মহুয়া



হুমায়ূন সাধু
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পরিত্যাক্ত ফ্ল্যাটটাতে ভূত আছে এমন গুজব আছে।

তার পাশে গোরস্থান। ভাড়া সস্তা তাও কোনো ভাড়াটিয়া আসে না। পূর্বে যারা ছিল, তারা অনেকে অনেক কিছু দেখছে। রাতের বেলা জানালায় কারে বলে দেখত। চাপা পড়া মানুষের গোঙ্গানি শুনা যাইত। শীৎকার তো। যা শুনে কাম জাগত না, লোম খাড়ায় যাইত। কে শখ করে এসব সাউন্ড শুনতে যাবে! লাস্ট টাইম রুবেলরা ছিল। মধ্যরাতে বলে ঘুম থেকে উঠে দেখে শূন্যে ভাসতেছে। যাবার সময় কোনোমতে লুঙ্গি পইরা বাইর হইছে।

সাদেকের খুব শখ ভূত দেখে। ভূত দেখার আশায় একদিন সারারাত শ্মশানে বইসা ছিল। কিচ্ছু দেখে নাই। উল্টা পরদিন তারে দেইখা বন্ধুরা দৌড়াইছে। গল্প শুনতে শুনতে ছোটবেলা থেকে ভূত আবিষ্কারে বের হওয়া তার একটা অ্যাডভেঞ্চার। ভূত-মুতে তার বিশ্বাস নাই। সে থাকে একা, লাইফে একটুস থ্রিলের দরকার আছে। একদিন নির্জন দুপুর বেলায় চইলা গেল সেই ফ্ল্যাটের ছয় তলায়। এখানে এক কিশোরী ফাঁস নিয়া আত্মহত্যা করছিল। ক’দিন কারা জানি তাশ পিটাইতে এই ফ্ল্যাট দখল নিছিল। তাদের মধ্যে মার্ডার হইছে। সাদেক আসছিল, যেহেতু ভাড়া কম। কিন্তু মালিক নতুন সিদ্ধান্ত নিছে, এই বিল্ডিং সেল করে দিবে।

ফ্ল্যাটের কলাপ্সিবল গেট লক। চারিদিকে নীরব। সে ঘুরে এসে অতি উত্তেজনার ঠেলায় কায়দা করে পিছনে পঁচা-ডোবা দিয়া লটকে লটকে ব্যালকনি দি উপরে উঠে গেল। নিজেরে বেয়ার গ্রিল ফিল লাগে। উঠে গেল কিন্তু ব্যালকনি থেকে ভেতরে ঢোকা যায় না। লাগোয়া একটা রুম আর এটাচ্‌ বাথ আছে। রুমের সোজা দরজা দিয়ে আরো ভিতরে দেখা যায়। ভিতরে কিছু কাঠ-কুঠ ছাড়া কিচ্ছু নাই। একটা ইন্দুরও না। উঁকি দিয়া যতটুক দেখা যায়। নাহ্‌, বরাবরের মতো হতাশ হইতে হয় সাদেকরে। কিছুক্ষণ সেখানেই খাড়ায়া সিগারেট ধরায় সে। হিম হিম হাওয়া আসে। ব্যালকনি থেকে বাইরের ভিউটা সুন্দর লাগতেছে। পানা-মজা ডোবাটাও ওয়ান্ডারফুল লাগে। মোবাইলে ছবি তোলে। সিগারেট শেষ করে নামতে যাবে, নিচে মানুষের আওয়াজ পায়। সে নামে না। নিজেকে আড়াল করে অপেক্ষা করে। একে তো ভূতের ব্যাপার নির্ঘাত তাকে ভূত ভেবে কেলেঙ্কারী হবে। আগুন টাগুনও দিয়া বসতে পারে। অথবা, চোর টোর মনে করে গণধোলাই দিলে ইজ্জত পাংচার। অথবা এমনও হতে পারে ওরা চোরা-কারবারি, ড্রাগস্‌ ডিলার। যদি সে দেখে ফেলে, যদি তারা সাদেকরে দেখে ফেলে—আর দুনিয়া দেখতে হবে না। ফানা। বুকে থুথু দেয়। গোয়েন্দা প্লট হয়ে যাচ্ছে নাকি? ব্যালকনি পুরান জিনিসে ভর্তি। সাদেক খুঁটি ছাড়া একটা ভাঙ্গা সোফায় বসে রেস্ট নেয়।

কখন ঘুমায় পড়ছে কখন সন্ধ্যা হয়া গেছে খেয়ালই করে নাই। উঠে নিচে তাকায় দেখে কেউ নাই, নামতে যাবে এমন সময় ‘গসগস’ শব্দ। ‘শব্দটা কিসের’, ‘কোনদিক থেকে আইছে’ বোঝা যায় না। সে একটু অপেক্ষা করে। কিছু খাওয়ার শব্দ। ভিতর থেকেই তো! হইতে পারে কোনো বিড়াল, কুকুর। পরক্ষণেই মনে হয় বিড়াল, কুকুর আসবে কোত্থেকে? ঢুকবে কোনদিক দিয়া? সাদেক ব্যালকনি দিয়ে উঁকি দেয়, একটা ক্ষীণ আগুনের মতো দেখা যাচ্ছে।

ধুম করে তার মনে বাড়ি খায়, তাহলে সবার মতো সেও দেখতে পাচ্ছে!? সবাই যা বলে সত্যি?! নাকি আলো, আঁধারিতে তার হেলুসিনেশান হচ্ছে? আগুনটারে ফলো করে সে। শুধু একটা আগুন বাথরুমের দিকে ঢুকে। বাথরুমের উইন্ডোর দিকে চোখ দিয়ে সাদেকের চক্ষু চড়কগাছ। ফিট খায়া যাবার দশা।

নগ্ন একটা মেয়ে। ইরোটিক ফিল আসার বদলে তার বডি দিয়া কারেন্টের একটা ঝনঝনানি বয়া যায়। লিটারেলি দাঁত ঠকঠক করে। হাতড়িয়ে ব্যালকনিতেই একটা রঙমোছা কাপড় ছিল সেটা মুখে গুঁজে কোনোমতে সামলায়। রঙের গন্ধটা গায়ে লাগে না।

এখন গোসলের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। অন্যপাশে হেলান দিয়ে বসে থাকে সাদেক। এমএমএস বানায় ফেলবে নাকি? ভূতের এমএমএস? সাহস করে বানায় ফেললে হেব্‌ভি মার্কেট খাবে। সে এখনো স্ট্রংলি বিলিভ করে এটা ভূত না। অন্য কাহিনী আছে। কাহিনী বাইর করতে হবে। সাদেকের ব্রেইন তছনছ খায় গেছে। গুছায় নিতে পারে না। রুমের এলুমিনিয়াম ডোর আস্তে আরেকবার ঠেলার ট্রাই করে। এইসময় তথাকথিত ভূত বের হয়। ভূত, পেত্নি, পরী, রহস্যময়ী যা-ই হোক বাথরুম থেকে বের হইছে। গুনগুন করে গানও গায়—“একটা ছেলে মনের আঙিনাতে, ধীর পায়েতে এক্কা দোক্কা খেলে, বন পাহাড়ী ঝর্না খুঁজে, বৃষ্টি জলে একলা ভিজে, সেই ছেলেটা আমায় ছুঁয়ে ফেলে।”

ভূতে এত সুন্দর গায়! আউটস্ট্যান্ডিং! এইটা কাউরে কইলে তারে বিশাল পাগল বলবে। বাট এভাবে ছাইড়া দেওন যাইব না। সাথে মেশিনপাতি কিচ্ছু নাই। পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়া আবার আসতে হবে। ডাইরেক্ট অ্যাকশন হবে।

পরদিন

সন্ধ্যা হয় হয়। সাদেক কোমর বেঁধে নামছে। সেফটি দড়ি দিয়া উপ্রে উঠে জায়গামতো পজিশন নেয়। আসার আগে সাধুরে কয়ে আসছিল। ‘কী থেকে কী হয়’—একজন সাক্ষী থাকা দরকার। সাধু এটা নিয়া লিখে জাতিরে জানাবে।

সাদেকের পিঠে ব্যাগ, ব্যাগে টুকটাক জিনিস। দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়া ব্যাগ থেকে স্ক্রু-ড্রাইভার বের করে এলুমিনিয়ামের স্লাইড ডোরটা ফাঁক করতে যাবে—এই সময় মেয়েটা মানে কালকের ভূতটা ডোরের কাছে আসে। সে কি ধরা পড়ে গেছে? এখন কি সাদেক আক্রমণ করবে? দ্রুত ভাবে সাদেক। অনামিকা মেয়েটা স্লাইড ডোরটা খুলে হাল্কা বাতাস নেয়। তারপর ওখান থেকে সরে যায়। সাদেক কনফার্ম হয় মেয়েটা সরে গেছে। কিছুক্ষণ ওয়েট করে। এইটাই তো সে চায়। যে-ই হোক রিস্ক তো লইতেই হবে। রড দিয়া খুলতে গিয়া দেখে স্লাইড ডোর খোলা। হাল্কা খুলে দ্রুত ভিতরে ঢুকে পড়ে। সাবধানে পা ফেইলা মেয়েটারে খঁজতে খুঁজতে ঘরের ভিতরের দিকে যাইতে থাকে। কোত্থাও কেউ নাই। হাওয়ায় মিলায়ে গেলনি?!

ড্রয়িংরুমের দিকে এসে দ্রুত একটা পিলারের পিছনে লুকায় পড়ে সাদেক। কল্লাটা বের করে দেখে ভূতে চারপাশে মোমবাতি জ্বালায়ে ইয়োগারত। হাঁটু পর্যন্ত স্কার্ট বা ঘাগড়া তোলা এক পায়ের ওপর আরেক পা। দুইহাত দুইদিকে আঙ্গুলের বিশেষ ভঙ্গিমা। চোখ বন্ধ। ইয়োগাই তো। ভূত ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছু মনে আসে না, যদিও সাদেক নিশ্চিত ভূত না। এই সুযোগে ঝাপায়ে কি পড়বে? ইয়োগার সুবিধা নিয়া পিছন থেকে ঝাপায় পড়ল... নিজেকে ভীরু ভীরু লাগে। কুলহুআল্লাও পুরাটা মনে করতে পারে না। সাদেক ব্যাগ খুলে ক্লোরোফর্মের বোতলটা খোলে। বারবার মনে হয় ভূতটা তার পিছনেই। হঠাৎ একটা শব্দে মেয়েটা সতচকিত হয়ে ওঠে। আর অপেক্ষা করা বুদ্ধিমানের কাম হবে না মনে করে সাদেক ক্লোরোফর্মসহ ঝাপায় পড়ে। মেয়েটা জাস্ট একটা চিৎকার দিয়ে দৌড় দিতে নিলে গায়ে থাকা উপরের জামা পড়ে যায়। সাদেক তার হাত ধরে ফেলে। কিন্তু ক্লোরোফর্ম ছিটকে পড়ে। কার হাত ধরে আছে এখনো নিশ্চিত না। সাদেকের শরীর থরথর কাঁপতে থাকে। কী বলবে মেয়েটাকে? মেয়েটাও কিছুই বলে না। ব্যাপারটা কি রেইপ কেসের দিকে যাচ্ছে? সে তো মোটেই সেই টাইপ না। এটা মেয়েটারে বুঝানো উচিত। মেয়েটা শুধু গোঁ গোঁ করে। এটা মানুষও না, ভূতও না। এটা কোন জাতি? এলিয়েন জাতীয় কিছু? পরে দেখা গেল কোনো পাওয়ার টাওয়ার আছে তারে মাইরা দিল। এলিয়েনে বিশ্বাস করে সাদেক।
সাদেক : হোয়াটজ ইয়্যোর নেইম?
শালার ইংলিশই বাইর হইল কেন তার মুখ দিয়া! এলিয়েন ইংলিশ জানলে বাংলাও জানবে।
এলিয়েনটা শুধু একটা শব্দ কইল, ছারিদুয়াঁরে।
: এইটা কী ভাষা?
এলিয়েনটা বলেই যেতে থাকে ‘ছারিদুয়াঁরে, ছারিদুয়াঁরে।’

বাংলা ফিল্মের মতো ঘুরতে থাকে দুইজনে। মাটিতে গড়াগড়ি হইলে ব্যাপারটা পারফেক্ট হইত। ব্যালকনি দিয়া শিরশির বাতাস ঢুকতে থাকে। সাদেকের মনে হয় এখানে আরো কেউ আছে। হয়তো তার পিছনেই। একটা ছায়া দেখতে পেয়ে সে শট করে মেয়েটাকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে ঘুরে দাঁড়ালে দেখে পিছন দিকে লুঙ্গি পরা একজন মোটা কাঠ হাতে জাস্ট তার মাথায় বাড়ি দিচ্ছিল...

ষাঁড়ের মতো চিৎকার দিলে বোঝা যায় একটা ছেলে। উন্মাদ ছেলে। আলো আঁধারিতে খেলা চলতেছে। সাদেক মেয়েটার গলায় প্যাঁচায়ে রডটা ধরে। এত ভায়োলেন্ট তাকে কখনো হইতে হয় নাই। ইন ফ্যাক্ট তার ইন্টেশনও ছিল না। কী করার? এরমধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়া গেল। ছেলেটাকে দেখে মেয়েটা আরো একরোখা হয়ে গেল। ওরা কি এই দুইজন? নাকি আরো আছে? সাদেক আঁচ করার ট্রাই করে। ধস্তাধস্তি করতে গিয়া পারা গেল না, একটা কাঠের বাড়িতে মাথা ঝিলমিল করে চোখে ঝাপসা দেখতে লাগল সে।

অনেকক্ষণ পর হুঁশ ফিরলে সাদেক দেখে সে ভিতরে অন্য একটা রুমে বান্ধা। রুমটা মোটামুটি গুছানো, বিছানাপাতা সুন্দর। একটা স্টোভের মতো আছে। ওরা দুইজন তার সামনে মোটা কাঠসহ দাঁড়িয়ে। সে কী করবে? বেহুঁশের মতো থাকবে? তারা তাকে নিয়ে কী করবে? ভাবাই যায় না। দূরে ছোট্ট একটা মোমবাতির জ্বলতেছে। তাতে পোলাটার (পোলা না কি!?) মুখ ভালো বোঝা যায় না। তবে মেয়েটারে অপার্থিব সুন্দর দেখায়। আগেও অবশ্য দেখছে মেয়েটারে, খালি গায়ে। সাদেককেই শুরু করতে হবে, এইটার একটা শেষ করতে হবে। আর তাকে বুঝাইতেও হবে সে হার্মফুল না, বিশিষ্ট ভদ্রলোক।
: এক্সকিউজ মি! হু হু হুয়ার ইউ?
সে তোতলাচ্ছে কেন? এটা নার্ভাসনেসের লক্ষণ। দুর্বলতা প্রকাশ করা যাবে না। পাল্টা প্রশ্ন আসে, এবং খাঁটি বাংলায়—
: তুমি কে? এখানে কী চাও? চুরি করতে? এখানে ভূত থাকে জানো না?
ভূতে ভূতের কথা কয়! ঘাপলা আছে।
সাদেক : আমি? চুরি? না না, একদম না। আমি চোর না।
ওদের একটু ইন্সিকিউরিটিতে ফেলে দেবে নাকি?
: তোমরা এখানে কেন? এটা আমাদের...
পোলা : একদম কল্লা নামায় দেব।
একটা ঢোঁক গিলে মেয়েটার দিকে তাকাইলে দেখা যায় মেয়েটাও ফুঁসতাছে।
সাদেক : দেখো, আমি একদম সাধারণ একটা মানুষ। কোনো মারামারিতে নাই, এখানে আসার উদ্দেশ্যও খারাপ না...
ওরা একে অপরের দিকে তাকায়। বিশ্বাস না করে উপায় নাই বোধ হয়। ওদের মনোভাব বুঝার জন্য ‘পানি খাবে’—বোঝায়। দিলে ঠিকাছে না দিলে ঝামেলা আছে।

সে আবার শুরু করে : আমি ব্যাচেলর। বিশিষ্ট ভদ্রলোক। এটা ভাড়া নিতে চাইছিলাম। জানেনই তো ভূতের আছর বলে... ভূতের হইলে ভূতের আমি ডিটারমাইন আমি থাকব। সবাইরে দেখাইতে আসলাম এখানে কিছু নাই, আমি থাকতে পারি।

মেয়েটা মুখের সামনে একটা গ্লাস ধরে। পানি আসে। ছেলেটা ‘খাড়ো’ বলে একটা দা নিয়া আসে। দড়িটা কাটে, তারপর দা নিয়া সামনে খাড়ায় থাকে।
এখন ওদের হাতে অপশন থাকে সাদেকরে মাইরা ফেলা। সবাই জানবে ভূতে খাইছে। কিন্তু মনে হয় না মারবে। নিজেরা নিজেরা আলাপ করে, ‘এহন ফুয়াবিরা লই কিত্থ হদ্দে।’
অরাও বিপদে। ছেলেটা কাছে আসে,
: অই বিশিষ্ট, কী করো? এখানে কী?
সাদেক : বললাম তো, এমনেই... আমি টিচার। কম্পিউটার শিখাই, গ্রাফিক্স, প্রোগ্রাম, সফটওয়্যার...
সাদেকের ব্যাগ ঘেঁটে আইডি কার্ড, সিডি দেখে। এবার কিছুটা নমনীয় হয় অচেনা ছেলেটা।
ছেলেটা : দেখেন (আপনি করে), আমি আজিম। চট্টগ্রাম থাকি।
একটু থামে সে। তারাও অসহায় সেটা বুঝায়। বলে যেতে থাকে—
: আমি মায়ানমারে কাজ করতাম। ও মহুয়া, মায়ানমারের মেয়ে। আমরা একজন আরেকজনকে... ও আরো অনেক আগে আসছে বাংলাদেশে আমার সাথে। ওর এখন যাবার জায়গা নাই, থাকার জায়গা নাই। এই জায়গাটা আমরা বেছে নিছি। এখন আমরা বিপদে। সব ঠিক হয়ে আসলে মহুয়ারে বিয়ে করে বাসায় তুলব।

সাদেক সাহস পেয়ে কৌতূহল ঝাড়ে—
: কিন্তু ঢুকলেন ক্যামনে?
: অমা, চাবি দিয়ে। চাবি তো আগেই বানাই নিছি।
তারপর বলে, এখন আপনাকে বিশ্বাস করব কী করে?
এইসময় কোইত্থেকে ডিগবাজি দিয়ে ঢুকে সাধু। হাতে ধরা পিস্তল ওদের দিকে তাক করে। দুইজন ভয় পাইয়া যায়। ছেলেটারে উদ্দেশ্য করে বলে সাধু বলে, দা নামা।
মেয়েটা ভূত বলে চিৎকার দিতে নিয়া মুখে হাত দিয়া ফেলে। সাদেক অবাক এবং বিরক্ত হয়, হোয়াট এ টাইমিং! আরে আইলি আইলি টাইম পাইলি না!
সাধু : ব্যালকনির চিপায় আছিলাম, কাণ্ড দেখতেছিলাম।
সাদেক : আমি মাইর টাইর খায়া বেহুঁশ হয়া গেলাম, আরো কাণ্ড দেখবি?
সাধু (আস্তে আস্তে) : পিস্তলে গুলি নাই বেডা।
সাদেক ওদের দিকে তাকায়। ওরা হাত উঁচা করে দাঁড়ায়ে।
সাদেক উঠে ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে চলে আসতে নেয়। আসার সময় কার্ড দেয়, নিশ্চিন্তে থাকেন। আর কোনো প্রবলেম হইলে কল দিবেন। এখানে নাম্বার আছে। থাকার প্রবলেম হলে জানায়েন। আর আমি এইখানে ভাড়া নিতে চাই। আমি আইসা পড়লে আর প্রবলেম হবে না।

কার্ডটা নেয় আজিম।
সাদেক : দড়ি বাইয়া নামতে পারুম না ভাই সিঁড়ি দিয়া নামুম।
সাধু : দড়ি দিয়া আবার, মাথা খারাপ। উঠতে গিয়া কতক্ষণ লটকায় আছিলাম জানোস?
আজিম হেসে দরজা খুলে দেয়।
সাধু : আপনাদের পরের কাহিনী শোনার অপেক্ষায় থাকলাম।

   

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

বাংলাদেশের বৈশাখি মেলা

  ‘এসো হে বৈশাখ’



সাইমন জাকারিয়া
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশ হাজারো মেলার দেশ। এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রাম-শহর জুড়ে প্রতি বছর এখনও প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত প্রতিটি মেলা আয়োজনের পিছনে কোনো না কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। সেটি হয় ধর্মীয়, নয় ব্রত-পালা-পার্বন অথবা যে কোনো একটি নির্ধারিত বিষয় বা ঐতিহ্যকে স্মরণ করে।

মেলার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে- নির্ধারিত স্থানে নির্ধারিত তারিখ বা তিথি-লগ্নে এক একটি মেলাতে নর-নারী, শিশু-কিশোর এমনকি আবাল বৃদ্ধরাও সমাগম ও সমাবেশ করে থাকে। উল্লেখ্য, একটি জায়গায় অনেক লোকের সমাবেশ ও সমাগম মানেই সাধারণ বাংলা অর্থে মেলা বলা হয়। তবে, মেলার বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে- ব্যবহার্য পণ্য ও গৃহ সামগ্রীর বিরাট সমাবেশ এবং চিত্তবিনোদনের জন্যে যাত্রা, সার্কাস, পুতুল নাচ ইত্যাদির আসর।

আধুনিক এই যুগের খেয়ালে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাসমূহ এখন অনেকটাই তার চরিত্র বদলের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এরমাঝে তাকে নানা উত্থানপতন ও অবক্ষয়ের ধকল সইতে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের মেলাগুলো কিছুতেই তার ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে পুরোপুরি যেতে নারাজ। বাংলাদেশের মেলাগুলো এখন আগের সনাতন চেহারা থেকে রূপান্তরিত হয়ে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। কোভিড-১৯ সংক্রমণ ও অতিমারি কালে বাংলাদেশের বহু ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির মতো মেলাগুলোও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি। তবে, মানুষের জীবিকার চাহিদা ও মননশীল মনের তাগিদে ঐতিহ্যগত মেলাগুলো আয়োজনে সাময়িক বাধাপ্রাপ্ত হলেও কোভিড-১৯ উত্তরকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যগত মেলাগুলো আবার আগের মতো অনুষ্ঠিত হতে শুরু করেছে।

উল্লেখ্য, এদেশের প্রচলিত মেলাগুলির প্রকৃতি বহুবিধ ধরনের। এক বাক্যে তার প্রকৃতি অনুসারে শ্রেণী করণ দুঃসাধ্য। আলোচনার সুবিধার্থে এখানে এদেশে প্রচলিত মেলাগুলির একটি সরল শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। অতীতে বাংলাদেশের মেলা প্রায় সর্বাংশই ছিল গ্রামকেন্দ্রিক, যুগের পরিবর্তনে ধীরে ধীরে সেই চিত্র পাল্টে গিয়ে এদেশের মেলা বর্তমানে গ্রাম ও শহর উভয় স্থানেই ছড়িয়ে পড়েছে।

চারিত্র্য বিচারে এদেশে প্রচলিত মেলাসমূহকে মোটামুটি সাতটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যেতে পারে, যথা- ১. ধর্মীয় উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা, ২. কৃষি উৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা, ৩. ঋতুভিত্তিক মেলা, ৪. সাধু-সন্তের ওরশ উপলক্ষে ফকিরী মেলা ৫. জাতীয় জীবনের বিভিন্ন বরেণ্য ব্যক্তি যেমন, কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ইত্যাদির স্মরণোৎসব উপলক্ষে স্মারক মেলা, ৬. জাতীয় দিবসসমূহ উদ্যাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃৃতিক মেলা, ৭. বাণিজ্যিক সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রয় মেলা। উল্লেখ্য, যেসকল মেলার ঐতিহ্য বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রচলিত আছে এই শ্রেণীবিন্যাসে কেবল সেসকল মেলাগুলিকেই বিবেচনায় আনা হয়েছে। তবে, ভিন্ন বিবেচনায় ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের মেলাসমূহের এমন সরলকৃত শ্রেণীবিভাগকে যে কেউ নতুনভাবেও পুনর্বিন্যস্ত করতে পারেন।

এক

উপলক্ষই বাংলাদেশের মেলা উদ্যাপনের স্বাভাবিক উৎস কথা। কিন্তু উপলক্ষ যা-ই থাকুক বাংলাদেশের মেলার একটা সার্বজনীন রূপ কিন্তু আছেই। এদেশের মেলায় অংশগ্রহণে সম্প্রদায় বা ধর্মের ভিন্নতা কোনো দিনই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বাংলাদেশের সবগুলো মেলাই আর্থ-সাংস্কৃৃতিক বৈশিষ্ট্য ছাপিয়ে মানুষের মধ্যে মিলন কথাকেই প্রকাশ করে থাকে। সে কারণে এদেশের মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল ধর্ম ও শ্রেণীর মানুষের আনাগোনা ঘটে। অতএব, বাংলাদেশের মেলা মানে মৈত্রী সম্প্রীতির এক উদার মিলনক্ষেত্র। নারী-পুরুষ, শিশু -কিশোর সকলেই আসে এই মেলাতে।

এখানে সকলের অভিন্ন আকাক্সক্ষা একটিই, আর তা হলো- মেলা বা আড়ৎ দেখা। যার সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবে আরেকটি বিষয় জড়িয়ে থাকে, তা হচ্ছে-বিকিকিনির আশা আর বিনোদনের টান। মেলাতে গাঁয়ের বধুর ঝোঁক থাকে আলতা-সিঁদুর-স্নো-পাউডার-সাবান আর ঘর-গৃহস্থালির টুকিটাকি সামগ্রীর প্রতি। আরেকটি আকর্ষণ থাকে বিনোদনের প্রতি, আর তা হচ্ছে- যাত্রা, পুতুল নাচ বা সার্কাস প্রদর্শনী দেখা।

তবে, শিশু-কিশোরদের টান থাকে মূলত খেলনার দিকে, যেমন- মাটির পুতুল, কাঠের ঘোড়া, টিনের জাহাজ। শিশু-কিশোরদের আরেক আকর্ষণের বস্তু হচ্ছে- খই, বাতাসা, রসগোল্লা, চমচম, কদমা, খাগড়াই, মুড়ি-মুড়কি, জিলিপি আর দানাদার। তার সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের খেলনা বাঁশির কথাও বলা যায়। মেলার প্রাঙ্গণে গিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু-কিশোরই বাঁশি কিনে থাকে।

বাংলাদেশের মেলার একটি দিকে থাকে অনিবার্যভাবেই বিনোদনের ব্যবস্থা। যেমন- নাগরদোলা, পুতুলনাচ, ম্যাজিক, সার্কাস, যাত্রা, বাউল-ফকির বা কবি গান, বায়োস্কোপ, লাঠিখেলা, কুস্তি, জারিগান ইত্যাদি। কিছু কিছু মেলাকে মাতিয়ে রাখে সঙ-এর কৌতুক ও মশকরা, তারা স্বাধীনভাবে মেলাতে ঘুরে ঘুরে রঙ্গ করে থাকে। এছাড়া, মেলায় বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তাড়ি-মদ আর জুয়ার আসর বসে থাকে। নেশায় এমন ডুবে এবং জুয়ার খেলায় সর্বস্ব হারিয়ে ফেলে অনেকেই। এটা বাংলাদেশের মেলার একটি প্রাত্যহিক চিত্র।

তবে, বাংলাদেশে বর্তমানে চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। এদেশের মেলায় এখন হর-হামেশাই মাইকে বা সাউন্ড বক্সে উচ্চ আওয়াজে গান বাজে। মেলায় পসরা সাজিয়ে বসা দোকানে দোকানে এখন মোবাইল বা ল্যাপটপের মাধ্যমে ইউটিউব থেকে পছন্দমতো গান বেছে নিয়ে তা সাউন্ডবক্সে বাজানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো করা হয়।

সময় বদলের সঙ্গে এদেশের মেলার চিত্র-চরিত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ মেলার রূপ ও মেজাজ অনেকখানিই বদলে গেছে। সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পার্বণ উপলক্ষে এইদেশে যে সকল মেলার আয়োজন হতো তার মধ্যে অনেক মেলার আয়োজন এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এবং অনেক মেলা এখন বিলুপ্তির পথে, কিছু মেলা এরই মাঝে রূপান্তরিত হয়ে নতুন রূপ গ্রহণ করে বেঁচে আছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামীণ মেলাতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। এদেশের গ্রামীণ মেলার স্বাভাবিক ও সাধারণ চিত্র কুটির শিল্পজাত গ্রামীণ পণ্যের বদলে দেশী-বিদেশী চোখ ধাঁধানো বাহারি পণ্যের জৌলূস ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি চ্যানেলে প্রচলিত কাটুনের চরিত্রের মুখ ও নকশা এখন প্লাস্টিক ও বাতাস দিয়ে ফোলানো বেলুনের উপর শহর থেকে গ্রামের মেলায় বাতাসে উড়তে দেখা যায়। বিশেষ করে জনপ্রিয় কাটুন চরিত্র মটু-পাতলু সারা বাংলাদেশের মেলাগুলোতে প্রত্যক্ষ করা যায়। এগুলোই এখন শিশুদের প্রধান আকর্ষণের বস্তু হয়ে গেছে।

এদেশের বহু নাগরিক প্রয়াসের সঙ্গেই বাংলায় প্রচলিত মেলার লৌকিক ধারা এসে মিশেছে। যেমন- বৈশাখীমেলা, ঈদমেলা, বইমেলা, বিজয় মেলা ইত্যাদি মূলত এদেশে প্রচলিত মেলার লোকধারার প্রেরণা নিয়ে নতুন আঙ্গিক ও মাত্রায় আজ নগরজীবনে প্রতিষ্ঠিত এবং তা এর মধ্যেই ঐতিহ্যে পরিণতি লাভ করেছে। এমত ধারায় সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে বিজয়মালা, যা যথার্থ অর্থেই ‘ঐতিহ্য ও আধুনিক চেতনার.. অপূর্ব সমন্বয়’।

দুই

বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর শুরু উপলক্ষে এখানে এদেশের বৈশাখি মেলার অতীত ও বর্তমান চালচিত্র সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ করতে চাই।
বৈশাখ হচ্ছে বাংলা সনের প্রথম মাস। ঐতিহাসিকদের তথ্যমতে, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল থেকে যখন বাংলা সনের গণনা শুরু হয় তখন বছর সূচনার মাস হিসেবে বৈশাখকেই প্রথমে রাখা হয়। অনেকের ধারণা, সম্ভবত তখন থেকেই নববর্ষ উদ্যাপনের অংশ হিসেবে বৈশাখী মেলার সূচনা। বৈশাখী মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এ মেলা ধর্মসম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল বাঙালির মেলা।

বৈশাখি মেলার অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যকে কোনো দিনই কোনো ধর্মের গোঁড়ামী খর্ব করতে পারেনি। যুগ যুগ ধরে প্রচলিত এই বৈশাখী মেলারও রয়েছে অন্যান্য মেলার মতো দুটো দিক। একটি বাণিজ্যিক আর একটি সাংস্কৃতিক। বাংলার ব্যবসায়ীরা চৈত্রের শেষ দিন বা ‘চৈত্রসংক্রান্তি’তে এবং বৈশাখের প্রথম দিনে ‘হালখাতা’ করে থাকে। আসলে ‘চৈত্রসংক্রান্তি’র দিনটা পালন করে বাংলাদেশের মানুষেরা পুরনো বছরকে বিদায় দেওয়ার উৎসব করে থাকে।

এতে মেলা, গান-বাজনা ও খাওয়া-দাওয়ার মধ্য দিয়ে এক আনন্দঘন পরিবেশে বাংলার একটা বছর বিদায় নেয় এবং নতুন একটা বছরের সূচনা হয়। এই দেশে তাই বৈশাখি মেলার সূচনা হয় বৈশাখের আগে থেকেই মানে চৈত্রের শেষ দিক থেকে। তবে, বৈশাখের প্রথম দিনটিই আসলে উৎসবের মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সবাই পরিষ্কার ও সুন্দর জামা-কাপড় পরে। ঘরে ঘরে পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায়। আর ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে ছোটে মেলাতে।

বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে কৃষক, কামার, কুমোর, তাঁতি, ময়রা এবং অন্যান্য শিল্পী-কারিগরেরা যে সব সামগ্রী তৈরি করে, বৈশাখী মেলায় তা প্রদর্শন ও বিক্রি করার সুযোগ এনে দেয়। গ্রামীণ কৃষিজাত পণ্য, মিষ্টান্ন দ্রব্য, কুটির শিল্পজাত পণ্য, মাটি ও বেতের তৈরি শিল্পসামগ্রী প্রভৃতি নিয়ে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা দোকান সাজায় এই মেলায়। বাঁশ ও তালপাতার রঙিন বাঁশি, ভেঁপু, একতারা, দোতারা, ডুগডুগি, বেলুন, লাটিম, মার্বেল, ঘুড়ি-লাটাই, চরকি, পুতুল, মাটির ঘোড়া, কাঠের ঘোড়া, কাঠ, কাগজ ও বাঁশের পাখি, মাটির হাড়ি-বাসন, কলস, কাচের চুরি, পুঁতির মালা ইত্যাদি জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে ছোট ছোট দোকানিরা।

এছাড়া আছে কাঠের আসবাবপত্র, খাট, পালঙ্ক, চৌকি, চেয়ার-টেবিল, আলনা, আলমারি, ঢেঁকি, পিঁড়ি, গাড়ির চাকা প্রভৃতি। মেলায় আরও পাওয়া যায় পিতলের হাড়ি, কলস, বাসন-কোসন, লাঙল-জোয়াল, লোহার দা, বটি, কুড়–ল, খন্তা, কাচি, নিড়ানি, গরুর গলার ঘুঙুর। ময়রারা তৈরী করে নানা রকমের মিষ্টান্নদ্রব্যÑ কদমা, জিলিপি, বাতাসা, খাজা, ছাঁচের মিঠাই, খাগড়াই আরো কতো কি। বলে রাখা ভালো এসব মিষ্টান্নদ্রব্য মেলাতে আগেও যেমন ছিল এখনও তেমনি আছে মেলার প্রচলিত রীতিকে ধরে। মুড়ি, মুড়কি, খই, চিড়ে, ছাচ খাজা, মোয়া, নারিকেলের নাড়–, বুট, চানাচুর, বাদাম ভাজা আর দিল্লির লাড্ডু, মটরভাজা, তিলের খাজা আজও মেলা আগত মানুষের প্রিয় খাবার।

বৈশাখি মেলার আরেক আকর্ষণ হচ্ছে তাঁতবস্ত্র। এই মেলাতে তাঁতিরা নিয়ে আসে নক্সীপাড়ের শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি, গামছা, বিছানের চাদর প্রভৃতি। মেলার একপাশে ছেলেমেয়েদের জন্য তৈরি জামা-কাপড়ও পাওয়া যায়। স্যাকরার দোকানে মেয়েরা ভীড় জমায় রূপা, তামা ও পিতলের গহনা কিনতে। বৈশাখী মেলায় গ্রামের কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের উন্নত জীবন গঠনের উপযোগী কিছু শিক্ষামূলক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকে।

এরমধ্যে রয়েছেÑ পশু প্রদর্শনী, চরকায় সুতা কাটা, গালার কারিগরি, গাছের চারা বা নার্সারি এবং অন্যান্য শিক্ষামূলক প্রদর্শনী। গ্রামের মেয়েদের তৈরি নানাপ্রকার পাখা, মাদুর, কাঁথা, শিকে, বেত ও বাঁশের তৈরি হরেক রকম জিনিসপত্র সাজানো হয়। আর থাকে উন্নত ধরনের শাক-সবজি,উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি, শস্যের বীজ প্রদর্শনী ও কেনার ব্যবস্থা।

যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের মেলার যে রীতি ও ধরন আমাদের দেশে চালু রয়েছে, বৈশাখি মেলা তার সবটাই ধারণ করে আছে। যেমনÑ ১. বহু মানুষের সমাবেশ, ২. গানবাজনাসহ চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা, ৩. গ্রামীণ ব্যবহারিক শিল্পসামগ্রীর প্রদর্শনী ও বিক্রয়, ৪. বিভিন্ন রকমের খেলার আয়োজন।

মেলায় এসে মানুষ আনন্দের উপকরণ খোঁজে। তাই এখানে থাকে আনন্দলাভের নানা আয়োজন। পালাগান, বাউলগান, যাত্রা, কবিগান, গম্ভীরা, আলকাপ, জারিগান, পুতুলনাচ, সার্কাস প্রভৃতি বৈশাখি মেলার প্রধানতম সাংস্কৃতিক দিক। দেশজ খেলাধূলাও যে মানুষকে আনন্দ দিতে পারে তার প্রমাণ মেলে আমাদের বৈশাখি মেলায়। লাঠিখেলা, কুস্তি, হা-ডু-ডু, ঘুড়ি ওড়ানো, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়দৌড়, মোরগের লড়াই, বানেরর খেলা ইত্যাদি দেশজ মজার খেলা সবাইকে মাতিয়ে রাখে।

গ্রামই ছিল একসময় বৈশাখি মেলার প্রধান ক্ষেত্র। সাধারণত পথের তেমাথায়, তিন নদীর মিলনস্থানে, ফাঁকা মাঠে, কিংবা বিশাল অশ্বত্থ বা বট গাছের নিচে এই মেলা বসত। যেখানে নানান দিক থেকে অনেক লোক এসে জড়ো হতে পারত। কালক্রমে মেলার স্থান গ্রাম থেকে শহরে বি¯তৃত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

এখন তাই পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ সারাদেশের সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তবে, রাজধানী ঢাকা থাকে এই উৎসবের কেন্দ্রস্থলে। ছায়ানট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ঢাকায় নববর্ষের উৎসব উদ্যাপিত হয়ে আসছে।

বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা (বিসিক) বৈশাখি মেলার আয়োজন করে আসছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত বিসিকের বৈশাখি মেলা দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগিয়েছে। কয়েকটি লক্ষ্য সামনে রেখে বিসিক বৈশাখী মেলার আয়োজন করে, যেমন- ১. কুটির ও হস্তশিল্পজাত পন্যের বাজার সৃষ্টি,

২. গ্রামীণ কারুপণ্য শহুরে মানুষ ও বিদেশীদের সামনে তুলে ধরা, ৩. ক্রেতার চাহিদা সম্বন্ধে উৎপাদকদের অবহিত করা, ৪. কারুশিল্পীদের বিভিন্ন পণ্য, নক্সা ও নমুনার সঙ্গে মানুষের পরিচিতি ঘটানো। এবছর ঈদের ছুটির পর পরই পহেলা বৈশাখ পড়ে গেছে বিধায় বিসিক বৈশাখী মেলা ঈদের পর সুবিধাজনক সময়ে করবে বলে আশা করা যায়।

মনে রাখা দরকার, বৈশাখি মেলা কেবল একদিনেই শেষ হয় না। একদিন, তিনদিন, সাতদিন, পক্ষকাল, পুরো মাস আবার কোথাও-বা দুই মাসব্যাপীও বৈশাখি মেলা চলে। সারা বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই কোনো না কোনো স্থানে বৈশাখি মেলা বসে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, যশোর, বরিশালসহ আরো অনেক জেলায় পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে মাসব্যাপী বৈশাখি মেলা চলতে থাকে।

উত্তরবঙ্গের উল্লেখযোগ্য বৈশাখি মেলার মধ্যে দিনাজপুরের আমবাড়ির মেলা, বগুড়ার গাঙনগরমেলা, যশোরের নিশিনাথ তলার মেলা, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা-বিত্তিপাড়ার ঘোড়াপীরের মেলা এবং বরিশালের বাকালের মেলার ইতিহাস প্রসিদ্ধ।

কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়ার চান্দনা গ্রামের বৈশাখি মেলা ছিল বিখ্যাত। এই মেলার আড়ম্বর, জাঁকজমক অন্যান্য মেলার চেয়ে বেশি হতো। এছাড়া, কুমিল্লা জেলার সিদলাই, কান্দুঘর, ময়নামতিসহ বিভিন্ন স্থানে বৈশাখি মেলার ঐতিহ্যের সুখ্যাতি রয়েছে। এ অঞ্চলে বৈশাখি মেলায় বিক্রির জন্য বাঁশের বাঁশি তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাদুঘর, গোকর্ণঘাট, নবীনগর, খড়মপুর প্রভৃতি স্থানে বৈশাখি মেলা বসে।

চট্টগ্রামে বৈশাখী মেলার অন্যতম পর্ব ‘জব্বারের বলীখেলা’। একদিনের এই বলীখেলা উপভোগ করতে সমবেত হয় অসংখ্য মানুষ। চৈত্রের শেষে চট্টগ্রামের বৌদ্ধরা আয়োজন করে ‘মহামুনির মেলা’। এই মেলা বর্ষবরণেরই অংশ। চট্টগ্রামের আদিবাসী মারমা, চাকমা ও ত্রিপুরাদের বর্ষবরণ উৎসব পরিচিত সাংগ্রাই, বিঝু বা বিষু নামে। এই উৎসব উপলক্ষেও মেলা জমে ওঠে।

বর্তমানে প্রচলিত বৈশাখিমেলার তালিকা প্রণয়ন ও তার সম্পূর্ণ বিবরণসহ আলোকচিত্র ও ভিডিওচিত্রে নথিভুক্ত করা জরুরি। ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিম-লে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এই বৈচিত্র্যময় রূপ তুলে ধরতে পারলে প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের সময় এদেশে যেমন প্রচুর বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটতো, তেমনি নতুন প্রজন্ম বৈশাখি মেলার ঐতিহ্য সুরক্ষায় সচেতন হতো।

বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতো এবং বৈশাখি মেলায় অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা উদ্ধুদ্ধ হতেন ঐতিহ্যপ্রেমে। এমনকি এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির সাধনা বিস্তার ঘটতো এবং বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তো।

লেখক: বিশিষ্ট লোক-ঐতিহ্য গবেষক, নাট্যকার ও উপ-পরিচালক, সংস্কৃতি উপবিভাগ, বাংলা একাডেমি। 

;

কায়মনে বাঙালি হবার বড়ো অনুপ্রেরণার উৎস বাংলা নববর্ষ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



ড. আতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৬৭ সনে রমনার বটমূলে এই অনুষ্ঠানের সূচনা ছায়ানটকে বৃহত্তর জনসম্মূখে আনতে সাহায্য করেছে। এ কথা তো সত্যি রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সংস্কৃতিকে হিমালয়ের মতো রক্ষা করে চলেছেন। রবীন্দ্রনাথ বরাবরই বলে এসেছেন যে রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে হলে এর ভেতরের শক্তিকে জাগ্রত করতে হবে সমাজে, সংস্কৃতিতে। তাই বাঙালির উৎসবগুলোর পুনরুজ্জীবনের পক্ষে ছিলেন তিনি। গ্রামীণ মেলাগুলো পরিচালনা করতে তিনিই বলেছেন।

এর ফলে বাঙালির সামাজিক বন্ধন পোক্ত হবে বলে তিনি মনে করতেন। সেই অভিপ্রায়েই ছায়ানট বাঙালির নিজস্ব ‘শুভ নববর্ষ’ উদযাপনের এই আয়োজনের সূত্রপাত করে। বলা যায় ছায়ানট রবীন্দ্রনাথের সেই জাগরণের অগ্রগামী এক প্রতিষ্ঠানের নাম। এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনের ভাবনাটির কথা সনজীদা খাতুন এভাবে জানিয়েছেন, “আমরা এক সময় ‘শ্রোতার আসর’ নামে একটা অনুষ্ঠান করতাম। গান শুনিয়ে আমরা ‘অতীতচারী’ করতে চাইতাম। সেইসব গান বাঙালির বলে মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে দেখা গেল, আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম। কারণ শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। তখন শুধুমাত্র ঐ বুলবুল একাডেমী ছিল। সেইজন্য আমরা একটা স্কুল করা দরকার বলে মনে করতাম। ... গান মানুষের জীবনে সংস্কৃতির বড় একটা ছাপ ফেলে।” 

সেই ছায়ানট এখন এক মহিরূহে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া জমিতে সকলের প্রচেষ্টায় এক কর্মচঞ্চল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের নাম ছায়ানট। এর সঙ্গে সম্পূরক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাঙালির মননকে সিক্ত করে চলেছে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ। এই পরিষদের সাথে আমি গভীরভাবে যুক্ত। সারাদেশে রবীন্দ্রচর্চা ও রবীন্দ্রসংগীত প্রসারে আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।

এই সংস্কৃতিভবন উদ্বোধনের দিন প্রয়াত ওয়াহিদুল হক বলেছিলেন, “নগরের মানুষদের অসাম্প্রদায়িক করার আন্দোলনে ছায়ানট খানিকটা সফল হয়েছে। এবারে গ্রামের সাধারণ মানুষকেও শুদ্ধ সংস্কৃতির পরশ দিতে হবে। সকলকে সঙ্গে নিতে পারলে সম্পূর্ণ বাঙালি হওয়া যাবে।”

সুদীর্ঘ তিপ্পান্ন বছরে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। রমনা বটমূলের এই নববর্ষ উদ্যাপন এখন সারা দেশ এবং বাঙালি অধ্যুষিত বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ বাঙালি বাংলা নববর্ষে পথে নেমে পড়ে। নুতন জামা-কাপড় পড়ে এক উজ্জ্বল সকালে তাদের আনন্দঘন উপস্থিতি বাঙালির অস্তিত্বের জানান দেয়। পাশাপাশি চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের এক অসাধরণ অগ্রযাত্রার প্রতীক বাঙালির এসব আয়োজন।

কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্প্রতি ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে আমাদের আলোর পথযাত্রাকে পুরোনো সেই সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহ অন্ধকারাচ্ছন্ন করতে চাইছে। কোমলমতি তরুণদের বিভ্রান্ত করে ফেলতে চাইছে। অথচ সেই কতো আগে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “যে দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অন্য কোন বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য। সে দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ। মানুষ বলেই মানুষের যে মুল্য সেইটেকেই সহজপ্রীতির সঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি।” (রবীন্দ্র রচনাবলী, দ্বাদশ খণ্ড, পৃ. ৬৬৬)। বড়ই দুর্ভাগ্য আমাদের পাঠক্রম নির্ণয়েও ধর্মীয় বিভেদ বিতর্ক আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনকে কুলষিত করে চলেছে।

এমন বিভেদকে ঠেকানোর একটা বড়ো উপায় হতে পারে সংগীত চর্চা। কেননা, সংগীতই পারে জীবনের অসামঞ্জস্যগুলোর অবসান ঘটিয়ে এক নয়া পারসপেকটিভ দিতে। সংগীত শিল্পের এই অসাধারণ ক্ষমতার কথা রবীন্দ্রনাথই তাঁর ছিন্নপত্রে বলে গেছেন ।

কিন্তু সংস্কৃতির এই সক্ষমতার কথা অনুদার বিভেদকামীরাও জানে। তাই তো এই বটমূলেই নিক্ষিপ্ত হয়েছিল মানবতা বিধ্বংসী বোমা। সংস্কৃতি প্রিয় কয়েকজনের প্রাণ যায় ওই বোমা হামলায়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই আমিও। যেখানে বোমাটি পড়েছিল সেখানেই দাঁড়িছিলাম সস্ত্রীক আমি। তাড়া ছিল বলে মাত্র কয়েক মিনিট আগেই সেখান থেকে বের হয়েছিলাম আমরা। তবে উদার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আক্রমণ কিন্তু এখনও থামে নি।

প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে মানবতার শত্রুরা বড়ই সোচ্চার এই ক্ষণে। আর সে কারণেই মুক্তমনা মানুষের শক্তি সঞ্চয়ের উৎস হতে পারে বাঙালির পহেলা বৈশাখ উদযাপন। আশার কথা স্বদেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করা হচ্ছে বেশ জোরেসোরেই। এ বছর নিউইর্য়কের টাইমস্কোয়ারে সহ¯্র কণ্ঠে উচ্চারিত হতে যাচ্ছে পহেলা বৈশাখের গান। বাংলা নববর্ষের আয়োজন সারা বিশ্বেই এখন প্রবাসীদের মনে ফেলে আসা বাংলা মায়ের জন্য বিশেষ দরদ ও আকর্ষণ বাড়ায়। কায়মনে বাঙালি হবার, সম্পূর্ণ বাঙালি হবার অসাম্প্রদায়িক বাঙালি হবার বড়ো অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে বাংলা নববর্ষ।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক, রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু গবেষক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

;