নজরুলকে দেখার প্রথম স্মৃতি

  • ফেরদৌস আরা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

সঙ্গীত পরিবার আমাদের। বাবা এ এইচ এম আব্দুল হাই ব্যক্তিগত জীবনে একজন প্রকৌশলী ছিলেন। পেশাগতভাবে তিনি সরকারের ক্যাডারভুক্ত একজন উচ্চতর কর্মকর্তা ছিলেন, পিডব্লিউডির চিফ ইঞ্জিনিয়ার। প্রকৌশলী হলেও সঙ্গীতের প্রতি ছিল তার অগাধ পাণ্ডিত্য। তিনি ছিলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বিশারদ। পারিবারিকভাবে বাবার এই গুণ তার সন্তানদের মাঝে বিস্তৃত হয়। আমরা চার বোন, এক ভাই। আমার বড় তিন বোন ছিলেন সঙ্গীত শিল্পী। একদিন আমিও আমার ভেতর শিল্পীসত্তার খোঁজ পাই।

যদিও নাচ ও খেলায় পারদর্শিতা ও আগ্রহ ছিল অপরিসীম। বাবার সূত্রে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রতি একটা টান থাকলেও, নিয়মিত চর্চার ভেতর অবস্থান করতে হলেও একটা সময়ে অনুভব করলাম, আমার হৃদয়জুড়ে অবস্থান করছে নজরুল সঙ্গীত এবং কবির বাণী। কবির শব্দ চয়ন, ব্যবহার, প্রকাশ ও গভীরতা আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। এ এক অধ্যাত্মিক গতিময় শক্তি এবং অবিশ্বাস্য জীবনবোধ, যা আমার ভেতর চিরস্থায়ীভাবে আসন গ্রহণ করেছে। এটাই যেন আমার সুনিশ্চিত শেষ ঠিকানা। সেই আমলে নারীর প্রতি, জীবনের প্রতি কবি কাজী নজরুল ইসলামের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা ছিল এক অভাবনীয় বিষয়। বিশেষ করে নারীর অধিকার নিয়ে তিনি তার ভাবনা-চিন্তা তার লেখনীতে যেসময়ে যেভাবে প্রকাশ করে গেছেন, তার প্রয়োজনীয়তা সাম্প্রতিক বিশ্বে রয়ে গেছে । এখনও যেন এমন এক ব্যক্তিত্বেরই প্রয়োজন। 

বিজ্ঞাপন

আজ অব্দি নারীর অধিকার নিয়ে যে সব কথা বা বক্তব্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উত্থাপিত হয়েছে বা হচ্ছে, তা যেন নজরুলের কথারই প্রতিফলন। ঠিক তেমনি তার যে গভীর দেশাত্মবোধ সেটাও তিনি তাঁর জীবনাচারণে ও লেখনীতে প্রকাশ করে গেছেন। বিদ্রোহী কবিতা সেই স্বাক্ষর রেখেছে। মানব-মানবীর সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তার মর্যাদাবোধ, সহানুভূতি ও মমতা ছিল বিরল। হৃদয় যেন তাঁর আপনগতিতে কবির দিকেই ধাবিত হয়। এভাবে ধীরে ধীরে আমি যেন কবির উপকূলে ঠাঁই পেলাম, ঠাঁই নিলাম। নজরুল সংগীতের প্রতিটি শব্দ, তাল, লয় , সুর যেন জীবন হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। দিন যতই যেতে লাগলো, ততই যেন আমি কবির একনিষ্ঠ অনুরাগী হয়ে উঠলাম।

অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে কবি

বিজ্ঞাপন

বিশ্বশান্তি, মানবতা, মানবমর্যাদা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে সকল ভাবনা ও প্রচারণা জরুরি ছিল, কবি তাঁর সৃষ্টিকর্মে তা প্রকাশ করে গেছেন অবলীলায় ও সহজ ভাষায় এবং সেটা বিভিন্ন আঙ্গিকে। তাঁর জীবনাচারণ ছিল অন্যায়ের প্রতিবাদে ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় একনিষ্ঠ। অবহেলিত, নিগৃহীতদের জন্য তিনি ছিলেন পরম দরদী। বৈষম্য, শোষণের বিরোধিতা করে গেছেন তিনি আমৃত্যু। প্রকৃতির প্রতিও তিনি অসীম ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর সৃষ্টিকর্মে।

তিনি ছিলেন তারুণ্যের কবি। তরুণদের পথ দেখিয়েছেন, সাহসী করে গেছেন। জীবন দর্শনের কৌশল শিখিয়ে গেছেন। তাঁর এই বোধ আমার ভেতর সঞ্চারিত হয় আপন গতিতে। আমি তরুণদের নিয়ে কাজ করছি। সুরসপ্তক সঙ্গীত একাডেমি আমার, যেখানে শিশু, কিশোর, তরুণ ও পরিণত বয়সের সকলেই কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন দর্শন, আদর্শে সম্পৃক্ত হবার সুযোগ পাচ্ছে। সঙ্গীত সাধনা করবার সুযোগ পাচ্ছে। শুধু সুরসপ্তক সঙ্গীত একাডেমি নয়, দেশ ও জাতির প্রতি যে দায় ও দায়িত্ব কবির ছিল, আমি চেষ্টা করছি সেসব অনুসরণ করতে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমি কবির দর্শন ও আদর্শের ব্যাপ্তি ঘটাতে চেষ্টা করছি। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে আমি তাঁকে পৌঁছে দেবার ব্রতে নিয়োজিত হয়েছি। এ আমার অসীম অকৃত্রিম সাধনা।

নজরুলকে দেখার প্রথম স্মৃতি

তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। বাবা আব্দুল হাইয়ের ছিল নজরুল সঙ্গীতের প্রতি দারুণ ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। খুব ভালোবাসতেন তিনি কবি ও তাঁর সৃষ্টিকে। বাবা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বিশারদ হওয়ায় বেশ ভালো বুঝতেন নজরুল সঙ্গীতের সুর ও আবহ। বাণী আর সুরের কারণেই কবির প্রতি বাবার দুর্বলতা এক অনন্য বৈশিষ্ট্যে রূপ নেয়। কবিভক্ত সেই বাবার হাত ধরে আমরা দুই বোন, জান্নাত আরা ও আমি কবির ধানমন্ডির বাসভবন অতি আগ্রহে ছুঁটে যাই। গিয়ে দেখি ঘরের কপাট বন্ধ।

জানানো হলো, আমাদের চিন্তার কোনো কারণ নেই; তাঁর সাথে আমাদের দেখা হবেই। ছোট্ট মনে তখন নানান মিশ্র উৎকন্ঠা, অপেক্ষা, কবিকে দেখব বলে। আর তাঁকেইবা কী বলব অথবা শুনব। শুনেছি তিনি নির্বাক কবি। একসময়ে কপাট খুলে গেলো। আমাদের ভেতরে ডাকা হলো। দেখলাম, কবি লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। কবির অভিব্যক্তি তখন বুঝা কঠিন সাধারণদের জন্য। বড় বড় নির্বাক সেই দৃষ্টি! তিনি কী যেন বলতে চান, অথচ পারছেন না বলতে। আমি তখন কিশোরী। দেখলাম, দেশের বড় বড় সঙ্গীত শিল্পীরা তাকে গান শুনিয়ে যাচ্ছেন একে একে। তার বিছানার সামনে মেঝেতে হারমোনিয়াম, তবলা সাজানো।

কবির মুখে ভাষা ছিল না, কিংবা হয়তবা ছিল যা কেবল কবিই বুঝতেন। সেই অভিব্যক্তি যেন অনেক কিছুই বুঝাতে চাইছিল। কবি পরিবার আমাদেরকে গান পরিবেশনার জন্য বললেন। আমরা গান গাইতে বসে পড়লাম। কিন্তু মনে মনে ভাবলাম, কী গানইবা গাইব, আর নির্বাক কবি কীইবা বুঝবেন। অতপর ‘নীলাম্বরী শাড়ি পরি নীল যমুনায় কে যায়’ গানটি ধরলেন জান্নাত আরা। আমি তার সহযোগি হলাম। যখন গানটির সুক্ষ্ন কারুকাজ ও সুরের মূচর্ছনা কন্ঠে নিবদ্ধ হলো, ঠিক তখনি খেয়াল করলাম কবির মনবীণার তারে সুরের ঝংকার বেঁজে উঠলো এবং সাথে সাথে শোওয়া থেকে কবি উঠে বসলেন।

দীর্ঘ সময় যাবৎ কবির ভেতরের যে অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটছিল না, এই গানটি শোনার পর তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল। তিনি বলে উঠলেন, বাহ্! কবির এই প্রকাশ ছিল আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত ও কল্পনাতীত। শঙ্কিত হয়ে আমরা রুম থেকে বের হয়ে যাই। আমাদেরকে ফেরানো হলো। বুঝানো হলো, এটা কবির সুখ ও আনন্দ প্রকাশ। আমাদেরকে আবার ডাকা গাল গান সম্পূর্ণ পরিবেশনার জন্য। আমরা পুরো গান গাইলাম। কবির এই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ বলে দেয়, আপাততভাবে তাঁকে নির্বাক মনে হলেও, আদতে তিনি যেন তা নন। সঙ্গীতের প্রতি ছিল তাঁর অসীম তেজময়ী এক উপলদ্ধি।

লেখক: বিশিষ্ট নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ও প্রতিষ্ঠাতা, সুরসপ্তক সঙ্গীত একাডেমি।