স্মরণীয় ১০ জন যারা পেয়েছিলেন রাষ্ট্রের অবমাননা ও অবিচার (পর্ব ২)

বিশেষ রচনা, শিল্প-সাহিত্য

দেবদুলাল মুন্না | 2023-09-01 13:32:47

পেছনে ফিরে দেখি। কী দেখি? অতীত। কিন্তু যে দলছুট হয়ে স্রোতে ভাসা মানুষের ভিড় থেকে চলে যায় অনেক আগে তাকেও তো পেছনে ফিরে তাকাতে হয়। পা সামনে এগুনো। কিন্তু একটি মুখ মুখ ফিরিয়ে দেখছে। সে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের সব বেদনা। একটু আলো জ্বেলেছিল। আমরা হয়তো বুঝিনি। হয়তো ড্যাশ ড্যাশ ড্যাশ। কিন্তু তার ওই দলছুট হয়ে এগিয়ে যাওয়ায় কম যন্ত্রণাবিদ্ধও হয়নি। মনে রেখেছি সেইসব মুখদের! তাদের অনেককেই তদানীন্তন সমাজ, শাসক, তথা রাষ্ট্রের চরম অবমাননা এবং অবিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এত এত মুখ। বলি মাত্র ১০ জনের কথা এ কিস্তিতে।

 স্মরণীয় ১০ জন যারা পেয়েছিলেন রাষ্ট্রের অবমাননা ও অবিচার (পর্ব ১)

জোয়ান অব আর্ক

জোয়ান অব আর্ক ব্রিটিশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফ্রান্সকে বিজয়ী করতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। অথচ তাকে ডাইনি আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। যদিও পুড়িয়ে মেরে ফেলার পর তার মৃত্যুর ২৫ বছর পর পোপ ক্যালিক্সটাস-৩ তার এই হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ নতুন করে শুরু করেন এবং সেই বিচারে জোয়ান নিষ্পাপ ও সন্ত (সেন্ট) এবং শহীদ প্রমাণিত হয়। মৃত্যুপরবর্তী বিচারে জোয়ান নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাকে সন্ত বা সেইন্ট ঘোষণার সাথে সাথে তার নির্মম হত্যাকাণ্ডের সূত্র ধরে ফরাসিরা ফ্রান্স থেকে চিরতরে ইংরেজদের সকল অধিকার ও চিহ্ন মুছে দেওয়ার প্রয়াস শুরু করে। কিন্তু পেছনে তাকালে দেখি এই জোয়ান অসম্ভব সরল এক কিশোরী ছিল। ১৪১২ খ্রিস্টাব্দে জোয়ানের জন্মের সময়কালে ফ্রান্সের রাজা ষষ্ঠ চার্লস উন্মাদ হয়ে যান ও রাজ্য পরিচালনায় অক্ষম হয়ে পড়েন এবং রাজার ভায়েরা রাজক্ষমতার জন্য কলহে লিপ্ত হন। ইংলিশ রাজা পঞ্চম হেনরি এর পুরো সুযোগ নিয়ে ১৪১৫ সালে ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলের শহরগুলো দখল করে নেন। এদিকে সপ্তম চার্লসের চার ভাই মারা গেলে, তিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন। আর বার্গুন্ডিয়ানরা ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়। কথিত আছে, মাত্র ১৩ বছর বয়সে মাঠে ভেড়ার পাল চরানোর সময় কৃষককন্যা জোয়ান দৈববাণী শুনতে পান যে, তাকে মাতৃভূমির স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার ও ফ্রান্সের প্রকৃত রাজা মুকুটবিহীন সম্রাট সপ্তম চার্লসকে ক্ষমতায় ফের বসানোর জন্য বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। তাই ১৪২৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮ এপ্রিল, জোয়ান পুরুষ নাইটদের পোশাক পরিধান করে একটি সাদা ঘোড়ায় চরে পঞ্চক্রূশধারী তরবারি হাতে ৪০০০ সৈন্য নিয়ে অবরুদ্ধ নগরী অর্ল্যান্ডে ঢুকে পড়েন এবং তিনি তৎকালীন ফ্রেঞ্চ নেতৃত্বের রক্ষণাত্মক রণকৌশল পরিহার করে আক্রমণাত্মক কৌশল অবলম্বন করে অর্ল্যান্ডকে মুক্ত করেন। পরের দৃশ্যে আমরা দেখি, ১৬ জুলাই ১৪২৯ সাল। সপ্তম চার্লস ফ্রান্সের রাজা হিসেবে পুনরায় সিংহাসনে অভিষিক্ত হন এবং জোয়ানকে তার অসামান্য সাহসিকতা এবং বুদ্ধিমত্তার জন্য ফ্রান্সের রাজসভায় একটি বিশেষ সম্মানিত পদে অভিষিক্ত করেন।

জোয়ান শিক্ষিত ছিলেন না, কিন্তু তার মেধা এবং অসম্ভব বীরত্বের জন্য ফ্রান্সের রাজসভার অন্যান্য পুরুষ সদস্যগণ তাকে মনে মনে হিংসা ও অপছন্দ করতে শুরু করল। তারা তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভয় পেয়ে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রেও লিপ্ত হলো, কেননা রাজা সপ্তম চার্লস জোয়ানকে ভীষণ পছন্দ এবং বিশ্বাস করতেন। জোয়ান ইংরেজদের সাথে একটি যুদ্ধে লিপ্ত হলে রাজসভার ধর্মব্যবসায়ী যাজকরা রাজাকে বোঝান জোয়ানের এই ধর্মযুদ্ধ রাজাকে ফরাসিদের কাছে ‘শয়তানে’ পরিণত করবে। তৎক্ষণাৎ রাজা জোয়ানকে ডেকে যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দেন এবং ইংরেজদের সাথে সমঝোতায় আসতে বলেন। কিন্তু একরোখা এবং জেদী জোয়ান রাজার আদেশ অমান্য করেই যুদ্ধ চালিয়ে যান। ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মে সেনাবাহিনীর একটি অংশ তাকে আটক করে ফেলে। প্রাথমিকভাবে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। আটক অবস্থায় জোয়ান কয়েকবার পালানোর চেষ্টা করেন। একবার তিনি ৭০ ফুট উঁচু টাওয়ার থেকে নিচের মাটিতে লাফিয়ে পড়ে বার্গুন্ডিয়ান শহর আরাসে পালিয়ে যান। ব্রিটিশ সরকার তাকে বার্গুন্ডিয়ান ডিউক ফিলিপের কাছ থেকে কিনে নেয়। এক ইংরেজ ধর্মজীবী পাদ্রির অধীনে ১৪৩১ সালের ৯ই জানুয়ারি তার বিচার কার্যক্রম আরম্ভ হয়। প্রহসনের এ বিচারে তাকে কোন আইনজীবী দেয়া হয়নি।

বিচারে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে ‘তার ওপর ঈশ্বরের বিশেষ দয়া আছে’—তিনি এমন বিশ্বাস পোষণ করেন কিনা। জবাবে জোয়ান বলেছিলেন, “যদি আমি তা বিশ্বাস না করি তবে ঈশ্বর যেন আমাকে যেখানে আছি সেখানেই রেখে দেন, আর যদি বিশ্বাস করি তবে ঈশ্বর যেন আমাকে রক্ষা করেন।” আসলে এই প্রশ্নটিই ছিল সাংঘাতিক চালাকিপূর্ণ। যদি জোয়ান বলতেন, “হ্যাঁ করি”, তবে তাকে ধর্মের বিরুদ্ধে যাবার অভিযোগ আনতেন আর যদি জোয়ান বলতেন “না”, তবে বলা হতো তিনি নিজের অভিযোগ নিজেই স্বীকার করেছেন। ছলচাতুরি বিচারে আদালত তাকে ১২ নম্বর আর্টিকেল অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত করে। বিচারে তার কার্যকলাপকে প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী আখ্যা দিয়ে তাকে ‘ডাইনি’ সাব্যস্ত করা হয়। ... তার কোনো আইনজীবী না থাকাতে জোয়ানকে রায় বিস্তারিত পড়ে শোনানোও হয়নি এবং জোয়ান প্রাথমিকভাবে বুঝতেও পারেননি, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মে ফ্রান্সের রোয়েনে ফরাসি বীরকন্যা জোয়ান অব আর্ককে ডাইনি অপবাদ দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৯। জোয়ানের মৃত্যুর পর ব্রিটিশরা তার কয়লা হয়ে যাওয়া শরীরকে প্রদর্শন করে যাতে কেউ কোনোদিন দাবি না করতে পারে জোয়ান বেঁচে পালিয়ে গেছে।

গ্যালিলিও

বিজ্ঞানী গ্যালিলিও একজন ইতালীয় পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ এবং দার্শনিক যিনি বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সাথে বেশ নিগূঢ়ভাবে সম্পৃক্ত। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদানের মধ্যে রয়েছে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের প্রভূত উন্নতি সাধন যা জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা। নিউটনের গতির প্রথম এবং দ্বিতীয় সূত্র এবং কোপারনিকাসের মতবাদের পক্ষে অতি গুরুত্বপূর্ণ অবজারভেশন ছিল তার। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের মতে আধুনিক যুগে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের এত বিশাল অগ্রগতির পেছনে গ্যালিলিওর চেয়ে বেশি অবদান আর কেউ রাখতে পারেনি। বৃহস্পতির উপগ্রহ আবিষ্কার থেকে চার্চের প্রভাবশালী পোপদের সাথে বিবাদ, তার জীবন ছিল ব্যাপক বৈচিত্রময়। তাই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ তার গুণের চর্চা করছে আর তার জীবন থেকে সাথে পাচ্ছে অফুরন্ত প্রেরণা। বিজ্ঞান আর ধর্মের বিরোধপূর্ণ এক সমাজে জন্মে অসম সাহসিকতায় বিজ্ঞানকেই বেছে নিয়েছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি।

তিনি যখন বিজ্ঞান চর্চা শুরু করেন, তখন সমাজে তিনটি বিষয়ে তীব্র দ্বন্দ্ব ছিল। প্রথমত, সমাজের একটি শ্রেণী সবকিছুকে বৈজ্ঞানিকভাবে চিন্তাভাবনা করত। আরেক শ্রেণী ছিল যারা অ্যারিস্টটলের ভুল তত্ত্বগুলোতে বিশ্বাস করত। কিন্তু তৃতীয় আরেকটি শ্রেণী ছিল, যারা ছিল সংখ্যায় সবচেয়ে বড় এবং একই সাথে অত্যন্ত প্রভাবশালী, তারা হলো গির্জা, তার পাদ্রী এবং তাদের অনুগত অমাত্যবর্গ এবং ক্যাথলিক চার্চের পোপরা সরাসরিই বিজ্ঞানের বিরোধিতা করত। বিজ্ঞানীদের কোনো কথা বাইবেলের বিপরীতে গেলেই তাদের জীবনে নেমে আসত অকল্পনীয় শাস্তি। জীবনের শেষ আটটি বছর তিনি কাটিয়েছিলেন গৃহবন্দী হয়ে। তার সামনে তার মেয়েকে এনে রেপ করে ফেলার ভয় দেখানো হতো। রাতে ঘুমাতে পারতেন না তিনি। মেয়ের মুখ ভাসত একদিকে। অন্যদিকে তার সত্য প্রকাশের প্রতিশ্রুতি। নিষিদ্ধ করা হয় তার লেখা বইও। কিন্তু শেষ অব্দি জয় হয় সত্যের। ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে গ্যালিলিও তার বিখ্যাত বই ‘ডায়ালগ’ প্রকাশ করেন।

বইটি প্রকাশের সাথে সাথে গির্জার পাদ্রীগোষ্ঠী তাদের প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং গ্যালিলিওকে রোমে ডেকে পাঠায়। ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর থেকে ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাস অব্দি গ্যালিলিওর বিচার কাজ চলে। এ সময় গ্যালিলিওকে জেলে যেতে হয়নি। জেরায় গ্যালিলিও প্রথমে স্বীকার করতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত তাকে শারীরিক নির্যাতনের হুমকি দিয়ে স্বীকার করানো হয় যে, তিনি ডায়ালগে কোপারনিকাসের তত্ত্বকে সমর্থন করেছেন। তাকে ধর্মবিরোধিতার কারণে অভিযুক্ত করা হয়। তাকে গৃহবন্দী করা হয় এবং দুটি আদেশ দেওয়া হয়—ক) বাইরের কোনো মানুষের সাথে দেখা করতে পারবেন না। (খ) ইতালির বাইরে তার কোনো গবেষণা কাজ প্রকাশ করা যাবে না। বলা বাহুল্য তিনি একটিও পালন করেননি। গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় তার ডায়লগের একটি কপি হল্যান্ডে ১৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এসময় তিনি গতিবিজ্ঞানের ওপর তার সারাজীবনের কাজ নিয়ে ‘টু নিউ সায়েন্সেস’ বইটি লেখেন, যা হল্যান্ড থেকে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ততদিনে গ্যালিলিও অন্ধ এবং গুরুতর অসুস্থ হয়ে গৃহবন্দীর থাকার ৮ বছরের মাথায় ৭৭ বছর বয়সে ইতালির ফ্লোরেন্সের নিকটে আর্সেট্রি নামক স্থানে ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ জানুয়ারি মারা যান।

ওয়াল্টার রালেহ

অনেকটা গল্পের মতো। ইংরেজ কবি স্যার ওয়াল্টার রালেহ রানি এলিজাবেথের সামনে কাদামাখা পথে নিজের আলখাল্লা বিছিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে রানির পায়ে কাদা না লাগে! রানি এলিজাবেথকে ভালোবাসতেন তিনি? এটি জানা যায়নি। তবে একথা সত্য তিনি রানির পায়ে যাতে ধুলো না লাগে সে জন্য কাপড় বিছিয়ে দিতেন। ২০০১ সালে জেমস কিভ্যাস নামের বিট্রিশ ইতিহাসবিদ ‘আনটোল্ড স্টোরি এবাউট কুইন এলিজাবেথ’ নামের বইতে লেখেছেন, রালেহ’র সাথে গোপনে দেখা করতেন এলিজাবেথ। দুজনের মধ্যে প্রেমের রিলেশন গড়ে উঠেছিল। এলিজাবেথ রালেহ’র কবিতার ভক্ত ছিলেন। দুজনের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও হয়েছিল কয়েকবার। এটি এক সৈনিকের বরাতে ইতিহাসবিদ জানান। সেটি সম্ভব ছিল হয়তোবা তিনি কবি ছিলেন বলেই! শুধু কবি নন, ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, সৈনিক ছিলেন। তিনিই আমেরিকাতে প্রথম ইংরেজি উপনিবেশের প্রতিষ্ঠাতা যিনি, ভার্জিনিয়া থেকে তামাক এনে ইংল্যান্ডের মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার জীবনেও অপেক্ষা করছিল ট্র্যাজেডি। যিনি প্রতি রাতে বস্তিতে যেতেন, উদ্যানে যেতেন, গিয়ে দেখতেন কেউ ক্ষুধার্ত আছে কিনা, থাকলে খাওয়াতেন। যিনি একজন সৈনিক হিসেবে ছিলেন তুখোড়, সেই তাকেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মরতে হয়েছিল।

আরো পড়ুন ➥ মহান শিল্পীদের ক্ষত ও ভালোবাসাসমূহ

লর্ড কোভাম এবং অন্যান্যদের সঙ্গে জেমস ১-কে হত্যা করার এবং লেডি আরবেলা স্টুয়ার্টকে সিংহাসনে বসানোর জন্য ষড়যন্ত্র করার দোষে অভিযুক্ত করা হয়েছিল তাকে। ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে, রানী এলিজাবেথ ১-এর প্রাক্তন প্রিয় স্যার ওয়াল্টার ররালেহকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিচার করা হয়েছিল, দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়েছিল। লন্ডনের টাওয়ারে তাকে ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ করার পরে ‘লর্ড কোভামের’ স্বাক্ষরিত স্বীকারোক্তি তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রমাণ হিসাবে গণ্য করা হয়েছিল। তবে শেষ অব্দি স্যার ওয়াল্টার রালেহ’র মৃত্যুদণ্ড হয় ১৬১৮ সালের ১৬ অক্টোবর, তাঁর আইনত মৃত্যুর ১৫ বছর পরে।

ফিওদর দস্তয়ভস্কি

দস্তয়ভস্কির পিতা মিখায়েল আন্দ্রিয়েভিচ ছিলেন মস্কোর এক হাসপাতালের ডাক্তার। তাঁর মায়ের মৃত্যুর পরে বাবা মিখায়েল আন্দ্রিয়েভিচ হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পাকাপাকিভাবে গ্রামে গিয়ে বসবাস করতে আরম্ভ করলেন। দস্তয়ভস্কি আর তার ভাইকে ভর্তি করে দিলেন মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমিতে। গ্রামে গিয়ে অল্পদিনেই সম্পত্তি বাড়িয়ে ফেললেন মিখায়েল। কিন্তু, মিখায়েলের অত্যাচার এবং অন্যায় আচরণে তার গ্রামের প্রজাদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠতে থাকে। কয়েকজন প্রজা তার নিজের গাড়িচালকের সাথে শলাপরামর্শ করে নির্জনে নিয়ে গিয়ে মিখায়েলকে হত্যা করে। বাবার এ মৃত্যু দস্তয়ভস্কির জীবনে নিয়ে আসে বিরাট আঘাত। একদিকে বাবাকে ঘৃণা করতেন অন্যদিকে বাবার মৃত্যুর সময় পাশে না থাকায় মিখাইল মারা যাওয়ার পর এক অপরাধবোধ তার মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। বাবার মৃত্যুর পর নিজেকেই অপরাধী বলে মনে হলো তার। এর থেকে জন্ম নিল এক অসুস্থ মনোবিকার। তাই পরবর্তীকালে কোনো মৃত্যুশোক, আঘাত বা উত্তেজনার প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এলেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন, ঘন ঘন দেখা দিত মৃগীরোগ। সারা জীবনে আর তিনি এই অসুখ থেকে মুক্তি পাননি।

নিঃসঙ্গতা, ক্লান্তি ভোলার জন্য জুয়া খেলা ধরেছিলেন দস্তয়ভস্কি। অধিকাংশ দিনই নিজের শেষ সম্বলটুকু জুয়ায় হারিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে আসেন। মাইনের টাকা কয়েক দিনের মধ্যেই ফুরিয়ে যায়। অর্থ সংগ্রহের তাগিদে ঠিক করলেন ফরাসি জার্মান সাহিত্য অনুবাদ করবেন। তিনি এবং তার ভাই মিখায়েল একসঙ্গে ফরাসি সাহিত্যিক বালজাকের উপন্যাস অনুবাদ করতে আরম্ভ করেন। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে একটি রাশিয়ান পত্রিকায় তা প্রকাশিত হতে থাকে। ক্রমশই চাকরি অসহ্য হয়ে উঠল। সাহিত্যজগত তাকে দুর্নিবারভাবে আকর্ষণ করছিল। তিনি চাকরি ছাড়লেন। নিজেকে পুরোপুরি সাহিত্য রচনায় ব্যস্ত রাখলেন। ৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৪৪ তার ভাইকে একটা চিঠিতে দস্তয়ভস্কি লিখলেন, “একটা উপন্যাস শেষ করলাম। এটা সম্পূর্ণ আমার নিজের লেখা। এখন পাণ্ডুলিপি থেকে নকল করছি। একটা পত্রিকায় পাঠাব। জানি না তারা অনুমোদন করবে কিনা। তা আমি এই রচনায় সন্তুষ্ট হয়েছি।”

এই সময় দস্তয়ভস্কির জীবনে নেমে এলো ট্র্যাজেডি। রাশিয়ার সম্রাট জার ছিলেন এক অত্যাচারী শাসক। তার শাসনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছিল ছোট ছোট সংগঠন। এক বন্ধুর মারফত দস্তয়ভস্কি পরিচিত হলেন এর একটি সংগঠনের সাথে। এদের আসর বসত প্রটাসভস্কি নামে এক তরুণ সরকারি অফিসারের বাড়িতে। কিন্তু অত্যাচারী জার প্রথম নিকোলাসের গুপ্তচরের নজর এড়াল না। তাদের মনে হলো এরা রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। রিপোর্ট গেল সরকারি দপ্তরে। যথারীতি একদিন প্রটাসভস্কির আসর থেকে বাড়িতে ফিরে এসে খাওয়া-দাওয়া করে রাতে ঘুমিয়ে পড়লেন দস্তয়ভস্কি। হঠাৎ শেষ রাতে পদশব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। চেয়ে দেখলেন তার ঘরে জারের পুলিশ বাহিনী। কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই তাঁকে গ্রেফতার করা হলো (এপ্রিল ১৩, ১৮৪৯)।

অন্য অনেকের সাথে তাকে বন্দী করে রাখা হলো আলোবাতাসহীন ছোট একটি বন্দীশালায়। দিনে মাত্র তিন-চারবার ঘরের বাইরে আসার সুযোগ মিলত। এক দুঃসহ মানসিকতার মধ্যেই তিনি লেখেন একটি ছোট গল্প ‘ছোট্ট নায়ক’। শুরু হলো বিচার। বিচারে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য দণ্ডাদেশ পত্র পাঠিয়ে দেওয়া হলো সম্রাট নিকোলাসের কাছে। সম্রাট তাদের মৃত্যুদণ্ড রোধ করে সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দিলেন। দস্তয়ভস্কির চার বছরের জন্য সাইবেরিয়ায় নির্বাসন আর তারপর চার বছর সৈনিকের জীবন যাপন করার আদেশ দেওয়া হলো। ক্রিসমাস ডে-তে পায়ে চার সের ওজনের লোহার শেকল পরিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো সাইবেরিয়ার বন্দীনিবাসে (জানুয়ারি ১৮৫০)।

চারদিকে নরকের পরিবেশ। খুনি বদমাইশ শয়তানের মাঝখানে দস্তয়ভস্কি একা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। ছোট অন্ধকার কুঠুরিতে শীতকালে অসহ্য ঠান্ডা। ছাদের ফুটো দিয়ে বরফ ঝরে পড়ে মেঝেতে পুরু হয়ে যায়। কনকনে তুষারঝড়ে হাত-পা ফেটে রক্ত ঝরে। গ্রীষ্মের দিনে আগুনের দাবদাহ। তারই মাঝে হাড়ভাঙা খাটুনি। ক্লান্তিতে, পরিশ্রমে শরীর নুয়ে পড়েছে। সে তার জীবনের এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার কথা পরবর্তীকালে জ্বলন্ত অক্ষরে লিখে গিয়েছেন তার ‘দ্য হাউস অফ দ্য ডেড’ (মৃত্যুপুরী) উপন্যাসে। দীর্ঘ চার বছর (১৮৫০-১৮৫৪) সাইবেরিয়ার বন্দীনিবাসে কাটিয়ে অবশেষে লোহার বেড়ির বন্ধন থেকে মুক্তি পেলেন। ওমস্কের বন্দীনিবাস থেকে দস্তয়ভস্কিকে পাঠানো হলো সেমিপালতিনস্ক শহরে। কিন্তু সামরিক জীবনের নিয়ম-শৃঙ্খলা কুচকাওয়াজ তার রুগ্ন শীর্ণ অসুস্থ অনভ্যস্ত শরীরে মাঝে মাঝে অসহনীয় হয়ে উঠত। তবুও নিজের যোগ্যতায় কিছুদিনের মধ্যেই সামরিক বিভাগে উঁচু পদ পেলেন।

এই সময় শহরের প্রধান সেনানায়ক জানতে পারলেন তার সৈন্যদলের মধ্যে একজন শিক্ষিত লেখক আছেন। তিনি দস্তয়ভস্কিকে ডেকে পাঠালেন। তারপর থেকে প্রতিদিন দস্তয়ভস্কি তার বাড়িতে গিয়ে তাকে খবরের কাগজ পড়ে শোনাতেন। এখানেই একদিন পরিচয় হলো এক মদ্যপ সরকারি কর্মচারী আলেকজান্ডার ইসায়েভ এবং তার সুন্দরী তরুণী স্ত্রী মারিয়া ডিমিট্রিয়েভনার সাথে। তারপর থেকে মারিয়ার আকর্ষণে শুরু হলো তার সেখানে যাতায়াত। এর কিছুদিনের মধ্যে ইসায়েভ বদলি হয়ে গেলেন ৪০০ মাইল দূরের এক শহরে। মারিয়ার অদর্শনে আবার মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত হয়ে গেলেন দস্তয়ভস্কি। কয়েক মাস পর মারিয়ার স্বামী ইসায়েভ মারা গেলেন। বছর খানেক পর একদিন দস্তয়ভস্কি গেলেন মারিয়ার কাছে। সেখানে গিয়ে যা দেখলেন তাতে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। মারিয়া ইতোমধ্যেই এক তরুণ স্কুলশিক্ষকের প্রেমে পড়েছে। অনেক অনুনয়-বিনয় করে তার মত পরিবর্তন করতে সক্ষম হলেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে দুজনের বিয়ে হলো। সারা দিনের পরিশ্রম উত্তেজনায় বাসরঘরেই মূর্ছিত হয়ে পড়লেন দস্তয়ভস্কি। সুখের পাত্র পূর্ণ হওয়ার আগেই অপূর্ণ রয়ে গেল সব আকাঙ্ক্ষা। আরো ২ বছর থাকার পর শেষ হলো তার বন্দীজীবন। সামরিক বিভাগের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে এসে বাসা বাঁধলেন মস্কোর কাছাকাছি টিভর শহরে। এখানেই তিনি লিখেছিলে ‘দ্য হাউস অফ দ্য ডেড’ (মৃত্যুপুরী) উপন্যাস।

আরো পড়ুন ➥ বিখ্যাত সৃষ্টিশীলদের অবসাদ ও স্যাটায়ার

এই উপন্যাস প্রকাশের সাথে সাথে দস্তয়ভস্কির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। খ্যাতির সাথে অর্থও আসতে আরম্ভ করল। কিন্তু মারিয়ার বিলাস-ব্যসনের সাথে তাল রাখতে ব্যর্থ হলেন দস্তয়ভস্কি। যন্ত্রণা হতাশা ভোলার জন্য ক্রমশই তিনি সৃষ্টির গভীরে ডুব দিলেন। এই সময় দস্তয়ভস্কির জীবনে এলো পলিনা। এক প্রাণোচ্ছল সুন্দরী তরুণী। দুজনে গেলেন ফ্রান্সে। কিন্তু পলিনাকে কাছে পেলেন না দস্তয়ভস্কি। এক পুরুষে মন ভরে না পলিনার। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল পলিনার সঙ্গে। ততদিনে হাতের অর্থও ফুরিয়ে এসেছে। জুয়ার নেশায় মাতাল দস্তয়ভস্কি। এক একদিন সব হারিয়ে গায়ের কোট খুলে দিয়ে আসতেন। কোনো দিন বা জিততেন কিন্তু তার পরদিন আবার সব হারাতেন। এই জুয়াড়ি জীবনের অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করেই পরবর্তীকালে লিখেছিলেন ‘জুয়াড়ি’। ইতোমধ্যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল মারিয়া। তার সেবা-যত্নের কোনো ত্রুটি করলেন না। কিন্তু তার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে মারা গেল মারিয়া। স্ত্রীর মৃত্যুর মাত্র তিন মাস বাদে মারা গেলেন বড় ভাই মাইকেল। মাইকেলের মৃত্যু তার কাছে অনেক বেশি আঘাত নিয়ে এলো। তার জীবনের অনেকখানি জুড়ে ছিল ভাইয়ের অস্তিত্ব!

১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ অক্টোবর, ২০ বছরের অত্যন্ত সাদামাটা চেহারার এক স্টেনোগ্রাফার হিসাবে দস্তয়ভস্কির কাছে কাজ করতে আসা অ্যানার সঙ্গে পরিচয় হয় দস্তয়ভস্কির। দস্তয়ভস্কির মনে হলো মারিয়া, পলিনা তাকে যা দিতে পারেনি, সেই সংসারের সুখ হয়তো দিতে পারবে অ্যানা। তাই সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। দস্তয়ভস্কির বয়স তখন ৪৫, অ্যানার ২০। সকলের বিরোধিতা সত্ত্বেও তাদের বিয়ে হলো। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হলো ‘দি ব্রাদার্স কারামাজোভ’। এক মহাকাব্যিক উপন্যাস। ব্যাপ্তিতে, গভীরতায়, চরিত্র সৃষ্টিতে ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্টের পাশাপাশি এই উপন্যাসও তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। সমস্ত দেশ জুড়ে তিনি পেলেন এক অভূতপূর্ব শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। তাকে বলা হলো জাতির প্রবক্তা। ক্রমশই তার শরীর ভেঙে পড়ছিল। শেষে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ১৮৮১ সালের ৯ সালে মারা যাওয়ার আগে সেই বিখ্যাত উক্তি করেন, “লাইফ ইজ এ লাই।”

লর্ড বায়রন

বায়রন একজন ব্রিটিশ কবি এবং রোমান্টিক আন্দোলনের অন্যতম মুখ্য ব্যক্তি। কিন্তু ব্রিটিশ হলেও তিনি গ্রিসের পক্ষে যুদ্ধ করেন। বায়রনের বিখ্যাত কর্মের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ বর্ণনামূলক কবিতা ডন জুয়ান এবং চাইল্ড হ্যারল্ড’স পিলগ্রিমেজ এবং ছোট গীতি কবিতার মধ্যে রয়েছে ‘শি ওয়াকস ইন বিউটি’। ইংরেজি সাহিত্যের সবচেয়ে আলোচিত কবিদের একজন লর্ড বায়রন। মূলত রোমান্টিক ঘরানার এ কবির জন্ম ব্রিটেনের লন্ডনে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু হয় একজন গ্রিক বীর হিসেবে। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন কারণে ইংল্যান্ড ছাড়েন বায়রন। অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন গ্রিসের স্বাধীনতাযুদ্ধে। একসময় তিনি আবিষ্কার করেন গ্রিক নেতাদের অন্তর্দ্বন্দ্বই স্বাধীনতার পথে প্রধান অন্তরায়। ১৮২৩ থেকে এই দ্বন্দ্ব মেটানোয় মনোনিবেশ করেন তিনি। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে অসুস্থ হয়ে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ এপ্রিল, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মারা যান। গ্রিসের অ্যাটোলিয়ায়। বায়রনই বলতে পেরেছিলেন, “স্বাধীনতাকামী যে কোনো জাতির পক্ষে লড়াই করে জীবন দেওয়া অনেক বীরত্বের।”

এ সম্পর্কিত আরও খবর