ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-১৩

  • মাহফুজ পারভেজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

[ত্রয়োদশ কিস্তি]

এগজ়িবিশনের যাবতীয় হিসাবপত্র নিয়ে বসেছে টমাস আর পল্লবী। দুই-চারদিনের মধ্যেই সব টাকা একসঙ্গে করে ম্যারির নির্দেশ মতো শরণার্থী শিবিরের শিশুদের কাছে ত্রাণ নিয়ে চলে যাবে ওরা। এসব নিয়ে দুজনের ব্যস্ততার শেষ নেই। ম্যারি অলক্ষ্যে দেখেন সবকিছু। মনে মনে একটা সাহস অনুভব করেন তিনি। উদ্যোগী ও আবেগময় তরুণ-তরুণী যেন তাঁকে নিঃসঙ্গতার গর্ত থেকে টেনে এনেছে নবজীবনের উঠানে।

বিজ্ঞাপন

টাকার হিসাবের বিষয়গুলো ম্যারি এড়িয়ে যান। বার বার ডাকলেও টমাস কিংবা পল্লবীর সঙ্গে এসব নিয়ে আলাপ করতে চান না তিনি। ম্যারির সাফ কথা, “আমি আঁকাআঁকি করবো আর তোমরা হিসাবপত্র ও ম্যানেজমেন্ট সামলাবে। আমি সব করতে গেলে কোনো কিছুই ভালোভাবে করতে পারবো না।”

ম্যারি আর্ট ভিলেজের পরিকল্পনার কথাগুলোও বিস্তারিতভাবে তাঁর একান্ত আপন দুজনকে বলেছেন। পল্লবীর তো উৎসাহের অন্তঃ নেই। ম্যারির প্ল্যান শুনেই সে বলেছে,

বিজ্ঞাপন

“চলো তাহলে তিনজনে একটা ট্রাস্ট করে ফেলি। আমরা তিনজন ডাইরেক্টর।”

টমাস সব শুনে পল্লবীকে বলে,

“আমিও থাকবো। কিন্তু ফুলটাইম না। মায়ের সাথে তোমাকে বেশি সময় থাকতে হবে। আমি যতটা পারি থাকবো। তবে আমার জন্য কাজ আটকে থাকবে না। তোমাদের সব কাজে আমার পূর্ণ সম্মতি থাকবে।”

ম্যারি টের পান এগজ়িবিশনের মাধ্যমে একটি বড় কাজের সূচনা হয়েছে। তিনি ক্রমে ক্রমে একটি আর্ট ভিলেজ গড়ে তুলবেন। যেখানে দেশ-বিদেশির ছেলেমেয়েরা শিল্পকলার নানা ক্ষেত্রে হাতেকলমে ট্রেনিং নেবে। বিশ্বের নানা প্রান্তের শিল্পকৌশল ও শিল্পশৈল্পী তাঁর আর্ট ভিলেজে একাকার হয়ে সৃষ্টি করবে নন্দনের নতুন বিন্যাস।

ভাবনাগুলো মাথায় নিয়ে তিনি এক কাপ চা হাতে বাগানে চলে আসেন। তারপর পাইন গাছের নিচে প্রিয় ও পুরনো জায়গায় স্থির হয়ে বসেন। নানা কাজের চাপে পাইনের কাছে আসা হয় নি কয়েক দিন। ম্যারির মনে হলো পাইন যেন বিষণ্ন মুখে তাঁরই দিকে তাকিয়ে আছে। যেন বলছে, তোমার আর্ট ভিলেজে আমাকেও রাখছো না কেন? ম্যারি আলতো হাতে গাছের শরীরে নিজের স্পর্শ ছড়িয়ে দেন। এমন করে ক্যাভিনও গাছটিকে আদর করতো।

“তুমি এখানে আর আমরা সারা বাড়ি খুঁজে হয়রান!”

কথাটা বলতে বলতে পল্লবী এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। পিছু পিছু আসছে টমাসও। ম্যারি হাসিমুখে বলেন,

“তোমরা কাজ করছো দেখে বিরক্ত করি নি। এখানে বসে একটু ভাবছি। এবার বলো, আমাকে খুঁজছো কেন?”

পল্লবী বললো, “তুমি জানো ট্যাগ কাকে বলে?”

“নিশ্চয় জানি, কোনও লেখা বা ছবি কাউকে এড করলে ট্যাগ বলে। কিন্তু হঠাৎ ট্যাগ কেন?”

“তুমি ট্যাগ-এর একটা অর্থ জানো। এর আরো অর্থ আছে। তোমার ক্ষেত্রে ট্যাগ-এর দুটো অর্থই চমৎকারভাবে কাজ করেছে।”

“তার মানে কি? খুলে বলো প্লিজ।”

এবার কিছু বলার জন্য সামনে এগিয়ে আসে টমাস।

“একটা ট্যাগ হলো জুড়ে দেওয়া, তুমি ঠিকই বলেছো। বাবার কোনো ফেসবুক আইডি নেই। তবু তার নাম করে তোমার এগজ়িবিশনের খবর তাঁকে ট্যাগ করেছিলাম। কোনোভাবে সেটা তাঁর কাছে পৌঁছেছে। তিনি একটি বিস্তারিত মতামত পাঠিয়েছেন। সময় করে পড়ে দেখো। তোমার ভালো লাগবে।”

বাচ্চাদের সামনে স্থির থাকলেও ম্যারির ভেতরে তখন অথৈ ঢেউ। ক্যাভিন অবশেষে জেনে গেছে তাঁর শিল্পচর্চায় ফিরে আসার কথা। কি বলেছে ক্যাভিন, জানতে তীব্র আকুলতা তৈরি হয়েছে তাঁর মধ্যে।

এরই মাঝে দ্বিতীয় ট্যাগ নিয়ে মুখ খুললো পল্লবী,

“ আরেকটি ট্যাগ হলো, ছবি বিক্রি হলেই সেই ছবির গায়ে ট্যাগ পড়ে যায়। তোমার সব ক’টা ছবিতে ট্যাগ পড়ে গেছে, জানো!”

পল্লবী আর টমাস দু’হাতে আকাশ মাপার ভঙ্গিতে টাকার মাপ বোঝাতে চায়। বলে, “অনেক... অনেক টাকা...তোমার সব পরিকল্পনা এবার সফল হবে…”। কিন্তু কথাগুলো শেষ করতে পারে না ওরা। চিৎকার করে ওঠে, “ওই দ্যাখো! রেনবো... না কী? এটাই রেনবো।”

ম্যারি খেয়াল করেন, কিছুক্ষণ আগে আশেপাশে একপশলা বৃষ্টি হয়েছিল। বাতাসে এখনো ভেজা আমেজ। তিনি টমাস ও পল্লবীর দৃষ্টি অনুসরণ করে রংধনুটা দেখলেন। দেখে তিনি বিস্ময়ে নির্বাক। অবাক হয়ে ম্যারি দেখলেন, রংধনুটা শুরু হয়েছে তাঁদের বাড়ির ঠিক সামনের রাস্তা থেকে। তারপর লাফ মেরে ঊর্ধ্বপানে উঠে নীল আকাশের গা বেয়ে বহু দূর ছুটে ধনুকের মতো বেঁকে নেমে গিয়েছে, দিগন্তে ঝাঁপ দেবে বলে। ঠিক যেমনটা পল্লবী এঁকেছিল।

রংধনুও সম্ভবত মানুষের মনোভাব টের পায়। নিয়ম ভেঙে অন্যরকম অবয়বে সামনে এসে হাজির হয়। ম্যারি স্মিতহাস্যে পল্লবীর দিকে তাকান। পল্লবীও অপলক চোখে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। টমাস রংধনুতে বিভোর। রংধনুর আরেক প্রান্ত কি এমন কোনো জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে, যেখানে ক্যাভিন আছে। আর তাদের মতো অপার আগ্রহে রংধনু দেখছে?

ম্যারি ভাগ্যচক্র কিংবা মহাজাগতিক রহস্য খুব একটা বোঝেন না। ক্যাভিন বিষয়গুলো খুব ভালো বুঝতে পারতো। ম্যারির মনে হয়, এরকম একটা অদ্ভুত রংধনুর সামনে ক্যাভিনের হাত ধরে বসে থেকে একটি আস্ত জীবন কাটিয়ে দেওয়াও তার জন্য সম্ভব ছিল। তেমন একটি অনুভূতির অপেক্ষায় থেকে থেকে বাকি জীবনটাও কাটিয়ে দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব হবে না।

রংধনুর রঙগুলো চোখে মেখে ম্যারি আবিষ্ট পদক্ষেপে ঘরে চলে আসেন। টমাস আর পল্লবী চেয়ে চেয়ে তার চলে আসা দেখে, কোনো কথা বলে না। বয়স অল্প হলেও তারা বুঝে, এখন ম্যারির চুপচাপ ও একা থাকার সময়। কথা বলে তাকে বিরক্ত করার পরিস্থিতি এটা নয়।

ঘরে এসে ম্যারি স্থির থাকতে পারেন না। অস্থির হয়ে বাথরুমে চলে আসেন। দরজা বন্ধ করে বেসিনের কল খুলে দেন। জলের ঝাপ্টায় নিজেকে শীতল করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু তার ভেতরের অস্থির উষ্ণতা কিছুতেই কমতে চায় না। লুকিং গ্লাসের দিকে তাকিয়ে তিনি অপেক্ষা করেন, কখন বর্ষার অবিরাম বৃষ্টির মতো তার চোখ বেয়ে কান্নারা নেমে আসবে। শীতল কান্নার প্রলেপে আপাদমস্তক স্নিগ্ধ হতে ব্যাকুল প্রতীক্ষায় তিনি অপেক্ষা করতেই থাকেন।

[পরবর্তী কিস্তি আগামী শুক্রবার]

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-১২