মানুষকে 'বীর' সম্বোধন করেছিলেন তিনি। 'শির উন্নত' করার মন্ত্র শুনিয়ে ছিলেন। গেয়েছিলেন ভ্রাতৃত্ব ও মানবতার জয়গান। সাম্যের জয়গানে মুখরিত ছিল তাঁর জীবন ও কর্ম। মানুষের চেয়ে বড় কিছু ছিলনা তাঁর কাছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী ছিলেন তিনি। ছিলেন মানুষ ও মানবতার চির সারথি। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভা, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
নজরুলের কলমে অনবদ্য 'বিদ্রোহী' কবিতা প্রকাশিত হওয়া মাত্রই ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি ও রচয়িতা কবি নজরুল 'চির উন্নত শির' রূপে বিরাজমান। সমগ্র বাংলা ভাষা বলয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এমন শাণিত প্রতিবাদ তুলনাহীন।
জীবনের মাত্র সামান্য সময়কাল নজরুল সজিব ও সচল ছিলেন। দীর্ঘকাল তিনি ছিলেন নিশ্চুপ। অত্যল্প সময়ে তিনি যে বিপুল রচনা ভাণ্ডার উপহার দিয়েছেন, তা অভাবণীয় ও বিস্ময়কর। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসেও নজরুলের মতো এমন বহুমাত্রিক-সৃজন প্রতিভা বিরল।
নজরুলের বৈচিত্র্যময় গানগুলো কথা, সুর ও শৈলীতে ভরপুর। তাঁর কবিতা উজ্জীবনের মন্ত্রমুগ্ধ আবেগে ঋদ্ধ। গল্প, উপন্যাস, নাটক ও অন্যান্য রচনায় তিনি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে দীপ্তিমান। তাঁর রচনা জাতিসত্তার চৈতন্যোদয়ের প্রতীক। তিনি সতত 'চির উন্নত শির'।
অন্যায়, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনা ও পরাধীনতার জিঞ্জির ছিন্নকারী ধূমকেতু তিনি। বাংলাদেশ ও বিশ্বের মানবমুক্তির চিরন্তনী ধ্বনিপুঞ্জে সঞ্জীবিত নজরুল এক আলোকিত অনুপ্রেরণাস্থলের নাম।
জগতের বঞ্চিত, ভাগ্য বিড়ম্বিত, স্বাধীনতাহীন বন্দিদের জাগ্রত করার মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন নজরুল। বলেছিলেন, 'জাগো অনশন-বন্দি, ওঠ রে যত জগতের বঞ্চিত ভাগ্যহত'।
১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অবিভক্ত বৃটিশ-বাংলার সর্বপশ্চিম প্রান্তের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় জন্ম নেন কাজী নজরুল ইসলাম আর ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। সমগ্র বাংলাদেশের এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষীদের শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়, যেমনটি তিনি নিজেই বলেছিলেন, 'মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই।'
শতবর্ষ পেরিয়ে আসা কবি কাজী নজরুল ইসলামের চৈতন্য প্রসারিত গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক তথা সুবিশাল সাহিত্যকর্ম বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়, নানা কারণে তাৎপর্যবাহী। কারণ, করোনার প্রখর প্রতাপে ত্রস্ত পৃথিবীতে থেমে নেই অন্যায়, অবিচার। ফিলিস্তিন থেকে মায়ানমার পর্যন্ত পৃথিবীময় শোষণ, নির্যাতন, হত্যা, রক্তপাতে ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত করোনা-বিপর্যস্ত পৃথিবী আর মানুষ এখন অবর্ণনীয় দুর্দশা ও দুর্বিপাকে বিপন্ন। এমতাবস্থায় অনাচারের বিরুদ্ধে চিরবিদ্রোহী নজরুলের মানব অধিকারের রণহুঙ্কার বড়ই প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মহীরুহ-তুল্য কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। প্রেম, বিদ্রোহ, মুক্তি ও মানবতার এই মহান সাধকের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ শুক্রবার ১২ ভাদ্র মোতাবেক ২৭ আগস্ট। ১৯৭৬ সালের এদিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (তৎকালীন পিজি হাসপাতাল) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
জাতীয় কবিকে মৃত্যুবার্ষিকীকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে সমগ্র বাঙালি জাতি।