্রমিকদের উপর পুলিশ গুলি করতে শুরু করে। এতে করে প্রায় ১০-১২জন শ্রমিক নিহত হয় । পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা লড়াইকে স্বীকৃতি দিয়ে ওই ঘটনার স্মারক হিসেবে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অবশেষে শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। সেই থেকে পহেলা মে পালিত হয় হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস।

শ্রমিক দিবস কবে, কেন শ্রমিক দিবস পালিত হয় সে বিষয়ে কোনো কিছুই জানেনা তছিরন বেগম। তিনি বলেন, শ্রমিক দিবস কি এবং কেন পালিত হয় এ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।

তিনি আরও বলেন, কয়লা বোঝাই করা কাজ অনেকদিন ধরে করতেছি। আমাদেরকে খেটে খাওয়া লাগে। আমার একটা ছেলে সন্তান আছে। তার ঘরে দুটো মেয়ে আছে। আমার ছেলেও অসুস্থ। সে আগে মাছের ব্যবসা করতো। একদিনে আয় হয় দুই থেকে তিনশো টাকা। এই টাকা দিয়ে কিছুই হয়না। ৬০ বছর বয়সে এসে আমাদের এই কাজ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ঘরে ইনকাম করার মতো কেউ নেই। আমার কোনো বয়স্ক ভাতাও নেই।


তিনি আরও বলেন, আমি প্রায় ১২ ঘণ্টা কাজ করি। আমাগো মতো শ্রমিকদের জীবনের কোনও নিশ্চয়তা নাই। এখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে মালিক পক্ষ কোনো ধরনের সাহায্য করে না।

হাফিজুর রহমান নামে আরেকজন কয়লা শ্রমিক বলেন, এখানে যে যতবেশি পরিশ্রম করে, সে ততবেশি টাকা পায়। কেউ কেউ ২০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত ইনকাম করে। অতিরিক্ত গরমের কারণে এখন কাজ করতে অনেক অসুবিধা হচ্ছে। যে টাকা ইনকাম করতেছি এটা দিয়ে পরিবার চলে না। মাঝে মাঝে ঋণ করে চলতে হয়। আমরা অসুস্থ হলে মালিক পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য আসে না।

মে দিবসের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি তছিরন বেগমের মতো একই কথা বলেন। তিনি বলেন, আমি শ্রমিক দিবসের নাম জীবনেও শুনি নাই।

সয়েলি আক্তার নামে একজন মহিলা বালু শ্রমিক বলেন, আমি দৈনিক ১২ ঘণ্টা কাজ করি। সারাদিন পরিশ্রম করে ২০০-৩০০ টাকা পাই। পরিবারে আমার স্বামী এবং একটা ছোট মেয়ে আছে। এই রোদের ভিতরে কাজ করে চেহারা খারাপ হয়ে গেছে। আমরা গরীব মানুষ, আমাদেরকে কাজ করেই খেতে হবে। শ্রমিক দিবস সম্পর্কে তিনি বলেন, পহেলা মে শ্রমিক দিবস একথা আমরা লোকমুখে শুনছি। কিন্তু, এ সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না।

নাম বলতে অনিচ্ছুক একজন বালু শ্রমিক বলেন, ৪৫ টা টুকলি টানলে ১০০ টাকা পায়। গরমের কারণে ১০০ টাকাও ইনকাম করতে কষ্ট হয়। পরিবারে ঠিকমতো বাজারের খরচই হয়না। আমি ছাড়া সংসারে ইনকাম করার মতো কেউ নেই। আমার এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি অনেক আগে। আমার স্বামী মারা গেছে অনেক আগে। অভাবের তাড়নায় ১৩ বছরের ছেলেকে গার্মেন্টসে দিয়েছি। বেতন পায় মাত্র ৫ হাজার। কোনোমতে ডালভাত খেয়ে বেঁচে আছি। আমার ছেলে আমার একমাত্র ভরসা। আমার ছেলের নাম মো. ইয়াসিন। এই কাজ করতে গিয়ে যদি আমার কোনও সমস্যা হয় তাহলে আল্লাহ ছাড়া দেখার কেউ নেই। আমি টাকার জন্য বাজার করতে পারি না। জিনিসপত্রের দামের তুলনায় আমাদের পারিশ্রমিক বাড়ছে না। আমাদের এখন তেমন ইনকাম হয় না।

শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি শ্রমিক দিবস সম্পর্কে অল্প একটু জানি। এদিনে বিদেশে শ্রমিকরা আন্দোলন করেছে।

;

চা পাতায় বন্দী জীবন

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



সীরাত মঞ্জুর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম
ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

‘সুখ-দুঃখ সবই এই চা বাগানে। ছেলে বয়সে চা বাগানের গাড়িতে কাজ করেছি, চা চারার কলম গাছ কেটেছি। বাগানের লাকড়ি কাটি। এই বাগানে আমাদের বাপ-দাদা চৌদ্দগোষ্ঠীর জন্ম। এখান থেকে বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এখানেই আমাদের জন্ম, এখানেই মৃত্যু!’

সোমবার (২৯ এপ্রিল) বিকেলে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির কর্ণফুলী চা বাগানে দাঁড়িয়ে এই প্রতিবেদককে নিজের জীবনের কথা এভাবেই তুলে ধরেন ৬৫ বছর বয়সী চা শ্রমিক পুলক রায়।

ছবি: চা শ্রমিক পুলক রায়।

জীবনের শেষ সময়ে এসেও পুলক রায়ের যেন নেই কোনো অবসর। জীবনের কঠিন সংগ্রাম এখনো চলছে। তরুণ বয়সে বাগানের চা চারার কলম কেটেছেন, গাড়িতে কাজ করেছেন । তবে বয়সের ভারে এখন আর এসব ভারি কাজ পারেন না। পরিবারে স্ত্রী পুত্র কেউ না থাকলেও পেটের দায়ে এখনো চা বাগানের লাকড়ি কাটার কাজ করে যেতে হচ্ছে তাকে। চা বাগানের বাইরে গিয়ে কিছু করবেন, সেটি ভাবনাতেও আসেনি কখনো। চা বাগানেই যে বন্দী পুলকের জীবন।

চা বাগানে জন্ম, কর্ম থেকে মৃত্যু। এমন জীবন চক্র শুধু পুলক রায়ের নয়, বাগানের প্রায় সব শ্রমিকেরই। চায়ের সবুজ পাতার প্রেমে পড়ে তাদের বেড়ে ওঠা। সেই চাকে ঘিরেই শুরু হয় জীবনের প্রথম কর্ম। নারীরা করেন পাতা তোলার কাজ। আর পুরুষেরা চা বাগান ও কারখানার বিভিন্ন শাখায় কাজ করেন।

গৌরি মালা পাতা তোলেন, স্বামী উজ্জ্বলও বাগানে কাজ করেন। দুই মেয়ে ও এক ছেলের সংসার তাদের। ছেলে ছোট্ট হওয়ায় স্কুলে পড়লেও টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে যায় মেয়েদের পড়ালেখা। বাগান থেকে পাতা তুলে ঘরে ফিরতে কথা হয় গৌরির সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রতিদিন সকাল ৭টায় বের হই। বাগানে পৌঁছায় ৮টায়। কাজ শেষে ফিরি বিকেলে ৪টায়। যা টাকা পাই স্বামীসহ দুজনের ইনকাম দিয়ে ভগবানের দয়ায় চলি। আমাদের কর্ম ও জীবন এই চা বাগানেই সীমাবদ্ধ।

ছবি: কাজ শেষে দল বেঁধে ঘরে ফিরছেন তারা।

একদিন ছেলে-মেয়েরাও তাদের জায়গা নেবে বলে মনে করেন গৌরি। বলেন, ‘এখন আমরা বাগানে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের দেখাদেখি ছেলে-মেয়েরাও করবে। এখানে তাদের বিয়ে-সাদি করাব। এরপর তাদের ছেলে মেয়েরাও একদিন বাগানে কাজ করবে। দুঃখ লাগে না। কিসের দুঃখ! বাগানে যখন জন্ম, বাগানেই কাজ করে খাই।’

ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল পাঁচটা। পাতা তোলার কাজ শেষ করে এসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাগানের পাশে বসে নিজের ছেঁড়া কাপড় সেলাচ্ছিলেন জোসনা বালা। ত্রিশ বছর ধরে বাগানে কাজ করছেন তিনি। জানতে চাইলে বলেন, আমার বয়স এখন ৪৫। ত্রিশ বছর ধরে পাতা তুলছি। কি আর করব, কষ্ট হলেও কর্ম করতে হয়। টাকা পয়সা নেই, জায়গা নেই। আমাদের বাপ দাদারা যেই কর্ম করে খেয়েছেন। আমরাও তাই করে চলছি।

নিজেদের আর্থিক দুর্দশার কথা জানাতে গিয়ে জোসনা বলেন, এমন না যে আমরা সরকার থেকে কোনো দামি কিছু পেলাম। দুমাস খেলাম। এসময়ে কাজ করা টাকাগুলো জমা রাখলাম, ছেলে মেয়ে শিক্ষা করলাম, নিজস্ব বাড়ি ভিটা বানালাম। এরকম সুযোগ আমরা পাই না। যতদিন কাজ করি ততদিন খাই। ১৭০ টাকা করে পাই। যদি ২৫ কেজি করে ৫০ কেজি পাতা তুলতে পারি তাহলে একদিনে ৩৪০ টাকার মতো পাওয়া যায়। আর যখন গাছে পাতা কম থাকে তখন তো আর বেশি তোলা যায় না। বৃষ্টি হচ্ছে না, গাছে পাতা নাই তেমন। যা পাতা তুলি, তাই পয়সা পাই। যখন পাতা ছিল তখন একশ’ কেজিও পাতা তুলছি। তখন ৭০০ টাকা মত পেয়েছি।’

ছবি: পাতার পোটলা নিয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা।

কাজের কষ্টের কথা তুলে ধরতে গিয়ে জোসনা বলেন, পাতা তুলতে গিয়ে হাত ফেটে যায়। যারা নতুন তারা আরও হাতে আঘাত পায়। রোদের মধ্যে কাজ করতে হয়। ওপরে রোদ, নিচে গরম বালি। এর মধ্যে আমাদের কাজ করতে হয়। সপ্তাহে যে বেতন পাই তা দিয়ে চলে না, ঋণ হয়ে যায় অনেক টাকা। ১৭০ টাকায় আমাদের জীবন-মরণ।’

জোসনা ও গৌরি মালাদের সঙ্গে টাকার অভাবে পাতা তোলার কাজ শুরু করেছেন আমেনা ও ফাল্গুনি রায় নামের দুই কিশোরী। আমেনা বলে, পাঁচ ক্লাস পড়েছি। দুই সপ্তাহ আগে পাতা তোলার কাজ শুরু করেছি। রোদে পাতা তুলতে আমার কষ্ট হয়। তারপরও কি আর করব, কাজ করতে হবে।

ফাল্গুনি রায় বলে, আমি একমাস ধরে পাতা তুলছি। পাঁচ ক্লাস পড়েছি। বড় কিছু হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও আমাদের অভাবে তা আর হয় না। তাই পাতা তুলার কাজ করছি।

মা-বাবার সঙ্গে শহরে থাকলেও শ্বশুর বাড়ি এসে তিন মাস ধরে চা শ্রমিকের কাজ করছেন সুমি। তিনি বলেন, আমি মাত্র তিন মাস ধরে কাজ করছি। এটা আমার শ্বশুর বাড়ি। শহরে থাকা অবস্থায় কিছু করতাম না। এখন তো অভাবের জন্য কাজ করতে হচ্ছে। কেউ তো আর সুখে কাজ করে না।

ছবি:বাগানের মাঠে খেলছিল শ্রমিকের ছেলেরা।

বাগানের মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করছিল ১০ বছর বয়সী রাহুল দে। ফেনুয়া টি স্টেট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সে। মা-বাবা দুজন চা শ্রমিক হলেও সে হতে চায় চিকিৎসক। জানতে চাইলে বলে, আমি বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই। বাগানে কাজ করতে চাই না।

চা শ্রমিকেরা প্রতিদিন সকাল হলে দল বেঁধে ছুটে যান বাগানে। কাজ শেষে বিকেল হতেই ফিরে আসেন ঘরে। জীবন-মান উন্নয়নে সবসময় পিছিয়ে তারা। এমন কি তারা অন্য শ্রমিকদের তুলনায় পান সবচেয়ে কম পরিমাণের দৈনিক মজুরি। এভাবে চা বাগানকে ঘিরে বাঁধা পড়ে আছে তাদের জীবন। ছোট্ট শিশু জন্মের পর প্রথম যে দৃশ্য দেখে সেটিও চায়ের সবুজ পাতা। বেড়ে ওঠা থেকে মৃত্যুও এই চা বাগানে।

প্রসঙ্গত, চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে টানা তিন সপ্তাহ আন্দোলনের পর ২০২২ সালে ২৭ আগস্ট ৫০ টাকা দৈনিক মজুরি বৃদ্ধি করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমান চা শ্রমিকের নূন্যতম দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা।

;

দৃষ্টিহীন মায়ের আশার আলো শাহজাহান



রেদ্ওয়ান আহমদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম
ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

শাহজাহানের বয়স মাত্র ১২ বছর। এই বারো বছর বয়সেই সে যেন এক জীবনযোদ্ধা। ছয় বছর বয়সেই জন্মান্ধ মাকে ফেলে গেছেন রাঙামাটির লংগদুর বাসিন্দা বাবা আলতাফ হোসেন। বড় ভাইটাও মেপেছেন নিজের পথ। এরপর জীবিকার তাগিদে লংগদু ছেড়ে পাহাড়তলীতে এসে মা-সহ ঠাই নেয় সে। মা শুরু করেন ভিক্ষাবৃত্তি আর শাহজাহান জড়ায় শিশুশ্রমে। এভাবেই জন্মান্ধ মাকে নিয়ে গড়ে উঠে তার কষ্টের সংসার। যার কারণে দুয়েকবার স্কুলের বারান্দায় পা রাখলেও ভালো করে স্বরবর্ণের পাঠটাও নিতে পারলো না দারিদ্রের কারণে।

শাহজাহান এখন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী নতুন ব্রিজ এলাকার একটি দোকানে চার হাজার টাকা মাসে কাজ করে। তাই মাকে আর ভিক্ষাবৃত্তি করতে দেয় না। তবুও জীবনের প্রয়োজনে মাঝে মাঝেই মা সাজেদা খাতুনকে যেতে হয় ভিক্ষা করতে। কিন্তু শাহজাহান মায়ের এই ভিক্ষাবৃত্তি দেখতে চান না। কিন্তু নিয়তি যে তার সহায় নেই!

মায়ের প্রতিবন্ধিতার কারণে ছেড়ে যাওয়া বাবার প্রতি শাহজাহানের অভিমান বিশাল। তাইতো, জীবিত বাবাকে সে পরিচয় করিয়ে দেয় ’মৃত’ বলে। দিবেই বা না কেনো? যে বাবা স্ত্রী সন্তানকে ছেড়ে যেতে পারেন সে বাবা জীবিত থেকেও বা কী লাভ! পড়ালেখা করে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও এখনো পর্যন্ত শাহজাহানের সে স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে। তার যে ঘরে আয়-রোজগারের কেউ নাই!

’আব্বা মারা গেছে অনেক বছর আগে। আমার তখন ছয় বছর। এরপর থেকেই মাকে নিয়ে আমি এখানে থাকি। পড়ালেখা করার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু দুয়েকবার স্কুলে গেলেও আর যাওয়া হয় নাই। দোকানে কাজ করে চার হাজার টাকা মাসে পাই, এইটা দিয়ে মারে নিয়ে কোনরকম চলি।’ অন্ধ মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব কাঁধে মাত্র বারো বছরেই এ যেনো এক পঁচিশোর্ধ্ব যুবকের কণ্ঠস্বর।

তখনও মায়ের ভিক্ষাবৃত্তির কথা গোপন করে লাজুক শাহজাহান। মা সাজেদার নাম্বার চাইতেই দেয় সে। বলে, ’মা চোখে দেখে না। তবে, বাটন ফোন দিয়ে কল রিসিভ করতে জানে। আমার মুবাইল নাই। প্রয়োজনে মালিকের মুবাইল দিয়ে ফোন করি।’ অতঃপর জন্মান্ধ মা সাজেদাকে ফোনকল করলে রিসিভ করে তিনি মুঠোফোনটি তুলে দেন প্রতিবেশী রাশেদা বেগমের হাতে।

তার কাছ থেকে সকল তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া গেলেও শাহজাহানের বাবার মৃত্যুর বিষয়টা খোলাসা করে তিনি বলেন, ’ওর বাবা মারা যায়নি। ওর মা অন্ধ হওয়ায় একটা সময় পর ওর মা ওদেরকে ছেড়ে চলে যায়। ওদের আর কোন খোঁজ খবর রাখে না। যার কারণে, শাহজাহান বাবা মারা গেছে বলে পরিচয় দেয়। শাহজাহান দোকানে কাজ করলেও এই টাকা দিয়া তাদের সংসার চলে না। যার কারণে সাজেদা মাঝেমধ্যে ভিক্ষা করতে যায়।’

চট্টগ্রামের নতুন ব্রিজস্থ ’সফওয়ান ফুডস এন্ড বিরিয়ানি হাউজ’ এর মালিক নুরুল কবিরের সাথে আমাদের কথা হয়। তিনি বলেন, ’শাহজাহান পড়তে চাইলে পড়বে। বাঁধা নেই। তবে, তার জীবন পরিচালনার জন্য আর্থিক আয়-রোজগারও দরকার। তার পারিবারিক অবস্থা খুবই করুণ। তার মা আছে। তাকে তারই চালাতে হয়। তাই, লোক না লাগা সত্ত্বেও তাকে আমরা দোকানে নিয়েছি। মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা বেতনে। সে বাসা থেকে ভাত আনা-নেওয়া করে। দোকানের মালামাল এগিয়ে দেয়। তিন-চার মাস ধরে সে কাজ করছে। ছেলে হিসেবে এ পর্যন্ত তাকে বেশ ভালোই মনে হয়েছে আমাদের।’

শাহজাহানের জন্মান্ধ মা সাজেদা খাতুন কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আল্লাহর কাছে লাখো-কোটিগুণ শুকরিয়া। আমার জীবন এখন এই ছেলেকে নিয়েই। স্বামী গেলো, বড় ছেলে গেলো। এই ছেলে আমাকে আগলে রাখছে। আমাকে ভিক্ষা করতে দিতে চায় না। আমারও ভিক্ষা করতে মন চায় না। কিন্তু কী করবো বলেন, জীবন তো চালানো লাগবো! আমার ছেলেরে নিয়া আমার অনেক স্বপ্ন। সে অনেক বড় হবে একদিন ইনশাআল্লাহ।’

;

ফেনীর ট্রাংক রোড; যেখানে ভোরবেলা চলে শ্রমিক বিকিকিনি



মোস্তাফিজ মুরাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,ফেনী
ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

দেশব্যাপী চলছে তীব্র তাপদাহ। এর মধ্যে কাক ডাকা ভোরে বাঁশের ঝাকা আর কোঁদাল হাতে ফেনীর ট্রাংক রোডে শ্রম বিক্রির হাটে হাজির দেশের দূর-দূরান্তের প্রায় ৭ শতাধিক খেটে খাওয়া মানুষ। কাজের আশায় শ্রম বিক্রি করতে এ বাজারে ওঠেন তারা। তীব্র গরমে যখন মানুষের হাসফাঁস অবস্থা ঠিক ওই সময় ক্ষুধা আর দারিদ্রের কষাঘাতে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো দুবেলা দু’ মুঠো অন্নের জন্য শ্রমিক হিসেবে নিজেকে বিক্রি করেন ফেনীর এই শ্রম বিক্রির হাটে।

প্রত্যেকদিন ভোরে রাজমিস্ত্রী, কাঠমিস্ত্রী, রংমিস্ত্রী ও দিনমজুরসহ বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষের সরগম হয়ে ওঠে এ হাট। শ্রমিক কিনতে আসেন অনেক প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার ও মালিকরা। শ্রমের হাটে আসা অনেকে বিক্রি হলেও কিছু থেকে যান অবিক্রিত। দামদর শেষে যারা বিক্রি হন তারা রওনা হন মালিকের গন্তব্যে। অবিক্রিতদের দিনব্যাপী কাটাতে হয় অলস সময়। কাজ না পেলে নিজের গন্তব্যে ফিরে যান তারা।

জানা গেছে, প্রায় তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে ফেনী শহরের জিরো পয়েন্টে, বরিশাল, রংপুর,কুড়িগ্রাম, রামগতি, লক্ষীপুর, নেত্রকোনা, খুলনা, বাগেরহাট, সিলেট, ময়মংসিংসহ নানান জেলার শ্রমজীবী মানুষ আসে এ শ্রম হাটে। নিয়মিত হাট বসলেও এ হাটে নেই কোনো খাজনা বা হাট কমিটির ঝামেলা। আপন গতিতেই চলছে এই হাট, এদিক থেকে কিছুটা শান্তিতে থাকলেও কাজের নিশ্চয়তা ও জীবনের নিরাপত্তা একদম অনিশ্চিত।

শ্রমজীবীরা জানান, মাঝে মাঝে কাজ পেলেও বেশির ভাগ সময় নিজেকে বিক্রি করতে পারেন না। কাজভেদে ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা মজুরিতে জেলার বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে যান তারা। কাজ না পেলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয় তাদের। রোদ, বৃষ্টি কিংবা ঝড় সবসময় এ হাটে বিক্রির আশায় উপস্থিত হন বলে জানান তারা।

দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতির বর্তমান বাজারে শ্রমের পর্যাপ্ত মূল্যে পাওয়া যায়না উল্লেখ করে তারা বলেন, সবকিছুর যে দাম। যত টাকা পাই তা দিয়ে একদিন চলাও কষ্টের। দূর থেকে আসি স্টেশন কিংবা ফুটপাতে রাত কাটাই। সকালে কাজ পেলে সন্ধায় আবার কোথাও মাথা গোজার ঠাঁই খুঁজি। এরমধ্যে তীব্র গরমে কাজ করতে হয়, আমাদের দুঃখ দুর্দশা দেখার যেন কেউ নেই।


বরিশালের আবু মিয়া। বিগত ১০ বছর ধরে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন ফেনীতে। আগে সারাদিনের জন্য নিজেকে ৪০০-৫০০ টাকায় বিক্রি করতেন যেকোনো কাজের জন্য। তবে এখন তা বেড়ে ৭০০-৮০০ টাকা হলেও বাজারদর অনুযায়ী চলতে কষ্ট হয় বল জানান তিনি। তিনি বলেন, কাজ পেলে মুখে হাসি ফুটে আমাদের, না পেলে মলিন মুখে পরদিনের জন্য অপেক্ষা করি। তবে ফেনীর মানুষ ভালো, পেট ভরে খাবার দেয়, আবার কাজ শেষে বকশিস দেয়।

লক্ষীপুরের নূরে আলম। যিনি নদী ভাঙ্গনে সব হারিয়ে ফেনীতে দিনমজুরের কাজ করতে আসেন। নিজের দুঃখের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিদিন সকালে বাজারে উঠে বিক্রি হই। ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা বিনিময়ে আমরা কাজে যাই। বৃষ্টি হলে আবার কাজ নেই তখন কপালে ভাত জোটেনা। কেউ আমাদের কাজে নিলে গৃহস্থ ভালো হলে একটু আপ্যায়ন পাই। আর খারাপ হলে আমাদের উপর নির্মম কাজের অত্যাচার চলে।

তিনি বলেন, কেউ ৩ বেলার খাবার এক বেলায় দেয় অনেকে আবার দেয় না। যে টাকা পাই সেটা দিয়ে খেলে আর কিছুই বাকি থাকেনা। কষ্ট করে চলতে হয় আমাদের। আমরা গরীব মানুষ, আমাদের কথার গুরুত্ব নেই। পেটের দায়ে নিজের শ্রম বিক্রি করে খেতে নিজ জেলা থেকে এখানে এসেছি।

সিলেটের মোবারক আলীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ফেনীর এ হাটে ভালো কাজ পাওয়া যায়। যার জন্য বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ আসে কাজের খোঁজে। আমরা এখানে কৃষিকাজ, রাজমিস্ত্রীর কাজ করি। ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার বিনিময়ে কাজ করি। এ টাকা দিয়ে সংসার চালানো যায়না। যে শ্রম দিই সে অনুযায়ী টাকা পাইনা। কর্ম করায় আমাদের দিয়ে কিন্তু সে অনুপাতে টাকা দেয় না। আমাদের এসব বিষয়ে যদি সবাই খেয়াল রাখে আমরা আরও বেশি ভালো থাকতে পারব।

চাঁদপুরের আবুল হোসেন বলেন, ফেনীতে কাজ ভালো পাওয়া যায় বিধায় আমরা ফেনীতে আসি। টাকা খারাপ পাইনা তবে কাজের তুলনায় তা অনেক কম।আমরা পারিশ্রমিক অনুযায়ী আরও বেশি টাকা পেতে পারি। তারপরও পরিবারের জন্য কাজ করতে হয়। যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাই। সরকার যদি আমাদের জন্য কিছু সহযোগীতা করে আমরা আরও ভালো থাকতে পারব।

হাটে শ্রমিক নিতে আসা ফেনীর মো. হানিফ জানান, এখানে আসা শ্রমিকরা খুব ভালো । কথাও শুনে তারা। বাড়ির কাজের জন্য তিন জন শ্রমিক নিয়ে যাচ্ছি। তবে আগের তুলনায় কিছুটা দাম বেড়েছে। শ্রমিকদের প্রশংসা করে তিনি বলেন, মানুষগুলো বেশ কাজের। তাদের কাজের বরকত বেশি। ফেনীতে তাদের বেশ সুনাম রয়েছে।

রফিকুল হায়দার নামে এক ঠিকাদার বলেন, ঠিকাদারি কাজ করি। লোক প্রয়োজন হয়। ফেনীর এ হাটে এসে লোক নিয়ে যাই। আগে ৬০০ টাকা দিয়ে নিয়ে লোক পাওয়া যেত। এখন ১ হাজার টাকার নিচে পাওয়া যায়না। মাটি কাটার জন্য আরও বেশি চায়। গরমের কারণে লোকবলের সংকট পাশাপাশি ধান কাটার মৌসুম হওয়াতে পর্যাপ্ত লোক নেই। ফলে দিনমজুরদের বাড়তি টাকার নিতে হচ্ছে। এদের বেশিরভাগ বাইরের জেলা থেকে আসে। ফেনীর লোকরা গ্রাম অঞ্চলে কাজ করে। টাউনে যারা থাকে সবাই বাইরের।

তবে এসকল শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দেয়াসহ এ রোদের মৌসুমে রোদে বেশিক্ষণ কাজ না করানোর জন্য মালিকদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন ফেনীর সচেতন মানুষরা।

নূর করিম মুন্না নামে ফেনীর এক সংগঠক বলেন, রোজ সকালে এ মানুষগুলোকে ট্রাংক রোড় এ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। রোদ কিংবা বৃষ্টি অথবা তীব্র শীত। কাজের জন্য তারা সবসময় এখানে আসেন। তাদের শ্রমের যোগ্য মূল্যায়ন হওয়া উচিত। প্রশাসন কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উচিত তাদের খোঁজ নেয়া, তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা। এ যে এখন তীব্র তাপদাহ এর মধ্যে তাদের হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা রয়েছে। শ্রমিক দিবসের আন্দোলন শ্রমিক ন্যায্য অধিকারের আদায়ের জন্য। এসব বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকা উচিত।

মঞ্জিলা মিমি নামে ফেনীর আরেকজন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠক বলেন, শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সবার ভূমিকা রাখতে হবে। শুধুমাত্র দিনমজুর নয়, ফেনীতে অনেক শ্রমিক আছে যারা অনেক কষ্টে দিন যাপন করে। শ্রমিক দিবসে দায়িত্বশীলদের তাদের বিষয়ে আরও যত্নবান হতে হবে তবেই শ্রম যোগ্য মূল্যায়ন পাবে।

;