বসন্ত শুধুই ঋতু নয়। নয় কেবলই প্রকৃতির অপার পালাবদল। প্রকৃতির দীপ্তিতে আর মানুষের হৃদয়ের বহুবর্ণা আলো ও রঙের হিল্লোলে বসন্ত হলো এক অলৌকিক স্পর্শময়তা।
কাতর শীত শেষে চিরায়ত বাঙালির কাছে বসন্ত আসে জীবন ও যৌবনের তীব্র চাঞ্চল্যের স্পন্দন জাগানিয়া রোমান্টিক শিহরণে, জীবনের নবতর এক আলেখ্যে। মানুষ ও প্রকৃতির কাছে বসন্ত আসে নবপ্রাণে, নব নব উদ্ভাসে।
এই অপরূপ বসন্ত কেবলই আনন্দের? উৎসব ও উপভোগের? বসন্তের সাথে বিষাদের কোনও সংযোগ নেই?
আছে। প্রত্যক্ষে না হলেও পরোক্ষে আছেই। যেমন ভাবে আলোর পাশে অন্ধকার, রাতের পাশে দিন, প্রাপ্তির পাশে অপ্রাপ্তি আছে, তেমনি আনন্দের পাশে আছে বেদনা। বসন্তের আলোকোজ্জ্বল আনন্দধারার মধ্যে অন্তঃসলিলার মতো প্রবহমান রয়েছে বিপরীত চিত্র।
আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের বসন্তকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের লেখায় পাওয়া যায় অন্তর্গত বেদনায়, যদিও তিনি বসন্ত বন্দনাতে অকৃপণ। তাঁর অংশগ্রহণ ও নির্দেশনায় শান্তি নিকেতনের 'বসন্ত উৎসব' বাঙালির প্রাণের উষ্ণতায় উদ্বেলিত। চিরায়ত বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে ও ধর্মনিরপেক্ষ আবহে 'বসন্ত উৎসব' রূপান্তরিত হয়েছে সর্বজনের জাতীয় উদযাপনে।
তথাপি, রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্নহৃদয়' গ্রন্থের একটি গানে তিনিই বলেছেন, 'তুই রে বসন্ত সমীরণ/তোর নহে সুখের জীবন।'
১৮৮১ সালে রচিত রবীন্দ্রনাথের এই গানটির স্বরলিপিকার ইন্দিরা দেবী। গানটি ঝাঁপতালে কাফি রাগে গীত। বসন্ত নিজে বাতাস, বাগান সর্বত্র দিবানিশি বিচরণ করে এবং প্রকৃতি আর জগৎসংসারকে আলোকিত করেও বেদনার্ত।
বসন্ত নিজে যে সুখী নয়, এ কথাটিই বার বার উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বলেছেন, 'নদীরে জাগায়ে দিস/লতারে রাগায়ে দিস/চুপিচুপি করিয়া চুম্বন/তোর নহে সুখের জীবন।'
রবীন্দ্রনাথের কম-গীত, অপ্রচলিত গানের একটি, 'তুই রে বসন্ত সমীরণ' গানটি প্রায়ই শুনি অদিতি মহসিনের কণ্ঠে আর ভাবি, যাপনের পথে পথে অনেকগুলো ঘোলাটে রেল স্টেশন, নীল পোস্ট অফিস, গ্র্যান্ডফাদার্স ক্লকের তামাটে পেন্ডুলাম পেরিয়ে আসে চিরন্তন বসন্ত। শুধুই আনন্দ আনে? বেদনায় দায়ভার টেনে টেনে নিয়ে আসেনা পুষ্পিত বক্ষপিঞ্জরে কিংবা আমাদের চারপাশের ফুলেল বাসন্তী আয়োজনের অদেখা নিভৃতির গোপন অলিন্দে?
চিত্তের সাথে চিন্তার রাখিবন্ধনে, আনন্দ ও বেদনার মিতালিতে, আত্মা সবুজ হলেই মানুষ দেখা পায় প্রকৃত বসন্তের। তেমন বসন্ত যদি আসে কখনও, ধন্য হয় মানবজীবন, পূর্ণ হয় জীবনের বিবরে অতিক্রান্ত যাপন কাল।
বসন্ত এসেছে, বসন্ত আসুক, এমনই বসন্ত হয়ে, শাশ্বত বসন্তের চিরায়ত মাধুর্য নিয়ে, মানুষের কাছে, অন্তরে-বাহিরে, প্রকৃতিতে, দেশে দেশে, সারা বিশ্বে।