আজকে এত বছর পর হামিন যখন স্কুলের ভূগোল গাইড বইটা খোলে ভিতরে চিরকুটটা পায়।
তার গায়ের লোম খাড়ায় যায়। সে স্কুলের বেস্টফ্রেন্ড আসাদরে ডাকে। তারপর মসজিদের মধ্যে নামাজের পর আসাদরে আরো কাছে নিয়া আস্তে গোপনে শার্টের পকেট থেকে চিরকুটটা বের করে দেখায়।
“দুষ্টু,
স্কুল ছুটির পর থাকব পুকুরপাড়ের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। এসো।
–দুষ্টুর মম”
আসাদঃ মম?!
হামিন জোরে কল্লা নাড়ে।
আসাদঃ কারে দিসে?
হামিন উত্তেজনায় ভুইলাই গেসে ব্যাকগ্রাউন্ড কইতে।
হামিনঃ আমার ভূগোল বইয়ে।
আসাদ একবার চিরকুটটা একবার হামিনের দিকে তাকায়। ভালো করে।
“এখন?”
হামিন নিশ্চিত করে কয়, যাব।
পারলে তখনি ছুটে যায় হামিন।
আসাদঃ কেমনে দিল? কই পাইলি তারে?
হামিনঃ তারে পাই নাই তো...
অতি উত্তেজনায় আসলেই সব গুইলা খায়া ফেলসে হামিন। “আরে খাড়া খাড়া খাড়া” হামিন আসাদরে খাড়া করায় মনে করার ট্রাই করল।
হামিনঃ ক্লাস নাইনে মম একবার আমার কাছ থেকে বইটা নিসিল।
আসাদ মুনাজাত ধরে। মুনাজাত শেষ কইরা হামিনরেসহ নিয়া বাইর হয়।
দুইজনে মাঠের ডাব বেচতেসিলো, ডাব খাইতে খাইতে আসাদ এনশিউর করে, ক্লাস নাইনে?
এখন তারা কলেজে।
হামিনঃ হুম, ক্লাস নাইনে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় আমি ভূগোলে হায়েস্ট নাম্বার পাইসিলাম মনে আছে? তখন।
আসাদ মনে করতে পারলেও ঘটনার লগে কানেক্ট করতে পারে না।
আসাদঃ এতদিন আমার কাছে লুকায় রাখসিলি।
হামিনঃ না, আমি পাইলাম আজকে। বাসা থেকে পুরান সব বই খাতা বের করসে বেচবে, তখন। আমি নস্টালজিক হয়া না, কী বুঝে ঘাঁটতেসিলাম।
আসাদ কিছুক্ষণ ধরে তাকায় থাকল।
হামিনঃ আমি ঐ জায়গায় যাব।
আসাদ হাসল।
“এখন? এত বছর পর?!”
হামিনের মাথা আউলায় গেসে। এত বছর পর কোথায় কী? কোথায় মম?
হামিনঃ না। ঐ জায়গায় তো এখন নাই। মমরে খুঁইজা বাইর করতে হবে আগে।
আসাদঃ শুনসি ও চট্টগ্রামে থাকে।
হামিনঃ কই শুনলি?
আসাদঃ আমার সাথে একদিন দেখা টিএসসিতে।
হামিনঃ কই বলিসনি তো।
আসাদঃ আমি কি জানি নাকি তোর এই ব্যাপার।
হামিনঃ চট্টগ্রাম কোথায় জানিস?
আসাদঃ খুলশির দিকে। তাও তো অনেক বছর আগে। এরপর আর জানি না।
হামিনঃ একটা সূত্র তো পাওয়া গেল।
আসাদঃ যাবি? এখন কোথায় আছে। বিয়া টিয়া হয়া গেসে নাকি!
হামিনঃ বলিস কী?! ধুর ব্যাটা! ভালো স্টুডেন্ট ছিল। পড়া শেষ না কইরা এত তাড়াতাড়ি বিয়া করব না।
আসাদঃ কইলাম আর কি! এত বছর পর…
হামিন যাবে না বলেও ঐ জায়গায় যায়। ঐ স্কুলে যায়। স্কুলের পাশে একটা পুকুর ছিল। ওপারে কৃষচূড়া গাছটা। এখন পুকুর নাই। বিল্ডিং উঠতেসে। গাছটা আছে।
কী মনে করে নিচা হয়া মাটি, ঘাস হাত দিয়া ছুঁইয়া ছুঁইয়া যায়। গায়ে কারেন্টের মতো বিঁধে। তার অনেক কিছু মনে পড়ে।
হামিনও মুটামুটি ভালো ছাত্র ছিল। পড়ালেখার লাইগা মাইর খাইতে হয় নাই। একবার বিশৃঙ্খলার কারণে ম্যাডাম তারে পিটাইসিল। সেদিন সে খুব লজ্জা পাইসিল। হামিনের পেটভর্তি মানসন্মান। সেদিন ক্লাস শেষে বাসায় ফেরার পথে কোত্থেকে মম আসল বান্ধবীসহ। সান্ত্বনা দিতে। ঐটাই কি প্রথম কথা মমর সাথে? কোনো কথা খুঁইজা না পাইয়া বা ঐ কথা না তুইলা হামিনরে জিগাইসিল,
“কই যাবা? বাসায়?”
চড়া মানসন্মানওয়ালা হামিন সবার সামনে পানিশমেন্ট খাইয়া এম্নিতে বেইজ্জতির মধ্যে। মম আইসে সফট একটা মন নিয়া সেটারেই হামিন কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো লাইগা খোমায় বিরক্তির ভাব নিয়া তারে করসে অপমান।
“ধুর! কই যাব আবার? নাচতে।”
খুব খারাপ। সেইদিনের কথা ভাইবা আরেকবার খারাপ লাগে হামিনের। অনেকবার ভাবসিল, মাফ চাইয়া নিবে, পারে নাই। আহা! মমর সেই চোখ! আর কোনোদিন কি সুযোগ পাবে না হামিন?
মম ডাইকা কি কইতে চাইসিল?
মম প্রায়ই কাছাকাছি এসে কেমন করে জানি তাকাত। কেউ খেয়াল করত না। কিন্তু হামিনের কেমন জানি লাগত। মনে হইত কিছু কইতে চাইত? সে বুঝে নাই। এখন বুঝতেসে কিছু কইতে চাইত।
সায়েন্সের প্র্যাক্টিক্যালে ল্যাব-এ আলুর অভিস্রবণ প্র্যাক্টিক্যালের সময় মম বান্ধবীকে আমাকে দেখায় দিলে বান্ধবী আইসা আমারে কয়, আমার আলু লিক হয়া গেসে। একটু করে দিবেন?
ইজ্জতের প্রশ্ন আবার। হামিনের আলুও কাজ করতেসিল না। মাইয়ার আলুর সমস্যা না। হুদাই ডিস্টার্ব করতে আইসে।
হামিন আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় দিকে আসে। কী করবে?! ‘কই যাই কোথা যাই’ অবস্থা!
কী কথা? কী কথা?
ফেসবুকে খোঁজে। প্রভাতি স্কুলে বা স্টুডেন্টসদের খোঁজে। কয়েকটা বন্ধুর লগে ফোনে, ফেসবুকে নক করে। ইনাইয়ে বিনায়ে এই কথা সেই কথার ভিতরে ফাঁক দিয়া মমর কথা তোলে।
“আচ্ছা ঐ মাইয়াটার নাম জানি কী? ডিফিডিং করত?”
অপরপ্রান্তে সুজনঃ লাভলি ঘোষ?
লাভলি ঘোষটা আবার কে?
হামিনঃ তুই লাভলি ঘোষের পিছে ঘুরতি না? আরে ঐ ম...ম... কী জানি?
সুজনঃ অ আচ্ছা, মোর্শেদ…
হামিনঃ বেটা, ঐ যে ঐ মেয়ে, এ প্লাস... মম না কী জানি…
সুজনঃ মনে পড়সে মনে পড়সে…
হামিনঃ হ্যাঁ হ্যাঁ। কী খবর তার।
সুজনঃ আরে তার লগে দেখা হয় তো।
সুজন গেণ্ডারিয়ার একটা এড্রেস দেয়। এড্রেস নিয়া আবোল তাবোল কইয়া কোনোমতে রাখে হামিন। আরে, পাইয়া গেছেরে... আসাদরে জানাইতে হবে। না, এখন না।
চিরকুটটা নিয়া, নতুন একটা ট্রিশার্ট পইরা, ডিউ স্প্রে করে বডিতে।
ভাবে, তারে দেখলে কী করবে মম? সেই-ই বা কী করবে?
তার গা দিয়া একটা উথাল পাথাল ঢেউ খেইলা যায়। আচ্ছা, চেহারা তো একই থাকবে, না? আসাদের কোম্পানি নিতে পারলে ভালো হইত। কিন্তু সে দেশে নাই। শিপে উইঠা গেসে, এখন সমুদ্রের মাঝখানে।
বিকালবেলা ফুরফুরা বাতাসের মইদ্ধে হামিন রিক্সা নিয়া রওনা দেয় গেণ্ডারিয়ার দিকে। আবহাওয়াটাও সেই। তার অনূকুলে। রোমান্টিক।
জায়গামত গিয়া যারে পায় সে মম না। সুমনা। মমরে চিনতে পারসে। কিন্তু তার ব্যাপারে কিচ্ছু জানে না। এটা কোন এম্ব্যারাসিং-এ ফালাইলো সুইজইন্নার বাচ্চা।
যাবার সময় শাহবাগ থাইকা ফুল নিবে ভাবসিল। বাঁইচ্চা গেসে।
পকেটে হাত দিয়া চিঠিটার অস্তিত্ব ফিল করে। তারপর আইসা সোহরাওয়ার্দীর এখানে চা খায়। মাঠে, ঘাসে শুইয়া থাকে। আকাশে মমর পাশাপাশি সুজইন্নার চেহারাও ভাসে। শালা মজা নিলোনি!
কানে হেডফোন দিয়া না হওয়া প্রেমে ছ্যাঁকা খাইয়া ছ্যাঁকা খাওয়া গান শোনে হামিন।
“মাইয়ারে মাইয়ারে তুই অপরাধীরে, আমার যত্নে গড়া ভালোবাসা দে ফিরায়া দে…”
গানটা খুব হিট যাইতেসে।
ভুরভুরায় কান্না পায় তার। কই কান্দা তো আসে না, পানি বের হয় না।
একবার হামিনের জন্মদিনে মম একটা প্যাকেট নিয়া পিছে পিছে ঘুরসে। নাইনের শেষের দিকে নাকি নিউ টেনের শুরুর দিকে। হামিন খুব বিরক্ত হইসিল। বন্ধু আসাদ আর হামিন পণ করসিল তারা প্রেম করবে না। প্রেম খুব খারাপ। কোনো মাইয়ারেই পাত্তা দেয়া যাইবে না। কিন্তু মন চাইত। হামিন মনে মনে মমরে চাইত। স্বপ্নে দেখত মম তারে লাভ লেটার দিবে। লিট্যারেলি স্বপ্ন দেখত ডাব গাছের নিচে সে আর মম শুইয়া আছে। ডাব রোমান্টিক কিনা বা কেন ডাব গাছ হামিন জানে না। হয়তো স্কুলের চারপাশে ডাব গাছ। এই পরিবেশের বাইরে তো মমরে দেখে নাই।
এসব স্বপ্নে সে নিজেই এত শরমিন্দা হইত যে, একমাত্র ক্লোজ ফ্রেন্ড আসাদরেও কইত না। প্রেমে ফান্দে পড়া যাবে না। তাতে পড়ালেখার ক্ষতি হবে। স্কুলে খুব গ্র্যাভিটি নিয়া চলত তারা দুইজন।
ততদিনে মমর একটা ল্যাঞ্জা হইসে। সানা নামে এক পোলা তার পিছে পিছে ঘোরে। বইন পাতাইসে। মম তারে ছোটভাই বানাইসে। মমর ছোটখাটো, বড়খাটো সব কাম এই সানা কইরা দেয়। সেই সানা কইত্থে ঠিকানা নিয়া হামিনের বাসায় আইসা হাজির। মমর লগে এক্সট্রা খাতির দেখে হামিন তারে দেখতে পারত না, এখন আবার বাসায় হাজির। এক সারপ্রাইজ নিয়া আইসে। আমারে ঐ প্যাকেটটা দিসে। তারে বাইরে দাঁড় করায় কইল, খাড়া। ভিতরে গিয়া প্যাকেট খুইলা দেখে গানের সিডি। প্লেয়ারে চালাইল। একটা গান শুনল, টাইনা টাইনা কয়েকটা শুনল। খাস্রা খাস্রা লুতুপুতু রোমান্টিক গান। হামিন আবার বাইরে আইসা সিডি দেখায় কইল, কিরে! এইটা কী?
সানা একগাল হাসি দিয়া কইল, একজন দিতে কইসে।
হামিনঃ খেতা পুরি তোর গানের…
কইয়া আছাড় দিয়া ভাংতে নিসে। সানা ‘হা’ ‘হা’ কইরা উঠল,
“হামিন, এটা মম দিসে। তোর জন্য বাছাই কইরা কইরা গান রেকর্ড করসে। আমারে বলসে...”
হামিনঃ এইত্তোর গুষ্টি কিলাই। তোর কী? তুই এটা নিয়া বাসায় আইছিস কেন?
সানাঃ দেখ, এত দেমাগ।
হামিনঃ তাই? কইস তারে
সানা মজা পায় মনে হয়। হাসতে হাসতে বোঝানোর ট্রাই করে, দেখ এত গরমের কী আছে বুঝতেসি না।
হামিনঃ তুই আর কোনো কিছু নিয়া আসবি না। আর বাসায়ও আসবি না।
সানা হাসে। সে এরকম। অপমান নিয়াও হাসে। তারপর চলে যায়।
হাসতে হাসতেই হয়তো সে মমরে বলসে। বাট এটাও বেশি বেশি হয়া গেসে হামিনের। এর পানিশমেন্ট সে পাবে, মাফ নাই।
তার আগে মমরে খুঁইজা বাইর করতে হবে।
আচ্ছা, সানারে পাইলে তো একটা গতি হবে। এসএসসি কোচিং একসাথে একবেঞ্চিতে বইসা পড়সে। এসএসসি এক্সামে একসাথে আসা যাওয়া করসে, পারলে মমর লগে মাইয়াগো কম্পার্টমেন্টে বসে। ফেল করসিল যদিও মমর সেই পাতাইন্না ছোট ভাই।
সানারে পাইলে নিশ্চিত কাজ হবে।
এবার খোঁজ দ্য সার্চঃ সানা।
কোনো হদিসই নাই। লাইগা থাকলে কী না হয় সানার খোঁজ পাওয়া গেল। শালার পুত, কী কামে জানি জেলে। এক অমোঘ টানে সেখানেই গেল হামিন। যথারীতি হাসতেছে খবিসে। ঘেন্নায় হামিনের গা গুলায় আসে।
ডিরেক্ট তো মমর আলাপে যাওন না। তারে কেউ দেখতে আইসে, সে এক্সাইটেড। তারপর হামিনরে কয়, একটা কাম করে দিতে পারবি?
হামিনঃ আমি কোনো কাজ কাম করতে পারুম না।
সানাঃ আরে বেটা, পারলে পারবি করলে করবি। তুই যেহেতু জেল পর্যন্ত আইছস, এটাও করবি। মমরে তারে একটা জিনিস দিতে হইব।
হামিন ঝাঁকি দিয়া ওঠে।
“মম কই?”
সানাঃ তুই জানিস না?
হামিনঃ না। তুই জানিস?
সানাঃ না। আমিতো জেলে। দেখ না একটু...
“কম্মকাবার!” জীবনে জেলে আসে নাই। কার লগে দেখা করতে আইলো।
হামিনঃ আমার লগে কোনো যোগাযোগই নাই। লাস্ট কাছাকাছি দেখা ঐ এসএসসির কোচিং-এ।
ক্লাস টেনে টেস্ট পরীক্ষার পর হঠাৎ আর দেখা হইব না ভাইবা হামিনের স্কুলের লাইগা, ফ্রেন্ডদের লাইগা এবং স্পেশালি মমর লাইগা বুক হু হু করে উঠসিল। মম এসএসসির যেখানে কোচিং করে এক ছুতায় গেসিল হামিন। মমর সাথে যদি দেখা হয়া যায়। মম যদি ডাইকা কিছু কয়। বা সে যদি কইতে পারে। গেসিল। কিছু হয় নাই। নিজেদের স্কুলের, অন্য স্কুলের পোলাপানরা ছিল। হাসাহাসি করতেসিল।
হামিনের সুইডেন যাবার ব্যাপারে চেষ্টা চরিত্র চলতাসে। মম চ্যাপটার ক্লোজ।
এভাবে বছর চইলা গেল। ঈদে আসাদ দেশে ছিল। দেখা হয়। তারা দুইজন ঘুরাঘুরি করে। আসাদের ভাইয়ের বিয়া। বিয়ার সূত্রে আর হামিনের বিদেশ যাত্রার সূত্রে দুইজনে পুরান বন্ধুদের লগে দেখা করে। কিন্তু মমর কথা তোলে না। কেউ কয় না। হামিনও না। জম্পেশ আড্ডার পর সবাই চইলা যায়।
সুইডেন যাবার আগে শেষ মুহূর্তের ছুটাছুটি, চরম রাশ যায় হামিনের। আগের দিন কাগজপত্র গোছাইতেসিল। একটা কল আসে। হামিনের খুশিতে মুখ হাইসা ওঠে। প্রভাতি স্কুলের পুনর্মিলনী।
হামিন কোনো কিছু চিন্তা না করে জিগায়, মম আসবে?
আরো পড়ুন ➥ মহুয়া ║ হুমায়ূন সাধু