সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০২৪ সালের একুশের পদকের জন্যে মনোনীতদের নাম প্রকাশ করেছে। এবার ১২টি ভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছেন ২১ জন। মহান ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে ১৯৭৬ সাল থেকে সরকার প্রতিবছর বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার দিয়ে আসছে। প্রথম বছর কেবল সাহিত্য, সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্যে পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে এই পুরস্কারের ব্যাপ্তি বেড়েছে, তিন ক্ষেত্র থেকে বেড়ে হয়েছে বারো। বেড়েছে পুরস্কারের অর্থমূল্য, হয়েছে নীতিমালাও।
একুশে পদক রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার। এবার ছয় প্রয়াতসহ যে একুশ জনকে পুরস্কারের জন্যে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তারা হলেন—ভাষা আন্দোলনে মৌ. আশরাফুদ্দীন আহমদ (মরণোত্তর) ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হাতেম আলী মিয়া (মরণোত্তর); শিল্পকলায় সংগীতে জালাল উদ্দীন খাঁ (মরণোত্তর), বীর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণী ঘোষ, বিদিত লাল দাস (মরণোত্তর), এন্ড্রু কিশোর (মরণোত্তর), শুভ্র দেব; নৃত্যকলায় শিবলী মোহাম্মদ; অভিনয়ে ডলি জহুর, এমএ আলমগীর; আবৃত্তিতে খান মো. মুস্তাফা ওয়ালীদ (শিমুল মুস্তাফা), রূপা চক্রবর্তী; চিত্রকলায় শাহজাহান আহমেদ বিকাশ; মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ ও আর্কাইভিংয়ে কাওসার চৌধুরী; সমাজসেবায় মো. জিয়াউল হক ও আলহাজ রফিক আহামদ; ভাষা ও সাহিত্যে মুহাম্মদ সামাদ, লুৎফুর রহমান রিটন, মিনার মনসুর ও রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (মরণোত্তর); এবং শিক্ষায় প্রফেসর ড. জিনবোধি ভিক্ষু।
প্রতিবছর জাতীয় পর্যায়ের পুরস্কারগুলো বিশেষ করে একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকের মনোনয়নপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণার পর কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগসহ সমালোচনা শুরু হয়। তবে এবারের একুশে পদকের মনোনয়নপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণার পর সে রকম সমালোচনা হচ্ছে না, বরং যোগ্য লোকের মূল্যায়ন হয়েছে বলে চারদিক থেকে অভিনন্দন বার্তা আসছে। এটা মূলত সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্যে মনোনয়নপ্রাপ্ত মো. জিয়াউল হককে ঘিরে। আড়ালে থাকা সমাজসেবী জিয়াউল হক সমাজসেবায় যে অবদান রেখে চলেছেন তার মূল্যায়ন হওয়ায় ধন্যবাদ জানানো হচ্ছে।
মনোনয়নের ঘোষণা আসার পরের দিন থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় পেশায় দই বিক্রেতা জিয়াউল হকের ছবি। প্রায় প্রতিটি গণমাধ্যম এরপর তাকে নিয়ে প্রতিবেদন করেছে। প্রতিবেদন সূত্রে জানা যাচ্ছে, মাত্র দেড় টাকার জন্যে বই কিনতে পারেননি জিয়াউল হক। বাড়ি বাড়ি গরুর দুধ দোহন করে জীবিকা নির্বাহ করা বাবা বই কেনার জন্যে সেই দেড় টাকার যোগাড় করতে পারেননি। ঘটনা ১৯৫৫ সালের। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে না পেরে জিয়াউল হক বাবার সংগ্রহ করা দুধ দিয়ে দই তৈরি করে ফেরি করে বিক্রি করা শুরু করেন। সেই যে শুরু, চলছে এখনো। টাকার অভাবে যাদের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন তিনি। দই বেচার টাকা দিয়ে তিনি বই কেনেন, গরিব শিশু-শিক্ষার্থীদের মাঝে সেই বই বিলিয়ে দেন বিনামূল্যে।
এখন বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিচ্ছে সরকার। প্রথম দিন বই উৎসব শুরুর আগেই অবশ্য দেশে বিনামূল্যে বই দেওয়ার প্রচলন হয়েছিল। জিয়াউল হক ততদিন পর্যন্ত তার নজরে পড়া গরিব শিক্ষার্থীদের বই দেন যতদিন পর্যন্ত না বিনামূল্যে বই বিতরণের প্রথা সরকারিভাবে চালু হয়। অর্থাৎ দীর্ঘকাল এই কাজ করেছেন তিনি। তিনি কেবল শিশুদের জন্যে বই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, নিজে গড়েছেন লাইব্রেরি; যেখানে আছে অন্তত পনেরো হাজার বই। ১৯৬৯ সালে নিজের বাড়ির একটি ঘরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘জিয়াউল হক সাধারণ পাঠাগার’। গণমাধ্যম জানাচ্ছে, পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের বইও আছে পাঠাগারে। তার সংগ্রহ করা বই আছে পাশের উচ্চ বিদ্যালয়ে, আছে আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠাগারে। কেবল বই নিয়েই আবার তার জীবন সীমাবদ্ধ নয়, তিনি অনেককে আর্থিকভাবে সহায়তা করেছেন, নলকূপ করে দিয়েছেন অনেককে, সহায়তা করেছেন বিভিন্নভাবে।
জিয়াউল হকের এই জীবনকাহিনী বিত্তের নয়, চিত্তের। দই বিক্রির সামান্য টাকাও যে অসামান্য হতে পারে সে প্রমাণ রেখেছেন তিনি। কতই বা রোজগার ছিল তার? কিন্তু তা দিয়েও যে চাইলেই অনেক কিছু করা যায় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই জিয়াউল হক। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন, কিন্তু মানবিক শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত নিঃসন্দেহে। চিত্তের পরিধিতে তিনি অসামান্য।
তৎকালে দেড় টাকা তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনকে থামিয়ে দিয়েছিল। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে না পারলেও, অন্তরালে থেকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে নিজেই হয়ে ওঠেছেন আরেক প্রতিষ্ঠান। তিনি সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের জন্যে যোগ্যজন। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার মনোনয়নে নানা সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও জিয়াউল হককে মূল্যায়ন কর এবার সরকার অসামান্য কাজ করেছে। এই মনোনয়ন প্রক্রিয়ার প্রস্তাব থেকে শুরু করে যাচাইবাছাই এবং অনুমোদনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে ধন্যবাদ।
বিত্ত নয়, চিত্ত; জিয়াউল হক এক উদাহরণ। জীবদ্দশায় তিনি রাষ্ট্রীয় সম্মান ও স্বীকৃতি পেয়েছেন। এই স্বীকৃতিতে মহিমান্বিত হয়েছে পদক, এই স্বীকৃতি অনুপ্রাণিত করুক সবাইকে।