“আর কোনো খেলা নেই। আর নেই বোমা। চলাফেরাও নেই। মজা নেই। সাঁতরানো নেই। ৬৭। ৫০ পেরিয়ে আসা ১৭ বছর। অপ্রত্যাশিত ১৭টা বছর। একঘেঁয়ে। আমি বিদ্বেষী। কারো জন্য কোনো মজা অবশিষ্ট নেই। ৬৭। তুমি লোভী হয়ে যাচ্ছো। বয়সোচিত হও। শান্ত হও—এটা তোমায় আঘাত দেবে না।”
এই নোটটির নাম ‘ফুটবল খেলার দিন শেষ’। এটিকেই ধরা নেওয়া হয় আমেরিকার বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক হান্টার এস থম্পসনের শেষ লেখা কিম্বা আত্নহত্যার বার্তা। বলা হয় এটি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে মৃত্যুর কিছুদিন আগে লেখা। লেখার এই অংশ এটা তো প্রমাণ করেই দেয় নিজেকে ঘটনায় ভরপুর, সক্রিয়, উত্তেজনায় আক্রান্ত দেখতে তিনি নিজেই অভ্যস্ত ছিলেন, এটাই ছিল তার নিজের কাছে নিজের চিহ্ন তাই যখন চিহ্নের লুপ্তি তার অনুভূতিতে এসে আঘাত করছিল হয়তো দাঁড়াতে পারছিলেন না। তবেই তো লিখছেন মজা নেই, পঞ্চাশ পরবর্তী ১৭ তাঁর কাছে লঘু; অথচ নিজেকে শান্ত থাকতে বলছেন কারণ বয়স; ফলত হেরেও না হারার একটাই উপায় আত্মহত্যা।
সময়টা ছিল ফেব্রুয়ারি, যেই মাস নিয়ে লেখকের এমনি একটি বিশেষ অনুভূতি ছিল। ২০০৫ সালে ২০ ফেব্রুয়ারির এরকম একটি দিনে নিজের আউলস ক্রিকের ফার্ম হাউসে নিজে নিজের মাথায় গুলি করেন, শোনা যায় সেই মুহূর্তে তিনি তার দ্বিতীয় স্ত্রী আনিতার সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন। সেইদিন থম্পসনের আগের পক্ষের ছেলে জুয়ান থম্পসন, ছেলের স্ত্রী ও সন্তান সেই বাড়িতে উপস্থিত ছিল। তারা গুলির আওয়াজও শোনে কিন্তু বুঝতে পারে না। সেইসময় তিনি ইএসপিএন নামক বিখ্যাত স্পোর্টস চ্যানেলেটিতে ধারাবাহিক কলাম লিখতেন সেই বিষয়ে ফোনে তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন; আনিতা গুলির শব্দ পেয়েছিলেন কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন টাইপরাইটারের শব্দ। থম্পসনের মৃত্যুর প্রায় আধঘণ্টা পর তাঁর ছেলে তাঁর মৃতদেহ দেখতে পায়—মৃত্যুর কারণ বহুভাবে খোঁজা যেতেই পারে কিন্তু তার জীবন যে পথে এই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল সেটা তীব্র নাটকীয় ছিল ফলে এমন মৃত্যু এরকমভাবে হওয়া যেন তার জীবনকাহিনীর উপসংহার।
যাঁর লেখার দক্ষতায় তাঁর মা অবাক হয়ে যেতেন এবং ভাবতেন একেবারে বই পড়তে ভালো না বাসা, উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে এরকম লেখা লিখতেই পারে না, নির্ঘাত সে টুকে লিখেছে—সেইরকম বিস্ময়ের তো এভাবেই মৃত্যু অবধারিত। যে নিজে মৃত্যুকেও শাসন করে গেছে—এর মধ্যে বাহবা, সাহস বা বীরত্বের যে কিছু তা ঠিক নয়, আসলে তাঁর যে জীবনপ্রণালী সেখানে সামঞ্জস্য তো এই প্রকার মৃত্যুই। মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তিনি বিড়বিড় করে বলতেন “শিশুটা যেন বুড়িয়ে যাচ্ছে”—এটাই তার স্বগতোক্তি ছিল; তারই মধ্যে ছিল কিছু শারীরিক অসুস্থতা, তাঁর কোমরের হাড়ের প্রতিস্থাপনের পরিস্থিতি তাকে যেন বুঝিয়ে দিচ্ছিল এই ফুটবল খেলার প্রিয় ফেব্রুয়ারি আর আগের মতো করে তার কাছে ফিরবে না। যিনি ছোট থেকে পালিয়ে বেরিয়েছেন পড়াশোনার প্রথাগত জায়গা থেকে, খেলাই ছিল তার ভালো লাগা, বাইকে চড়ে এক উদ্দাম সাহসী জীবন কাটিয়েছেন, লোকের বাড়ির জানলায় ঢিল ছুঁড়েছেন, যিনি আগ্নেয়াস্ত্র সংরক্ষণ করতে চেয়েছেন সরকারকে না লুকিয়ে সেই তিনি দুর্দমনীয় সাংবাদিক থেকে এক জনপ্রিয় লেখক হয়ে উঠে তিনি যেন নিজেকে গুছিয়ে ফেলছিলেন; এই গোছানো তার রক্তে ছিল না ফলত ক্লাইম্যাক্স—তাঁকে বিতর্কের মৃত্যু ঘনিয়ে দিল।
আরো পড়ুন ➥ আত্মঘাতের আলো কিম্বা অন্ধকার
এই লেখক তথা কিংবদন্তী সাংবাদিকের জন্ম হয় ইনসিওরেন্স বিভাগে কর্মরত ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দক্ষ আর্মি জ্যাক রবার্ট থম্পসন ও লাইব্রেরিয়ান ভার্জিনিয়া রে ড্যাভিসনের বিবাহের পর ১৯৩৭ সালের ১৮ই জুলাই আমেরিকার লুইসভিলের কন্টাকিতে। তাঁর নামের মাঝখানের হান্টার উপাধিটি তাঁর মায়ের বাড়ির দিক থেকে গ্রহণ করা। ১৯৪৩ সালে তাঁর আরো দুই ভাই সমেত তাঁরা অন্যত্র চলে যান থাকার জন্য। এরই মধ্যে তাঁর ১৪ বছর বয়সে বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুতে সংসারে অভাব নামে ফলে থম্পসনের ওপর নজর কমে মায়ের। থম্পসন যেন মুক্ত জীবন পায়, বাবার মৃত্যুতে সে খুশি হয়েছিল কারণ বাবার তীব্র মাদকাসক্তি, বাড়িতে নিত্য অশান্তি থেকে যেন সে মুক্তি পেয়েছিল। কারণ সে এইসব অশান্তির মাঝে থেকে বিনাকারণেও তীব্র শাসনের আওতায় পড়ত। তার মা অবশ্য বাবার মৃত্যুর পর নিজের অত্যধিক মদ্যপান করতেন। ফলে থম্পসনের নিজের শর্তে বাঁচার ইচ্ছা ও প্রশ্রয় দুটোই ভরপুর ছিল—জীবনের কী বাঁক এই বিচ্ছিন্নতা ও ধংসমুখী অস্থিরতা থেকেই তিনি নিজের আলো বার করে ফেলতে থাকলেন। অবশ্য নিজেই তীব্র মাদকাসক্ত ছিলেন। ওয়াইল্ড টার্কিশ বারবান ছিল তার প্রিয় উইস্কি, সাংবাদিকতার জীবনে তার এটি ছিল নিত্যসঙ্গী। একটি মিটিংয়ে নিজের পানীয় অভ্যাসকে নিজেই ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন যে মুখগুলো দেখে খুব শক্তিশালী মনে হয় তারা আসলে পরিষ্কার নাও হতে পারে।
অল্পবয়সের উদ্দমতার মধ্যেও রোজগারের জন্য কিছু প্রথাভিত্তিক পড়া আর নিজের মুক্ত পড়ালেখার ব্যাপারে ভীষণ সতর্ক ছিলেন তিনি। মাঝখানে সন্ত্রাসীও হয়ে উঠেছিলেন ফলে যে সাহিত্য সংগঠন তার প্রতিভার জন্য তাঁর দিকে এসেছিল তাঁরাও ধীরে ধীরে সরে যায়। ডাকাতির মামলাতেও তিনি অভিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এই ভ্রাম্যমাণ জীবনের মধ্যেই ‘দ্য রাম ডায়েরি’ লিখেছিলেন যেটা বহুবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। তাঁর জীবনের সবচেয়ে তীব্র মুহূর্ত ‘দ্য নেশনে’ যোগদান এখানেই, তাঁর কাজ ছিল ‘হেলস এ্যাঞ্জেলস মোটরসাইকেলস ক্লাব’ কেসটি নিয়ে কাজ করা—রিপোর্টের লেখা তাঁর জীবন ঘুরিয়ে দেয়, পুরো আমেরিকায় সাড়া পড়ে যায় থম্পসনকে বারবার মেরে ফেলার প্রয়াস করা হয়—আর তিনি কী করলেন?
এই স্মৃতিকে ধরেই লিখলেন বিখ্যাত লেখা ‘হেলস এঞ্জেলসঃ দ্য স্ট্রেঞ্জ অ্যান্ড টেরিবল সাগা অব দ্য আউট’ল মোটরসাইকেল গ্যাংস’। এক বছরে চারটি সংস্করণ বিক্রি—প্রতিষ্ঠা আর কাকে বলে। ১৯৮০ সালে প্রথম প্রেমের বিবাহিত স্ত্রী স্যান্ডিকে ডিভোর্স দেন তারপর জীবন আসেন আনিতা। তাঁর লেখার চিত্রনাট্যে অভিনয় করে অভিনেতা জনি ডেপ তার ভক্ত হয়ে গেলেন। গঞ্জো সাংবাদিকতার এই কিংবদন্তী অপ্রত্যাশিতভাবে সব পাওয়ার মধ্য দিয়ে যেতে যেতেও হারিয়ে ফেলছিলেন—তাঁর উত্তেজনা কমে আসছিল, বৃদ্ধ হচ্ছিল, ফুটবল খেলার দিন শেষ হচ্ছিল, তাই নিজেই রাজত্ব নিলেন—গুলি করলেন সময়কে, নিজেকে...