আগ্রাসী যুদ্ধের ছদ্মাবরণে এক অতি নৃশংস গণহত্যার তাণ্ডবে গাজায় মাত্র তিন মাসে ২৮ হাজার নারী, শিশু, সাধারণ মানুষ হত্যা করেছে ইসরায়েলি হানাদার বাহিনী। পশ্চিমের কতিপয় পরাশক্তি ব্যতিরেকে সমগ্র বিশ্ব নিন্দা ও ধিক্কার জানাচ্ছে ইসরায়েলকে। ফিলিস্তিনের জনগণ জীবন-মরণ লড়াই করছেন অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।
গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার ঘটনায় বিশ্ববিবেকের সমান্তরালে সাহিত্যের দায় ও সাহিত্যিকের দায়িত্বের জরুরি বিষয়গুলো সামনে চলে এসেছে। চরম মানবিক বিপর্যয়ে চুপ নেই বাংলাদেশও। সিলেটের লিটল ম্যাগাজিন ‘বুনন’ ২০২৪ সালের একুশের বইমেলায় প্রকাশ করেছে ‘যুদ্ধ ও আগ্রাসন বিরোধী বিশেষ সংখ্যা’। হাজার পৃষ্ঠার আয়োজনে বহুবিধ লেখায় প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে, ‘যুদ্ধ, গণহত্যা, সংহার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাহিত্যের দায় ও সাহিত্যিকের দায়িত্ব কতটুকু?’
শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক খালেদ উদ-দীন সম্পাদিত ‘বুনন’-এর ‘যুদ্ধ ও আগ্রাসন বিরোধী বিশেষ সংখ্যা’য় লিখেছেন সমকালীন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল প্রায়-সকল লেখক। প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, অনুবাদে যারা যুদ্ধ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সঞ্চারিত করেছেন শৈল্পিক প্রতিবাদ।
বস্ততুতপক্ষে, শক্তিশালী ও কালোত্তীর্ণ লেখকের অনেক রকম গুণ থাকে, যার মধ্যে মানবতাবাদ, যুদ্ধ ও আগ্রাসনের বিরোধিতা অন্যতম। এগুলোই তাদের মূল পরিচয়। যদিও বিভিন্নভাবে তাদের পরিচয় প্রকাশিত হতে পারে। তারা পুরস্কার ও পাঠকপ্রিয়তায় ধন্য হতে পারেন বা না-ও হতে পারেন। তবে তাদের থাকে এমন এক সামর্থ্য, যা অভূতপূর্ব ভাবে মানবতার পক্ষে। ‘বুনন’ সাহিত্যের এই ঐতিহাসিক দায়িত্বের প্রতিধ্বনি করেছে বাংলাদেশ থেকে।
প্রসঙ্গত, উল্লেখ্য যে, সমকালের আধুনিক সাহিত্যধারার সাহিত্যিকদের মধ্যে আফ্রিকার আধুনিক সাহিত্যের জনক চিনুয়া আচেবির লেখায় আছে তেমনি আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করার শক্তিমত্তা ও নৈতিকতা। ‘তার লেখা কারাগারের দেয়ালও ভেঙে দেয়' বলে মন্তব্য করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা।
চিনুয়া আচেবির নাম আমরা জানি তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’-এর মাধ্যমে। আফ্রিকার রাজনীতি ও পশ্চিমাদের চোখে আফ্রিকা যেভাবে চিত্রিত হয় সে প্রসঙ্গটি ঘুরে ফিরে এসেছে চিনুয়া আচেবির রচনায়। আফ্রিকার অনেক লেখকের প্রেরণার উৎস তিনি। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত তার এই প্রথম উপন্যাস গ্রন্থটি এক ঝটকায় স্বীকৃতি পায় ‘মর্ডান আফ্রিকান মাস্টারপিস’ হিসেবে। বইটি অনূদিত হয়েছে বিশ্বের পায় সবগুলো ভাষায়। আফ্রিকার পটভূমিকে আচেবির মতো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সূত্রে ফিলিস্তিন বা অন্য কোনও যুদ্ধ, গণহত্যা, আগ্রাসন ও জাতিগত নিধনের যজ্ঞ উন্মোচনে এগিয়ে আসা সাহিত্যিকদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
নির্যাতিত জাতিসত্তার মধ্য থেকে উত্থিত সাহিত্যিক ভাষ্যকার লাতিন সাহিত্যে কয়েক জন থাকলেও আরব বিশ্ব, মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিম এশিয়া কিংবা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অতি সামান্য। আচেবি এক্ষেত্রে অনুপ্রেরণামূলক, যিনি ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর জন্ম গ্রহণ করে ৯০ বছরের প্রান্তসীমা স্পর্শ করেও সচল ছিলেন স্বজাতিবোধে উজ্জীবিত সাহিত্য সাধনায়।
নোবেল সাহিত্য পুরস্কার না পেয়েও তিনি মর্ডান আফ্রিকান সাহিত্যের পুরোধা এবং জীবন্ত আইকন। এমনকি, আফ্রিকা থেকে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া ওলে সোয়িংকা (নাইজেরিয়া, ১৯৮৬), নাগিব মাহফুজ (মিশর, ১৯৮৮), নাদিন গার্ডিমার (দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৯৯১)-এর চেয়ে কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাকেই অগ্রগণ্য রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
বই ও লেখালেখির বাইরে চিনুয়া আচেবির কথা আলোচনা হয়েছে সহকর্মী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও সিনিয়র প্রফেসর ড. মহিবুল আজিজের সঙ্গে, যিনি আচেবির প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে ধন্য। আমরা একমত হয়েছি যে, আফ্রিকান ফেনমেনন তার মতো আর কেউ আধুনিকভাবে তুলে ধরতে পারেননি। একই ভাবে ফিলিস্তিনি বা কুর্দি বা আরব বা রোহিঙ্গা প্রপঞ্চ সেসব জাতির ভেতর থেকে উপস্থাপিত হয়নি এখন পর্যন্ত। অথচ দক্ষিণ-পূর্ব নাইজেরিয়ার ইকবো শহরে জন্ম নেয়া আচিবে আফ্রিকাকে নিয়ে রচনা করেছেন স্মরণীয় উপন্যাসমালা, যাকে অভিহিত করা হয় 'আফ্রিকান ট্রিলজি' নামে। সব লেখায় আফ্রিকান সমাজ, সংস্কৃতি, সংকট ও মানবগোষ্ঠীর অনুষঙ্গ নিয়ে কাজ করছেন তিনি। গভীরভাবে ছুঁয়েছেন জন্মভূমি আফ্রিকা নামক নির্যাতিত মহাদেশকে।
তিনি হতে চেয়েছিলেন চিকিৎসক। কিন্তু হলেন শিক্ষক ও লেখক। ইউরোপে পড়াশোনার অভিজ্ঞতা থাকলেও ১৯৯০ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে আসছিলেন তিনি মত্যুর পূর্ব-পর্যন্ত (২১ মার্চ, ২০১৩)। আহত হওয়ার পর থেকে তিনি কোনও বই লেখেননি। তার পরবর্তী বছরগুলো বেশিরভাগই কেটেছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে। চাকরি জীবনে তিনি নাইজেরিয়ার ব্রডকাস্ট সার্ভিসে কাজ শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালেই তার লেখালেখি শুরু হয়।
লেখক হিসেবে চিনুয়া আচেবি আফ্রিকা এবং পশ্চিমের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছিলেন। তার কাজকে মানদণ্ড ধরেই প্রজন্মান্তরে আফ্রিকান লেখকদের কাজের মূল্যায়ন হয়ে আসছে। চিনুয়া ২০টিরও বেশি লেখা লিখেছেন। এর মধ্যে কয়েকটি লেখাই রাজনীতিবিদ এবং নাইজেরিয়ার নেতাদের নেতৃত্বে ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনা করে লেখা। তার বইগুলোতে দেশটির ঔপনেবেশিক সময়ে ইবো সমাজের ঐতিহ্য, দেশটির সংস্কৃতিতে খ্রিস্টানদের আগ্রাসন এবং আফ্রিকা ও পশ্চিমাদের মধ্যকার প্রথাগত দ্বন্দ্বের বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠে এসেছে। এছাড়াও তিনি অনেক ছোটগল্প, শিশু সাহিত্য এবং প্রবন্ধও রচনা করেছেন।
১৯৫৮ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট' এর সুবাদে ব্যাপক পরিচিত লাভ করলেও আচেবির জনপ্রিয়তায় কখনোই ভাটা পড়েনি। সব সময়ই তিনি ছিলেন সেলিব্রিটি। তবে একথা ঠিক যে প্রথম উপন্যাসেই তিনি প্রবলভাবে আলোচিত হন, যে উপন্যাসটি অনুবাদ হয়েছে ৫০টিরও বেশি ভাষায়। তাছাড়া, বিশ্বজুড়ে উপন্যাসটি প্রায় এক কোটি কপি বিক্রি হয়। তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘অ্যান্টহিলস অব দ্য সাভানা’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে।
চিনুয়া আচিবের লেখা রাজনৈতিকভাবে অবদমিত মানুষের সংক্ষোভকে জাগরিত করে। মননে ও চেতনায় দ্রোহের স্পন্দন জাগায়। চিরনিপীড়িত আফ্রিকার জীবনবাদী উন্মেষের সূত্রকে তিনি নান্দনিক বিভায় তুলে ধরেন উপন্যাসের কাঠামো ও আখ্যানে। কারাগারের দেয়াল ভেঙে দেওয়ার মতো শৌর্যময় লেখার রূপকার তিনি। তার জীবন ও কর্মের মধ্যে রয়েছে যুদ্ধ, গণহত্যার বিরুদ্ধে সাহিত্যের দায় ও সাহিত্যিকের দায়িত্ব পালনের ফলিত দৃষ্টান্ত এবং নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর লেখকদের জন্য যুক্তির দীক্ষা ও আলোকায়নের প্রণোদনা।
খালেদ উদ-দীন সম্পাদিত 'বুনন'-এর 'যুদ্ধ ও আগ্রাসন বিরোধী বিশেষ সংখ্যা' পাঠকদের উদীপ্ত করবে মানবতার পক্ষে। সাহিত্যের দায় ও সাহিত্যিকের দায়িত্বের বহুমাত্রিক পরিসরকের উন্মোচিত করবে এই উদ্যোগ। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের লেখক ও পাঠকের চৈতন্য জাগ্রত হবে যুদ্ধ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। 'বুনন' বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাসে নৃশংসতার বিপরীতে মানবিক বোধের মুক্ত বাতায়ন হয়ে থাকবে।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।