বাংলাদেশের প্রখ্যাত গল্পকার ও কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। একবারেই সাদাসিধে ও সরল জীবনের অধিকারী এই কথা সাহিত্যিক পাঠককে দেখিয়েছেন রঙিন জগৎ এবং পাঠকের মনে জাগিয়ে তুলেছেন রঙিন স্বপ্ন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যে তিনি একটি স্বতন্ত্র নাম, একটি মূল্যবান পরশ পাথর। এই পরশ পাথরে আলোকিত আমাদের সাহিত্য অঙ্গন। তার নামটি শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয় পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের পাশাপাশি অন্য ভাষার অগণিত পাঠকের কাছে।
শুক্রবার (১৬ জুন) সন্ধ্যায় এই সাহিত্যমনীষীর ৭৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে আয়োজন করে সেলিনা হোসেনের সৃষ্টিকর্ম শীর্ষক উন্মুক্ত আলোচনা সভা। সভায় সেলিনা হোসেনকে নিয়ে এসব কথা বলেন আলোচকরা।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কবি কামাল চৌধুরী।
এতে আরও উপস্থিত ছিলেন কবি আজিজুর রহমান আজিজ, কবি গীতিকার নাছিমা বেগম, কবি শ্যাম সুন্দর শিকদার, বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম, বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদের কিশোরগঞ্জের আহ্বায়ক শাহ ইস্কান্দার আলী স্বপনসহ অন্যরা।
অনুভূতি প্রকাশ করেন সেলিনা হোসেনের উপন্যাসের উপর নির্মিত ‘যাপিত জীবন’ চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী আশনা হাবীব ভাবনা।
স্বাগত বক্তব্য দেন বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক। প্রবন্ধ উপস্থাপন করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নাসরীন জেবীন হক।
লেখকরা সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ নয়, তাদের প্রতি সমাজের দাবি আছে এমন মন্তব্য করে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি কামাল চৌধুরী বলেন, সেলিনা হোসেনের লেখা পড়লে মনে হয় তার লেখা বিষয়-বৈচিত্র্যে অনন্য। তার লেখায় উঠে এসেছে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সুখ-দুঃখ, ক্ষোভ, অভিযোগ ও মানবিকতা। তিনি তার সমকালে বাংলাভাষাভাষি লেখকদের মধ্যে অনন্য একজন। যার লেখার শেকড় গভীর থেকে গভীরে। কথাসাহিত্যে সেই শেকড় প্রোথিত করা সহজ। ছড়ানো-ছিটানো বর্ণনা, অসংখ্য চরিত্র মিলে এই ক্যানভাস হয়ে ওঠে অনেক বড়। যা কবিতায় সহজ নয়। এটা আমাদের কাছে গৌরবের। তার সৃষ্টিশীলতা আরো বহু বছর বেচে থাকুক।
নূরুল হুদা বলেন, সেলিনা হোসেন সৃষ্টিশীলতায় অনন্তকাল জড়িয়ে থাকুন। সে সৃষ্টিশীলতায় তাকে এক ধরনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তিনি সমসাময়িক কথাসাহিত্য চর্চা করছেন যা অনেক তাৎপর্যময়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধারণ করেন আছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
লেখালেখি শুরুর গল্প তুলে ধরে সেলিনা হোসেন বলেন, আমার প্রথম বই ‘উৎস থেকে নিরন্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। বইটি প্রকাশের ক্ষেত্রে আমার শিক্ষক অধ্যাপক আব্দুল হাফিজ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন এই বলে, তুমি যখন এম এ পাশ করেছো, একটা চাকরি করতে হবে। আর একটা চাকরির জন্য নানান জায়গায় ইন্টারভিউ দিতে হবে। তোমার সিভিতে যদি একটি বই থাকে, তাহলে অন্যদের চাইতে তুমি একটু আলাদা মাত্রা পাবে। তুমি একটি বই প্রকাশ করো। বলা যেতে পারে। সাহিত্যের জায়গা থেকে নয়, একটি চাকরি পাওয়ার জায়গা থেকে আমার প্রথম বই বের হয়।
তিনি বলেন, আমার বয়স এখন পঁচাত্তর বছর। আমি যদি আর কিছু দিন সুস্থ থাকি, তাহলে আরো কিছু লেখা লিখব অবশ্যই। চাওয়া-পাওয়াতো প্রতিটি মানুষের মাঝে কাজ করে। লেখকের এটাতো থাকবেই। সুস্থ থাকাটাই আমার কাছে এখন বড় কিছু। সুস্থ থাকলে অনেক না লেখাগুলো লিখে যেতে পারব।
সেলিনা হোসেনের ‘যাপিত জীবন’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিতব্য সিনেমায় অভিনয় করছেন অভিনেত্রী ভাবনা। তার অনুভূতি ব্যক্ত করে তিনি বলেন, যাপিত জীবনের আঞ্জুম চরিত্রে অভিনয় করার পর আমার পরিবর্তন এসেছে। আমি কিছুটা প্রতিবাদি হয়েছি। যাপিত জীবন সিনেমা নিয়ে আমাদের পুরো টিম অনেক বেশি উত্তেজিত। সিনেমার কাজ প্রায় শেষের দিকে। এডিটের কাজ চলছে।
তিনি আরো বলেন, সেলিনা হোসেন আজকের নারীদের অনুপ্ররণার উৎস। তিনি এত সরলভাবে জীবন যাপন করেন, যা অনুকরণীয়। সেলিনা হোসেনের কাছ থেকে আমরা এক ধরনের শক্তি পাই।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, উপলব্ধি ও ইতিহাস সেলিনা হোসেনের মতো কেউ তুলে ধরেননি জানিয়ে শাহ ইস্কান্দার আলী স্বপ্ন বলেন, সেলিনা হোসেন তার লেখালেখির কোন না কোন অধ্যায় বা মন্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরেছেন। তার যাপিত জীবনের সরলতা তার লেখনিতে ফুটে উঠেছে।
এ সময় তিনি সেলিনা হোসেনের দীর্ঘ জীবন কামনা করে বলেন, আমি চাই তার হাত ধরে সাহিত্য যে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে সেটি আরও অব্যাহত থাকুক।