শিল্পী ধ্রুব এষ-এর নতুন উপন্যাস 'শঙ্খনীল দাশ স্মরণসংখ্যা'। প্রকাশ করছে প্রকাশনা সংস্থা অস্তিত্ব।
ধ্রুব এষ নতুন এই উপন্যাসে এক রহস্যময় ঘোর লাগা নতুন গল্প ফেঁদেছেন। এই গল্পের নায়ক শঙ্খনীল দাশ। শঙ্খনীলের মৃত্যু রহস্য দিয়েই উপন্যাসের শুরু। শঙ্খনীল ঠিক কোন ধর্মের মানুষ জানা যায় না। কিন্তু শ্মশানে তার দেহ দাহ করেন তার বন্ধুরা। শ্মশান থেকে ফেরার পথে বন্ধুদের আলাপচারিতা থেকে সেই রহস্যে যেন আরও ঘোর লাগে।
ঘোর লাগা এক রহস্য উপন্যাস 'শঙ্খনীল দাশ স্মরণসংখ্যা'। এই উপন্যাসে ধ্রুব এষ এক নয়া পরাবাস্তব গল্প বলেন। সমকালীন উপন্যাসে ধ্রুব এষের গল্প ফাঁদার এই চমকটি যেন পাঠকদের জন্য এক নতুন পরিভাষা তৈরি করেছে। ধ্রুব এষ স্বল্প ভাষায় উপন্যাসে এক মায়াময় আবহ তৈরি করেন। সেই ঘোরের মধ্যে পাঠক কেবল ঘটনা পরম্পরা গিলতে থাকে। উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা এক বিচিত্র ভাষায় কথা বলে। শুনলে মনে হবে যেন এটা পুরান ঢাকাইয়া ভাষা। আদতে সেই ভঙ্গিটায়ও একটা নতুন মাত্রার কাপকায়দা আছে।
আবার পাঠকের একটু বেশি ঘোর লাগলে মনে হতে পারে এটা বুঝিবা নতুন কোনো ভাষা। যা সম্পূর্ণ ধ্রুব এষের সৃষ্ট এক নতুন সমকালীন ভাষা। সেই ভাষায় যেমন আছে কথ্যভাষার ব্যবহার, তেমনি আছে চরম রসদীপ্ত এক নতুন ভাষা। ছোট ছোট বাক্যে গল্প বলেন ধ্রুব এষ। ধ্যানস্থ পাঠক মাত্রই সেই ভাষার আদিরস বুঝতে পারবেন। পাঠকদের জন্য অল্পকথায় নতুন এই উপন্যাসের গল্পটির একটা সারচিত্র বলছি, শুনুন—
কয়েক বন্ধু মিলে 'অন্ধকার' নামে একটি ছোটকাগজ প্রকাশ করেন। 'অন্ধকার' একটি লিটলম্যাগ বা ছোটকাগজ। বিগত সাড়ে তেরো বছর ধরে ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা মিলে 'অন্ধকার' প্রকাশ করছেন। তবে ছোটকাগজটি অনিয়মিত। সাড়ে তেরো বছরে এর মাত্র আটটি সংখ্যা বের হয়েছ। ইরতিজা 'অন্ধকার'-এর সম্পাদক। ইরতিজার বউ শিরিন ও বন্ধু অনিমেষ কাগজটির সহ-সম্পাদক।
'অন্ধকার' এর নতুন সংখ্যা বের করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। নতুন সংখ্যাটি হবে 'শঙ্খনীল দাশ স্মরণসংখ্যা'। শঙ্খনীল দাশ ওদের বন্ধু। সম্প্রতি শঙ্খনীল দাশ মারা গেছেন। বন্ধুকে স্মরণ করার জন্য সবাই মিলে ঠিক করেছেন নতুন সংখ্যাটির নাম হবে 'শঙ্খনীল দাশ স্মরণসংখ্যা'। শঙ্খনীল দাশ কীভাবে মারা গেছে পুলিশ বলতে পারে না। বন্ধুরাও কেউ সঠিক বলতে পারে না। তবে তারা সন্দেহ করেন, হয়তো শঙ্খনীল সুইসাইড করেছেন। কিন্তু ওরা কেউ শঙ্খনীলের মৃত্যুর কারণ জানার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। ক্রমে শঙ্খনীল দাশের মৃত্যুরহস্যে ঘোর লাগবে পাঠকের।
কারণ শঙ্খনীল কোথায় থাকেন, কী করেন, বাড়ি কোথায়, আত্মীয়স্বজন কারা, ওরা কেউ ঠিকঠাক জানে না। ওদের লিটলম্যাগের অফিসে একদিন শঙ্খনীল দাশ এসেছিলেন। প্রথম পরিচয় থেকেই ওরা আন্দাজ করতে পেরেছিল শঙ্খ ব্যাটা নেহাত একটা গোবেচারা টাইপ কবি। কিন্তু সে কোথাও কবিতা ছাপায়নি। শঙ্খনীল বলতেন, তার কবিতা নাকি ছাপার যোগ্য না। আর তার ধারণা ছিল তার লেখা ঠিক কবিতাও হয় না। তাই সে কোথাও কবিতা ছাপায়নি।
শঙ্খনীল দাশের কবিতা ছোট ছোট। কিন্তু গুরুরহস্য ও রসে ভরপুর। দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক—
১.
ঢিল ছোঁড়ার মত দূরত্ব
তাও কেউ ঢিল ছুঁড়ছে না কেন
বুঝে গেছে সব হাইপোথিটিক্যাল...
২.
সাধুর আখড়ায় এত কনডম বিক্রি হয়
ঘুমিয়ে আছেন বলে সাধু দেখেন না
অন্তহীন এই রহস্য কাহিনী
নিদ্রাভঙ্গ হলে সাধু বিজ্ঞাপন নির্মাণ করবেন কনডমের...
'অন্ধকার' ছোটকাগজের চেম্বারে শঙ্খনীল দাশের সাথে প্রথম পরিচয় থেকেই ওরা খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠে। তারপর থেকে শঙ্খনীল দাশ এসব বন্ধুদের বাড়িতেই সুযোগমত থাকতেন। কোনোদিন অনিমেষ-সুদীপ্তার বাড়িতে। কোনোদিন ইরতিজা-শিরিনদের বাড়িতে। কোনোদিন জিকরুলদের বাড়িতে। কোনোদিন এবাদুরদের বাড়িতে। কোনো দিন উমাইরদের বাড়িতে। কোনো কোনো দিন শঙ্খনীল দাশ কাউকে কিছু না বলে রহস্যময়ভাবে কোথায় যেন হারিয়ে যেতেন। কোথায় যেতেন শঙ্খনীল দাশ
শঙ্খনীল দাশ পাড়ায় ছায়ার ঘরে থাকতেন। ছায়া কে ছায়া আট বছর ধরে পাড়ায় থাকে। কোন পাড়ায় আরিচা ঘাটের ওপারে দৌলতদিয়ার পাড়ায়। ছায়া দেখতে যেন ঠিক অনিমেষের বউ সুদীপ্তা সান্যালের ট্রু-কপি। সুদীপ্তাকে শঙ্খনীল দাশ একদিন ছায়ার কথা বলেছেন। জীবদ্দশায় সুদীপ্তার সাথেই শঙ্খনীল দাশের সবচেয়ে ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল। তুই-তোকারি সম্পর্ক ছিল তাদের। শুধু কী তুই-তোকারি নাকি অন্যরকম কোনো সম্পর্ক ছিল ওদের। অনিমেষ ও সুদীপ্তার একমাত্র ছেলে অন্তহীন আনন্দ। ডাক নাম অনি। সুদীপ্তার ছেলের নামটা শঙ্খনীল দাশ রেখেছিলেন 'অন্তহীন আনন্দ'। সুদীপ্তার পেটে এখন আরেকটা বাচ্চা।
শঙ্খনীল দাশ মারা যাওয়ার পর একে একে বন্ধুরা শঙ্খনীল দাশ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। কিন্তু কেউ তাদের শঙ্খনীল দাশ সম্পর্কে তেমন একটা তথ্য দিতে পারে না। একমাত্র ব্যতিক্রম সুদীপ্তা। শঙ্খনীল দাশের ঘটের খবর, ঘাটের খবর, ছায়ার খবর, সবই জানতো সুদীপ্তা।
সেই রহস্য জানার জন্য পড়তে হবে ধ্রুব এষের নতুন উপন্যাস 'শঙ্খনীল দাশ স্মরণসংখ্যা'। এ এক জাদুবাস্তবতায় ঘোর লাগা রহস্যময় এক জটিল উপন্যাস। অথচ খুব সহজ সরল এক নিজস্ব ভাষাশৈলীতে ধ্রুব এষ গল্পটি খুব নির্লিপ্তভাবে বলতে থাকেন। ধ্রুব এষের গল্প বলার এই কৌশলটি ভারী চমৎকার।
'শঙ্খনীল দাশ স্মরণসংখ্যা' বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী সব্যসাচী হাজরা। সব্যসাচী বইয়ের প্রচ্ছদেও এক নতুন চমক এনেছেন। বইটির প্রচ্ছদ দেখলেই এর রহস্য উন্মোচনে পাঠকদের আকৃষ্ট করবে। বইটি প্রকাশ করেছে প্রকাশনা সংস্থা অস্তিত্ব। অমর একুশে বইমেলায় অস্তিত্ব-র স্টল নম্বর ৫৫৭।
রেজা ঘটক কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা