অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণ থেকে: ভাষা শহীদদের স্মরণে ভোরের প্রভাত ফেরির গন্তব্যস্থল ছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সবাই ছুটে আসেন বইমেলা প্রাঙ্গণে। এর পর থেকে মেলার দার বন্ধ হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দেখা যায় বইপ্রেমীদের ভিড়।
মেলায় আগতদের কথন ও বসনে ছিল অমর একুশের চেতনার ছাপ। সাদাকালো শাড়ি, পাঞ্জাবি আর সালোয়ার কামিজ পরা নারী-পুরুষ-শিশুর স্রোত যেন মাতৃভাষার বিশাল এক ক্যানভাস। যাতে বড় বড় লাল আর হলুদ রঙে ফুটে উঠেছে ‘অ, আ, ক, খ’ সহ নানা বর্ণমালা।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দিনে মেলা প্রাঙ্গণে সারাদিনই ছিল মানুষের ঢল। এবংকি মেলার বাইরে শাহবাগ, দোয়েল চত্বর, নীলক্ষেতেও ছিল দর্শনার্থীদের ঢল। অনেকগুলো প্রবেশ পথ হওয়ায় দীর্ঘ সময় না হলেও, বেশ কিছুক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েই প্রবেশ করতে হয়েছে মেলায়। এত ভিড়ে প্রচুর বই বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকাশকরা।
পাঞ্জেরী প্রকাশনীর সত্বাধিকারী কামরুল ইসলাম শায়ক বলেন, `একুশের দিন সময় যত গড়িয়েছে ভিড় ততই বেড়েছে। ভিড়ের তুলনায় বিক্রি তেমন হয়নি।‘
`লেখক বলছি' মঞ্চ
মেলার লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের সাম্প্রতিক বই নিয়ে কথা বলেন পাঁচ কবি-সাহিত্যিক। এদের মধ্যে গবেষক তপন পালিত এর ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার’ কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’ (প্রথমা), কবি খালেদ হোসাইনের ‘চাই জল এক ফোঁটা’ কবি-প্রাবন্ধিক রাহেল রাজিবের ‘অনুমেয় আঘাতের ক্ষত’ এবং কবি ফারুক ওয়াসিফের ‘তমহা পাথর’ বই নিয়ে পাঠকের মুখোমুখি হন।
একুশের স্মারক বক্তৃতা
বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভপতিত্বে বিকেলে গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়- অমর একুশে বক্তৃতা। ‘বাংলা ভাষার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক একুশে বক্তৃতা দেন ভাষা সংগ্রামী জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। অনুষ্ঠানের শুরুতে পুরানা ঢাকার চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, `বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস বহু অবদান ও পরম্পরায় ঋদ্ধ। এ নিয়ে কোনো সরলিকীকরণের কোনো সুযোগ নেই। এই ভাষা ও সাহিত্য যেমন প্রাচীন চর্যার ধারাবাহিকতায় পুষ্ট তেমনি মধ্যযুগের মুসলিম অবদানেও সমৃদ্ধ। বিশেষ করে সে সময় সাহিত্যে দেবতাবাদের পরিবর্তে মানববাদের যে স্ফুরণ লক্ষ করা যায় পরবর্তীকালে তাই বাংলা সাহিত্যে মূল কাঠামো ও মর্ম নির্ধারণ করেছে। এরপর ইংরেজ আগমন এই ভাষা ও সাহিত্যে পাশ্চাত্য প্রভাব অঙ্গীকৃত করেছে। তারপর দেশভাগের অভিঘাত, ভাষা-আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের অশ্রু ও রক্তস্রোত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নতুন গতি ও গন্তব্য নির্ধারণ করে যা এখনো পর্যন্ত বহমান।
আনিসুজ্জামান বলেন, `স্বাধীনতার পর পর বাংলা ভাষার ব্যবহারে আমরা ব্যাপক উৎসাহ দেখালেও এখনো সুচারুরূপে বাংলার ব্যবহারে পূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি। আর অন্যদিকে আমাদের দেশে অনেক জনগোষ্ঠী আছে যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়। যদিও তাদের অনেকেই শিক্ষা ও অন্যান্য প্রয়োজনে বাংলা ভাষা ব্যবহার করে। এদের উত্তরপ্রজন্মের অবশ্যই তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার আছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমাদের এ বিষয়ে সচেতনতা এবং স্পষ্ট অঙ্গীকার প্রয়োজন।‘
মেলায় নতুন বই
এদিকে বইমেলায় ২১ দিনে প্রায় সাড়ে তিন হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা একাডেমির সমন্বয় ও জনসংযোগ উপবিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, মেলার প্রথম ২১ দিনে তিন হাজার ৩৬৩টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে গল্প ৫৪৭, উপন্যাস ৫১৩, প্রবন্ধ ১৯০, কবিতা এক হাজার ৭৫, গবেষণা ৫৩, ছড়া ৮১, শিশুসাহিত্য ৮৯, জীবনী ১১৭, রচনাবলি ৭, মুক্তিযুদ্ধ ৮৪, নাটক ৩১, বিজ্ঞান ৬১, ভ্রমণ ৬৯, ইতিহাস ৫৪, রাজনীতি ২৫, স্বাস্থ্য ২১, রম্য/ধাঁধা ২০, কম্পিউটার ৩, ধর্মীয় ১৫, অনুবাদ ২৮, অভিধান ৪, সায়েন্স ফিকশন ৩৭ এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর ২৩৯টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে।
একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগ জানায়, বৃহস্পতিবার একুশের মেলায় নতুন ৩৯৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে গল্পগ্রন্থ ৫২টি, উপন্যাস ৫২টি, প্রবন্ধ ২৭টি, কবিতা ১৪৫টি, গবেষণা আটটি, ছড়া আটটি, শিশুসাহিত্য নয়টি, জীবনী ১৩টি, রচনাবলি দুটি, মুক্তিযুদ্ধ ১০টি, নাটক নয়টি, বিজ্ঞান আটটি, ভ্রমণ সাতটি, ইতিহাস ছয়টি, রাজনীতি দুটি, স্বাস্থ্য একটি, অনুবাদ পাঁচটি, সায়েন্স ফিকশন চারটি এবং অন্যান্য বিষয়ের আরও ২৮টি বই এসেছে।
মেলার মূল মঞ্চের আয়োজন
গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে সকালে অনুষ্ঠিত হয় স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। এতে দেড় শতাধিক নবীন-প্রবীণ কবি কবিতা পাঠে অংশ নেন। সভাপতিত্ব করেন কবি অসীম সাহা। সন্ধ্যায় কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন কবি নির্মলেন্দু গুণ, হাসান হাফিজ, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, জাফর আহমদ রাশেদ, আলফ্রেড খোকন এবং সোহেল হাসান গালিব।
আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ইকবাল বাহার চৌধুরী, আহ্কাম উল্লাহ এবং তামান্না সারোয়ার। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল ফকির সিরাজের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী’র পরিবেশনা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী ফকির আলমগীর, প্রমীলা চক্রবর্তী, মহাদেব ঘোষ, লাইসা আহমদ লিসা, বুলবুল ইসলাম, জান্নাত-ই-ফেরদৌসী এবং নীলোৎপল সাধ্য।