আদি ও অকৃত্রিম ভারতবর্ষের বাণী বহন করে যে মহান পুরুষ ঊনবিংশ শতাব্দিতে এই বাংলায় জন্মছিলেন, কিন্তু তিনি কেবল বাংলার বা ভারতবর্ষেরই ছিলেন না। আজন্ম আধ্যাত্ম চেতনায় ঋদ্ধ এই মহাপুরুষ নবজাগরণের যে অবিনাশী মন্ত্র উচ্চারণ করেন তা গোটা বিশ্বকেই প্লাবিত করেছিল। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বাধা-ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়ে তিনি প্রবল পরাক্রমে প্রগতি, আত্মশুদ্ধি ও আত্মশক্তির যে উদ্বোধন ঘোষণা করেছিলেন, সমকালেও তার ঢেউ আছড়ে পড়ছে। কথা বলছি মহামতি স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে, যাঁর বাণীমন্ত্রে -পবিত্র বিভূতিতে আমরা আজও সমাচ্ছন্ন।
১২ জানুয়ারি ১৮৬৩ সালে উত্তর কলকাতার ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় স্ট্রিটে সম্ভ্রান্ত এক কায়স্থ পরিবারে জন্মেছিলেন নরেন দত্ত, যিনি পরবর্তীতে তাঁর নিরন্তর সাধনায় গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আশীর্বাদে স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে উঠেছিলেন। মাত্র ৩৯ বছর ৫ মাস ২৩দিনের পার্থিব জীবনে বহু জীবনের কাজ যে কাজ তিনি করে গিয়েছেন তার সামান্য বিবরণ তুলে ধরতে আমাদের কোন প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়। এই মহাজীবন নিয়ে মূল্যায়নের সামান্য যোগ্যতাও যেমন আমাদের নেই, তেমনি তাঁর পরিধিবহুল জীবনের বিস্তৃত আখ্যান মেলে ধরাও রীতিমতো দুঃসাধ্য কাজ। কিন্তু চিরকালের জাগ্রত তারুণ্যের জন্য একজন স্বামী বিবেকানন্দ যে পথনির্দেশ রেখে গেছেন, সমস্যাসঙ্কুল সমাকালে দাঁড়িয়ে আমাদের তরুণপ্রাণের পুনর্জাগরণের জন্য হলেও স্বামীজীকে নিয়ে যে কোন পরিসরের আলোচনা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা জানি যে, বিবেকানন্দ বা নরেনন্দ্রনাথ দত্তের বাবা বিশ্বনাথ দত্ত খ্যাতনামা অটর্নি ছিলেন এবং তাঁর পরিবারের অপর এক খ্যাতনামা পুরুষ গোপাল চন্দ্র দত্ত সরকারি ডাক বিভাগ থেকে অবসর নিয়ে ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। শিক্ষাজীবনে নরেন্দ্রনাথ দত্তেরও ইচ্ছা ছিল বিলাতে গিয়ে ব্যারিস্টার হওয়ার। (সূত্র: স্বামী বিবেকানন্দ জীবন ও প্রসঙ্গ: সামান্য থেকে অসমান্য/ড. শ্যামপ্রসাদ বসু)
কিন্তু আশৈশব বৈদিক জীবনের প্রতি গভীর অনুরাগ নরেন্দ্রনাথের সমাজিক প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খাকে ক্রমেই গুরুত্বহীন করে তুলে। তাঁর এই গভীর অনুরাগ চূড়ান্ত পরিণতি পায় বাংলার নবজাগরণের আরেক মহান উদগাতা, যিনি ‘যত মত ততো পথ’ মতাদর্শে সর্বধর্ম সমন্বয়েরও উদারচেতা এক মহাপুরুষ সেই রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সাহচর্যে। কবি নজরুলের ভাষায় বলতে গেলে, ‘নদী তরঙ্গে যে পড়েছে ভাই দরিয়াতে সে আপনি মিশে’। রামকৃষ্ণ দেবের নিবিড় সাহচর্য ও আশীর্বাদে নরেন্দ্রনাথ দত্ত কেবল আত্মশুদ্ধির চরম ধাপেই উন্নীত হননি, সমাজের পিছিয়ে থাকা দলিত-ভাগ্যাহত মানুষদের হিতসাধনের যে মন্ত্র তাঁর গভীরে প্রোথিত হয়-তাও তিনি পরমহংসের থেকেই লাভ করেছিলেন।
১৬ আগস্ট ১৮৮৬ সালে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মহাপ্রয়াণের প্রাক্কালে নরেন্দ্রনাথ দত্তের ‘নির্বিকল্প সমাধি’ লাভের আকাঙ্খা প্রকাশের প্রেক্ষিতে তাঁর গুরু বলেছিলেন, শুধুমাত্র নিজের মুক্তি চাইলে হবে না। ভাগ্যাহত পীড়িত মানুষের জন্য তাকে কাজ করতে হবে। লোকশিক্ষার জন্য বেরিয়ে পড়তে হবে। তরুণদের নবজাগরণের মন্ত্র শেখাতে হবে।
আমরা লক্ষ্য করব, ৩৯ বছরের পার্থিব জীবনে গুরুর এই আদেশ তিনি অক্ষরে অক্ষরে শুধু পালনই করেননি, রীতিমতো বাস্তব করে তুলেছিলেন। আমরা আজ বিশ্বময় রামকৃষ্ণ মিশন, মঠ-সেবাশ্রমের মতো মানবতার দর্শন প্রচার করা যে প্রতিষ্ঠান দেখছি তা সবই রামকৃষ্ণের আকাঙ্খা আর স্বামী বিবেকানন্দের কর্মপ্রয়াসের সার্থক ফলশ্রুতি।
সন্ন্যাসী বিপ্লবী নায়ক বিবেকানন্দ আমেরিকার শিকাগো ধর্মসম্মেলনে যাওয়ার আগে স্বামী তুরীয়ানন্দকে (হরি মহারাজ) বলেছিলেন, ‘‘হরিভাই, আমি এখনও তোমাদের তথাকথিত ধর্মের কিছুই বুঝি না। কিন্তু আমার হৃদয় খুব বেড়ে গেছে এবং আমি অপরের ব্যথার ব্যাথাবোধ করতে শিখেছি। বিশ্বাস করো, আমার তীব্র দুঃখবোধ জেগেছে।’’
ড. শ্যামপ্রসাদ বসু ভাষায়, ‘শিকাগো ধর্মসভা থেকে বেলুড় মঠের সন্ধ্যারতিতেই তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন, পারতেন বৈদান্তিক তত্ত্ব প্রচার করতে। বিবেকানন্দের আন্তর্জাতিকতা বোধ গড়ে উঠেছিল জাতীয়তার সিঁড়ি বেয়ে, পরবর্তীকালে যার পূর্ণরূপ লক্ষ্য করা যায় রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর মধ্যে। রামমোহন ফরাসি বিপ্লবকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে ঝাঁসির রানির ইংরেজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধককে লক্ষ করেননি। অথচ বিবেকানন্দ ভারতীয় নারীর কাছে লক্ষ্মীবাইয়ের সাহস ও বীরত্বকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে ভুলে যাননি।’
খাঁটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মহান এই প্রচারক আত্মসমালোচনায় কতটা অকপট ছিলেন তা স্পষ্ট হবে এই উদাহরণে। ‘আমার ভারত অমর ভারত’ গ্রন্থে স্বামীজী বলছেন, ‘আমার মনে হয়, দেশের জনসাধারণকে অবহেলা করাই আমাদের প্রবল জাতীয় পাপ এবং তা-ই আমাদের অবনতির অন্যতম কারণ। ভারতের সমস্ত দুর্দশার মূল-জনসাধারণের দারিদ্র্য। পুরোহিত শক্তি ও পরাধীনতা তাদের শত শত শতাব্দী ধরে নিষ্পেষিত করেছে। অবশেষে তারা ভুলে গেছে যে, তারাও মানুষ। হিন্দু ধর্মের মতো কোনও ধর্মই এত উচ্চতানে মানবাত্মার মহিমা প্রচার করে না, আবার হিন্দুধর্ম যেমন পৈশাচিকভাবে গরীব ও পতিতের গলায় পা দেয়, জগতে আর কোন ধর্ম এরূপ করে না। পৌরহিত্যই ভারতের সর্বনাশের মূল। নিজের ভাইকে নীচে নামিয়ে কেউ কি নিজে অধঃপতন এড়িয়ে থাকতে পারে? ‘’
অপরদিকে রাজনীতির অন্দরের সমালোচনাতেও তিনি দ্বিধাগ্রস্ত নন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদন রাজনীতি বিবেকানন্দের কাছে আদৌ পছন্দের ছিল না। কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে যোগ দেওয়ার প্রাক্কালে শিক্ষাব্রতী অশ্বিনীকুমার দত্ত ১৮৯৭ সালের মে-মাসে আলমোড়ায় বিবেকানন্দের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে কংগ্রেসের প্রতি স্বামীজির আস্থা আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলে তিনি সুস্পষ্টভাবে তাঁর হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। তাছাড়া ঘুমন্ত জাতিকে জাগাবার জন্য সব দিক থেকে ঠেলা দেওয়া ভাল।’
সেই সঙ্গে তিনি অশ্বিনীকুমারকে বলেন, ‘আপনি আমাকে বলতে পারেন কংগ্রেস জনসাধারণের জন্য এ পর্যন্ত কি করেছে? আপনি কি মনে করেন গোটা কয়েক প্রস্তাব দিলেই স্বাধীনতা এসে যাবে? ওতে আমার আস্থা নেই। আগে জনসাধারণ পেট ভরে খেতে পাক, তারপরই নিজেরাই নিজেদের মুক্তির পথ খোঁজে নেবে। কংগ্রেস যদি তাদের জন্য কিছু করে তবেই কংগ্রেস আমার সহানুভূতি পাবে।’’
বিবেকানন্দ সঠিক ভাবেই চিহ্নিত করেছেন ইংরেজদের হাতে ভারতের পরাজয়ের প্রধান কারণ হল ভারতীয়দের অনৈক্য । তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেন, ‘‘ইংরেজের পক্ষে ভারত জয় করা এত সহজ হয়েছিল কেন? কারণ তারা একটি সঙ্ঘবদ্ধ জাতি ছিল, আর আমরা তা ছিলাম না। তোমাদের জাতির মধ্যে অর্গানাইজেশন শক্তির একেবারেই অভাব। ঐ এক অভাবই সকল অনর্থের কারণ। পাঁচজনে মিলে একটা কাজ করতে একেবারেই নারাজ।’
শিকাগো ধর্মসভায় যোগ দিতে গিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের যে নির্যাস তিনি সঞ্চয় করেছিলেন, সেই সব ইতিবাচক ধারণা তিনি নিজের দেশের কাজে লাগাতে ব্যাকুল ছিলেন। তাঁর ভাষায়, ‘পাশ্চাত্যের দেশের সমাজে যথেষ্ট স্বাধীনতা, ধর্মে কিছুমাত্র নেই।’
‘‘উন্নতির জন্য প্রথম চাই স্বাধীনতা। তোমাদের পূর্বপুরুষরা আত্মার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন তাই ধর্মের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ও বিকাশ হয়েছে। ধর্মকে সমাজিক কাজে যেভাবে লাগানো উচিত ছিল তা হয়নি বলেই সমাজের এই অবস্থা। আমি প্রাচীন শাস্ত্র থেকে এর প্রত্যেকটি কথা প্রমাণ করতে প্রস্তুত।’’ (ক্রমশ:..)
লেখক: ইতিহাস গবেষক ও পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম