ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-১৪

, শিল্প-সাহিত্য

মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-31 17:00:46

[চতুর্দশ কিস্তি]

বেশ কিছুদিন ধরেই মহাজাগতিক নানান রহস্যের সঙ্গে পৃথিবীর মানুষকে আলাপ করিয়ে দিচ্ছে নাসা। নানা ছবি দিয়ে বাড়িয়ে তুলছে কৌতূহল ও বিস্ময়! লাইব্রেরির কাজের ফাঁকে ম্যারি এসব তথ্য আগ্রহ নিয়ে পড়েন। সম্প্রতি নাসা একটি গ্রহের ছবি পোস্ট করেছে। যে সে গ্রহ নয়! রংধনু রঙের এক গ্রহ! মহাকাশ সংস্থার সাম্প্রতিক ইনস্টাগ্রাম পোস্টে এই রঙবেরঙের গ্রহটিকে দেখে তাজ্জব ম্যারি! গ্রহের বিভিন্ন অঞ্চল বিভিন্ন রঙের। এই গ্রহ আসলে সবারই খুব চেনা! চেনা প্লুটোই অচেনা রঙের ক্যানভাস হয়ে দেখা দিয়েছে ছবিতে। নিউ হরাইজনস বিজ্ঞানীরা গ্রহের নানা অঞ্চলগুলোর মধ্যে অনেক সূক্ষ্ম রঙের পার্থক্য তুলে ধরেছেন ছবিতে।

ম্যারি দেখলেন, প্লুটোর পৃষ্ঠ জটিল, বৈচিত্র্যময়। কোথাও পাহাড়, কোথাও অজস্র উপত্যকা, নতুন, মসৃণ বরফের সমভূমির ঠিক পাশেই পুরনো গর্তযুক্ত জমি এবং এমনকি বায়ু প্রবাহের ফলে গঠিত টিলাও রয়েছে।

উৎক্ষেপণ করা একটি মহাকাশযান ছ’মাস ধরে প্লুটো এবং অন্যান্য উপগ্রহ নিয়ে বিশদে অধ্যয়ন করে এসব তথ্য ও ছবি পাঠিয়েছে। মহাকাশযানটি দূরবর্তী সৌরজগতের অন্বেষণ চালিয়ে কুইপার বেল্টের দিকে এগিয়ে যায় এবং অসংখ্য ছবি ও  বিস্তারিত বর্ণনা পাঠায়।

পর্যবেক্ষকগণ বলেছেন, “প্লুটোকে রংধনু রঙে দেখানো হয়েছে গ্রহের বিভিন্ন অঞ্চলকে আলাদা করে ব্যাখ্যার প্রয়োজনে। গ্রহের বাম দিকটি বেশিরভাগই বেগুনি-নীল-সবুজ, ডান দিকটি শীর্ষে উজ্জ্বল হলুদ-সবুজ থেকে নীচের দিকে লাল কমলা রঙের হয়ে গিয়েছে।”

নাসার ব্লগ অনুযায়ী, “প্লুটো একটি বামন গ্রহ যা কুইপার বেল্টে অবস্থিত। প্লুটো খুব ছোটো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থের অর্ধেকও নয় এবং এর বৃহত্তম উপগ্রহ চ্যারন প্লুটোর আকারের প্রায় অর্ধেক।”

‘রংধনু গ্রহ’ দেখে স্বাভাবিকভাবেই বিস্মিত মানুষ। তাই ঝড়ের বেগে শেয়ার হয়েছে নাসার এই পোস্ট। কয়েক ঘণ্টায় সাড়ে ৭ লাখ মানুষ ‘লাইক’ করেছেন রংধনু প্লুটোকে। এই তথ্যটিই ম্যারিকে আকর্ষণ করেছে সবচেয়ে বেশি। তিনি অনুভব করেন. মাটির পৃথিবী বা শূন্যের মহাকাশে রঙধনু-সদৃশ্য কিছুর সন্ধান পেলে মানুষ প্রচণ্ড আগ্রহ বোধ করে।

মানুষের আগ্রহ বড় অদ্ভুত। অজানাকে জানার আগ্রহের পাশাপাশি জানা বিষয়কেও নতুন করে জানার তৃষ্ণা মানুষের চিরকালের। আশেপাশে প্রতিদিন দেখা হয় এমন বহু কিছুর বিস্তারিত তথ্য মানুষ জানে না। কখনো সেসব জানা হলে বিস্ময়ের রেশ আর কাটতে চায় না। বাগানে হাঁটতে হাঁতে ম্যারিকেও একদিন প্রচণ্ডভাবে বিস্ময়াবিষ্ট করেছিল পল্লবী। একটি ছোট্ট চারাগাছের কাছে থমকে পল্লবী বলেছিল,

“এই গাছটিকে আমাদের দেশে বলা হয় কাঞ্চন। তুমি জানতে যে কাঞ্চনফুলের গন্ধ আছে?”

হেসে উত্তর দেয় ম্যারি,

“গাছগুলো আমার ও ক্যাভিনের হাতে রোপিত। ক্যাভিন খুঁজে খুঁজে বিচিত্র গাছ এনে লাগিয়েছে বাগানে। গাছটির কাছে এলে হালকা একটি গন্ধ পাই। এর বেশি জানা নেই আমার।”

“তাহলে শোন। শুধুমাত্র রানি কালারের তোমাদের বাগানের রেয়ার এই কাঞ্চনেই একটা মৃদু গন্ধ পাওয়া যায়। সাদা কাঞ্চনে কোনও গন্ধ নেই। অথচ বেশির ভাগ সাদা ফুলেই মিষ্টি গন্ধ থাকে। যেমন, বেল, জুঁই, গন্ধরাজ, গুলঞ্চ, শিউলি। কাঞ্চন ব্যতিক্রম। সাদা হয়েও গন্ধহীন আর রঙিন হলে সৌরভময়।”

“কাঞ্চন তাহলে সবার চেয়ে আলাদা। তাই না! কারণ সাদা কাঞ্চনের গন্ধ নেই। কিন্তু রঙিনের গন্ধ আছে।”

“নিজেই পরখ করে দেখ না।”

পল্লবীর কথায় ফুলে ফুলে ঢেকে থাকা গাছটার একটা ডাল নুইয়ে ধরেন ম্যারি। তিনি সেই ফুলের গন্ধ নেওয়ার আগে একবার পল্লবীর দিকে তাকান। মুখে কিছু বলেন না। তার প্রয়োজনও নেই। তবে একটা দুটো ফুলে নাক ডুবিয়ে বুঝতে পারেন গন্ধ একটা আছে। ম্যারি বলেন,

 “খুবই হালকা একটা গন্ধ। তবে গন্ধটা কিন্তু খুব চেনা।”

রহস্যময় চোখে ম্যারিকে দেখে পল্লবী অকপটে বলে,

“পুরুষমানুষের বুকে এই গন্ধটা পাওয়া স্বাভাবিক।”

চমকে উঠেন ম্যারি। অবাক গলায় বলেন,

“তুমি এই বয়সে এতো কিছু জানো?”

“সিরিয়াসলি বলছি, জানি! একটুও ঠাট্টা করছি না। তবে জানাটা প্র্যাকটিক্যাল নয়, থিওরিটিক্যাল। তোমার সঙ্গে আমিও একমত, এই গন্ধটা খুব চেনা। আসলে একটা পারফিউমের সঙ্গে মেলে। সেটা কোনও পুরুষের গায়েই পাওয়া সম্ভব। গন্ধটা একটা মেল পারফিউমের খুব কাছাকাছি। আমি বিজ্ঞাপনের লেখা পড়ে জেনেছি।”

ম্যারি এবার বেশ আশ্বস্ত কণ্ঠে বলেন, “তাই বলো। অন্তত আমার এখন সে রকমই মনে হয়। খুব পপুলার একটা ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ড আছে, কঠিন ফরাসি নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। বিশ্বের সর্বত্র পাওয়া যায়। এই কাঞ্চনের গন্ধটা তার খুব কাছাকাছি।”

ফুল ও গন্ধ নিয়ে আর কথা হয় নি পল্লবীর সঙ্গে। সন্ধ্যা নামতেই চা খেয়ে বিদায় নিয়েছে মেয়েটি। পল্লবী চলে যাওয়ার পর ম্যারি অনুভব করেন, শীত এখনও পুরোপুরি পড়েনি, আসি আসি করছে। বাতাসে হালকা শিরশিরে ছোঁয়া। করোনাকালে আত্মগোপন করে থাকা ক্যাম্পাস শহরটা যেন একটু একটু করে আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করেছে। পাশের লন আর ছোট্ট সরোবর নামের জলাভূমি সংলগ্ন জায়গায় হাল্কা খেলাধুলায় মগ্ন লোকজন। বয়সীরা রঙিন জামা-কাপড়ে সান্ধ্য ভ্রমণে বের হতে শুরু করেছেন। পাখিদের কোলাহল দিনে দিনে কমছে। কদিন বাদে বরফের দিন শুরু হবে। প্রকৃতির পালাবদলে মানুষ ও পাখি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। শীতার্ত প্রকৃতির আবাহনে সব কিছু নিশ্চুপ ও স্তিমিত হতে চলেছে।

শীতের টান কিংবা ক্লান্তির কারণে ম্যারি অন্যরকম একটা অনুভূতি টের পেলেন। শীতের প্রকৃতিতে একটা নির্জনতা আছে, রঙের বৈচিত্র্য আছে, থমকে থাকা ভাব আছে। শীতের কি আলাদা কোনো গন্ধ আছে? নিশ্চয় থাকবে। প্রকৃতির প্রতিটি অধ্যায়ই আলাদা ও বৈচিত্রময়। রূপে, রসে, গন্ধে ভিন্নতর। প্রকৃতির প্রভাব মানুষের শরীর ও মনের পাশাপাশি চেতনার অন্তর্মূলেও প্রভাব বিস্তার করে আনন্দ, বেদনা, হর্ষ ও উল্লাসে।

এই শীতে তিনি কোন অনুভূতিকে আঁকড়ে ধরবেন? কোন গন্ধ টেনে নেবেন হৃদয়ের মর্মমূলে? বাইরের হাল্কা কুয়াশায় মোড়ানো সন্ধ্যা-রাতের অস্তিত্ব ছুঁয়ে তাঁর খুবই ইচ্ছে করছে বাগানে কাঞ্চন গাছের কাছে চলে যেতে। বুক ভরে কাঞ্চন ফুলের মৃদ্যু গন্ধ নিতে। সেই গন্ধে কী ক্যাভিনের বুকে লুকানো গন্ধের রেশ থাকবে? যা তিনি বছরের পর বছর বহন করে চলেছেন।

অসমাপ্ত বাক্যের শেষে তিনবিন্দু যতিচিহ্নের মতো একটা উপসংহারহীন অলস মেদুরতা চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে ম্যারিকে। তাঁর মনে হচ্ছে, তিনি যেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি দিচ্ছেন সর্বনাশের উপকূল।

[পরবর্তী কিস্তি আগামী শুক্রবার]

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-১৩

এ সম্পর্কিত আরও খবর