অমর একুশে বইমেলা-২০২৪ উপলক্ষে লেখক ও গবেষক মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাকের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলি হচ্ছে- ‘৭১ কথা’, ‘রণাঙ্গন’, এবং ‘১৯৭১-বন্দিশালায় বর্বরতা’।
বইগুলি প্রকাশ করেছে অভিজাত প্রকাশনী- নালন্দা। বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলায় নালন্দা’র ১৭ নম্বর প্যাভিলিয়নে বইগুলি পাওয়া যাচ্ছে। আগ্রহীরা প্যাভিলিয়নে গিয়ে সেগুলি কিনতে পারবেন।
লেখক মানিক মোহাম্মদ একজন মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে তিনি এবার বই তিনটি লিখেছেন। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন সরকারি চাকুরে। অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পেশাগত কাজের পাশাপাশি তিনি মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর ওপর ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বই লিখেছেন।
প্রকাশিত বইগুলি সম্পর্কে জানতে চাইলে গবেষক, লেখক বইয়ের বিষয় সম্পর্কে তুলে ধরেন এভাবে-
৭১ কথা: আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কাল ছিল প্রসব বেদনার মতো। এর একদিক ছিল বেদনার অন্ধকারে আচ্ছাদিত দিগন্ত। অন্যদিক ছিল অভিপ্রেত স্বাধীন ভূমির আলোকে উদ্ভাসিত সূর্যালোক। সে নিরিখে চলছিল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, ধ্বংস ও ধর্ষণযজ্ঞ।
অন্যদিকে, চলছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দেশকে শত্রু মুক্তকরণের প্রত্যয়দীপ্ত লড়াই। সেসময় বাংলার প্রতিটি পরিবার কোনো না কোনোভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর আগ্রাসনের কোপানলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। হারিয়েছিল স্বজন, সম্ভ্রম, বাস্তুভিটা বা সহায়সম্পদ। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে আমাদের একটা প্রজন্মকে যে কতটা ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছিল, সে সম্পর্কে জানান দেওয়ার তাগিদ থেকে মুখ্যত এ বই প্রকাশের প্রয়াস।
এখানে ২১ জনের স্মৃতিকথা তুলে ধরা হয়েছে। যাঁদের কেউ কেউ হারিয়েছেন বাবাকে। কেউ কেউ প্রত্যক্ষ করেছেন বাবাসহ স্বজনদের হত্যাযজ্ঞের বীভৎস দৃশ্য। সার্বিকভাবে সবাই দেখেছেন, পাকিস্তানি হানাদার সেনা, স্থানীয় রাজাকার ও দালালদের লুটতরাজ, হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসযজ্ঞ, নিপীড়ন ও নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের নানারৈখিক অনুষঙ্গ। একইসঙ্গে দেখেছেন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াই।
রণাঙ্গন ৭১: জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির প্রত্যয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে শ্রেণিগত অবস্থান ও বয়স নির্বিশেষে অকুতোভয় মুক্তিসেনারা কতটা নেতিবাচক অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবনবাজি রেখে এ দেশটির জন্য যুদ্ধ করেছিলেন; যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি, সেই প্রজন্মের সন্তানরা তা হয়ত কল্পনাও করতে পারবেন না।
দিনের পর দিন অভুক্ত থেকে, রাতের পর রাত ঘুম ভুলে, ঝড়-বৃষ্টি-শীত উপেক্ষা করে, মৃত্যুর পরোয়া না করে, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান-দেশপ্রেমিক বীরযোদ্ধারা এ দেশকে দখলদার মুক্ত করার লক্ষ্যে নির্ভীকচিত্তে লড়াই করেছেন। আমাদের দিয়েছেন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গৌরবময় স্বদেশ। যুদ্ধদিনের সেসব কথা জানান দেওয়ার জন্যই এ বই প্রকাশের প্রয়াস। এখানে মোট ১৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার রণাঙ্গনের নানামাত্রিক দুঃসাহসিক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। বোনের কলমে তুলে ধরা হয়েছে একজন শহিদ কমান্ডারের বীরত্বগাথা।
১৯৭১-বন্দিশালায় বর্বরতা: ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ দেশ চালনার গণরায় লাভ করলে বিচলিত হয়ে পড়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। অতঃপর বাঙালিদের ক্ষমতায়ন নস্যাৎ ও জাতিগত শোষণ নিশ্চিত করতে হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীর ওপর।
অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে বাংলাকে বাঙালি শূন্য করার এক অলীক স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে তারা। একই সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলার স্বাধীনতা ঘোষিত হলে সূচিত হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম।
এরপরের ইতিহাস পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞের ইতিহাস। একইসঙ্গে সেই ইতিহাস বাঙালি জাতির লড়াই সংগ্রামের বীরত্বের ইতিহাস।
প্রকাশ থাকে যে, পেশাদার সেনাবাহিনী হয়েও পাকিস্তানি সেনারা ছিল ঔপনিবেশিক ঘরানার দাম্ভিক ও নৈতিকতাহীন নিকৃষ্ট প্রকৃতির একটি সেনাবাহিনী। বন্দিশালায় বর্বরতা মূল প্রতিপাদ্য হলেও এ বইতে হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের নানারৈখিক অনাচার তথা হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।
লেখক পরিচিতি
লেখক, গবেষক মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাকের জন্ম ১৯৬১ সালের ১ জুলাই। বেড়ে ওঠা লালমনিরহাটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে বিএসএস অনার্সসহ এমএসএস। পৈতৃক বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলায়। মা রাজিয়া সুলতানা, বাবা আব্দুল ওয়াদূদ ভূঞা। পাঁচ ভাই ও এক বোন। তাঁর স্ত্রীর নাম জেসমীন আরা। তাদের তিনটি মেয়ে- তূর্ণা, অরণ্যা ও পৌষী রাজকন্যা।
শিক্ষাজীবন শেষে বিসিএস ৮৫ ব্যাচে যোগ দিয়ে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক।
লেখার ক্ষেত্র: মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, বঙ্গবন্ধু, ভ্রমণ, প্রবন্ধ, অনুবাদ, পরিবেশ ও ছড়া-কবিতা। সম্পাদনাসহ মোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৭০।
মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ক গ্রন্থ: ‘একাত্তরের অল্পকথা’, ‘উত্তরের গণহত্যা’, ‘যুদ্ধজীবন’, ‘কথা ৭১’, ‘রেলওয়েতে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা’, ‘পাকিস্তান: পাপাচারের বিষবৃক্ষ’, ‘লালমনিরহাট জেলার মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা’, ‘৭১-এর ছেলেবেলা’, ‘সাতভাইয়ের স্বাধীনতা সংগ্রাম’, ‘৭১ কথা’, ‘রণাঙ্গন ৭১’, ‘১৯৭১-বন্দিশালায় বর্বরতা’, ‘একাত্তরের দারা’, ’৭১-এর বীরেন স্যার’, ‘জনকের প্রতিবাদী জীবন’, ‘১৯৭১-বিদেশি গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ’, ‘বাঁচার দাবি: বাঙলা-বাঙালি-বঙ্গবন্ধু’, ‘বঙ্গবন্ধু এবং বিশ্বের রাজনৈতিক হত্যা’, ‘মোশতাকের মন্ত্রিসভা-বেইমানির ইতিবৃত্ত’, ‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু’, ‘বঙ্গবন্ধু বিরোধী মিথ্যা মামলা এবং বঙ্গবন্ধুর বাকশাল’।
অনুবাদ ও পরিবেশ বিষয়ক বই: ‘কৌটিল্য-র অর্থশাস্ত্র’, ‘এবং কৌটিল্য-র নীতিশাস্ত্র’, ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড টু ফার্স্ট’ (লি কুয়ান ইউয়ের আত্মজীবনী), ‘বাংলাদেশের নদনদী’, ‘পৃথিবীর পরিবেশ’, ‘অরণ্যাদের শ্যামল গাঁও’।
ভ্রমণ বিষয়ক বই: ‘দেশের নাম ভিয়েতনাম’, ‘স্বর্গরাজ্য সিঙ্গাপুর’, ‘প্যারিসের পথে পথে’, ‘এবং ব্রিটেনের রাজতন্ত্র’।
কবিতা ও ছড়ার গ্রন্থ: ‘বদ্বীপের বেদনা’, ‘নৃত্যহীন মৃত্যুদিন’, ‘ঘুমকে ঘুমাতে দাও’, ‘বিশুদ্ধ স্লোগান’, ‘কালের কবিতা’, ‘ছড়া-কবিতায় একুশ-একাত্তর’, ‘পাখির মতো উড়ব’।