একটি শরাবি গজলের তরজমা ও তাফসির

অনুবাদ কবিতা, শিল্প-সাহিত্য

রূপান্তর সৈয়দ তারিক | 2023-09-01 18:39:46

গজল গীতিকবিতার একটি ধারা। আদিতে আরবি কবিতার একটি রূপকল্প এটি। সপ্তম শতক থেকে আরবি ভাষায় এটি রচিত হতে থাকে। পরবর্তীতে অন্যান্য ভাষাতেও এই রূপকল্পটি গৃহীত হয়। ভারতবর্ষে হজরত আমির খসরু এটির প্রচলন ঘটান। প্রেমের সৌন্দর্য, বিরহ-বেদনা, আনন্দ এইসব সাধারণত এর বিষয়।

জনপ্রিয় একধারার গজলকে শরাবি গজল বলে। এসবের কেন্দ্রীয় বিষয় শরাব বা মদ। পঙ্কজ উদাস এই ধরনের গজলের রাজা। এইরকম গান বিস্তর করেছেন তিনি। একটি গজল ‘লা পিলা দে সাকিয়া’—তে তিনি গাইছেন:

মদ ঢালো, সাকি, বোতলের পর বোতল,
মদ খেয়ে হুঁশ ফিরলে আলাপ হবে,
আরো মদ ঢালো, সাকি।

আর একটি গজল ‘এক তরফ উসকা ঘর’-এর কথাগুলো এমন:

একদিকে ওই গোলাপি রমণী বসে,
আরেক পাশেই মদের বোতল-গ্লাস,
মেয়েটিকে যদি বাদ দিই, যাব কই?
মদঘর ছেড়ে বেরোলেই আমি লাশ।
বড় মুশকিলে পড়ে গেছি আমি আজ,
বলে দাও খোদা কী এখন তবে কাজ?

কিন্তু গানে বা কবিতায় মদ মানে কেবল পান করবার উগ্র পানীয়ই নয়। বিশেষ করে সুফি সাহিত্যে মদ প্রায়শই প্রেমের প্রতীক। তাও সাধারণ জাগতিক নর-নারীর প্রেম নয়, ঐশী প্রেম। অবশ্য জাগতিক প্রেমের রূপকেই সেটা সাধারণত বর্ণিত হয়। ভারতীয় ঐতিহ্যে যেমন রাধা-কৃষ্ণের কাহিনী জীবাত্মা ও পরমাত্মার রূপক, সুফিসাহিত্যেও লাইলি-মজনু, শিঁরি-ফরহাদ, হির-রানজা—এইরকম বিভিন্ন যুগলের প্রেমকাহিনীর রূপকে মানব ও স্রষ্টার প্রেমের বর্ণনা রয়েছে।

অহম বা খুদি হলো জীবাত্মা, এর সীমানা অতিক্রম করতে পারলে নিজের সত্তার ভিতরেই আনন্দময়-প্রেমময়-অনন্ত-অসীম সত্তার সন্ধান পাওয়া যায়। সেই সত্তার প্রেমে মগ্ন হয়ে থাকাই মদ খেয়ে মাতাল হওয়া। আর সেই সত্তাকে লাভ করবার পথপ্রদর্শক যিনি, সেই মুরশিদ-পীর-গুরুর সাথেও একটি প্রেমখেলার আয়োজন রয়েছে সুফি ভাবধারায়। খোদার প্রতিনিধি বা মানবিক রূপকল্প হিসাবেই গুরুর অবস্থান। নিরাকার আল্লাহর সাথে প্রেম করবার আগে তার সাকার প্রতিনিধির সাথে প্রেম করতে হয়। কোরানও বলছে, আল্লাহকে ভালোবাসতে হলে তার রাসুলকে ভালোবাসতে হবে। মদিনায় রওজানিবাসী নবিজির নুরের অর্থাৎ প্রজ্ঞা ও প্রেমের যারা উত্তরাধিকারী তারাই হলেন ওলি ও মুরশিদ। মুরশিদের সাথে প্রেমের রূপকও ওই মদ। অবশ্য সুফি কবিতায় মুরশিদকে প্রায়শই সাকি বা মদপরিবেশক বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

সবকো মালুম হ্যায় ম্যায় শরাবি নেহিঁ—এই গজলটাতে প্রথমে সাদামাটাভাবে মদের কথাই বলা হয়েছে। ‘সবাই জানে আমি মদখোর না, কিন্তু কেউ যদি মদ এগিয়ে দেয় তো আমার কী দোষ?’—মনে হতে পারে যেন খোঁড়া যুক্তি দিয়ে নিজের মদ্যপানের বাসনাকে প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু এর পরেই বোঝা যাচ্ছে, এই মদ পানীয় বস্তু নয়, এ হচ্ছে দৃষ্টির মদ। প্রেমাস্পদের চোখে যখন চোখ পড়ে যায় তখন যে ঘটনা ঘটে তা অতুলনীয় এক ব্যাপার। দুজন তরুণ-তরুণী যখন পরস্পরের প্রেমে পড়ে, পরস্পরের সান্নিধ্যে আসে, তখন আসলে কী ঘটে? তখন মস্তিষ্কে একটি রাসায়নিক পদার্থের ক্ষরণ হয় যার নাম ফিনাইল ইথাইল অ্যামিন (PEA)। এই পদার্থ স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এটি অ্যামফিটামিন জাতীয় একটি মাদকদ্রব্য। এর প্রভাবে দেখা দেয় উদ্দীপনা-উত্তেজনা, অকারণ আনন্দ-উল্লাস, পারস্পরিক তীব্র আকর্ষণ, বিচার-বিবেচনাহীন কাজকারবার। প্রেমিক-প্রেমিকা অনেক সময়েই যে বলে, ‘তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার নেশা ধরে যাচ্ছে’—তার নিদান ওই দেহরসই।

সুতরাং গজলটিতে বলা হচ্ছে :

শুধু একবার চোখে যদি চোখ পড়ে
কসম তখন ভেঙে যায় যদি
আমি কী করতে পারি?

প্রেম তো এভাবেই ঘটে যায়। চোখে চোখ পড়ল দুজনের, মনের সাথে মনের যোগ ঘটল, শরীরের ভেতর বয়ে গেল স্নায়বিক প্রবাহ, রক্তধারায় মিশল পি-ই-এ আর কেঁপে উঠল তার বাস্তবতা, আগের যত ওয়াদা-শপথ-সিদ্ধান্ত টলে উঠল সব কিছু।

কিন্তু প্রেমের ভাগ্য কি সবার হয়? প্রেমানন্দে রইতে কি পারে সবাই? এও এক ভাগ্যের খেলা বা চান্স ফ্যাকটরের কারসাজি। আবার কাউকে পছন্দ হলেই যে তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়া যাবে, এমনও নয়। প্রেম গড়ে ওঠে প্রেমের যোগ্য হৃদয়-মন থাকলেই। কিন্তু যে জন তার অন্তরে প্রেমিক, সে প্রেমানন্দে থাকে আপন প্রেমের জোরেই :

মদ না খেয়েই উল্লাস যদি জাগে
আমি কী করতে পারি?

ধর্মে বলা আছে বেহেশতের কথা। সেখানে আছে সরাবন তহুরা নামের মদ। সেখানে আছে অনিন্দ্যকান্তি চিরযৌবনা হুর। এইসব বর্ণনাতেই লোভাতুর হয়ে মাতাল হয়ে থাকে অনেকে। তাদের জীবনের লক্ষ্য-আদর্শ-উদ্দেশ্য-মোক্ষই হলো জান্নাতে যাওয়া। এই জান্নাতের লোভেই কত যুবক যে জঙ্গি-খুনি হয়ে ওঠে হায়! তাদের বোঝানো হয়, জেহাদে মরলে সে শহিদ হবে, সরাসরি জান্নাত নিশ্চিত। এই জান্নাতের লোভেই সে আত্মঘাতী হয়ে খুন করে অসংখ্য মানুষ।

জঙ্গি হোক বা না হোক, ধর্মবিশ্বাসীরা বেহেশত-দোজখকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় বলেই মনে করে। ভালো কাজ করলে বেহেশতে যাবে ও অনন্ত সুখ ভোগ করবে, খারাপ কাজ করলে শাস্তি পাবে দোজখে। সুফিরা এইসব প্রলোভন ও ভীতিকে আমলে আনেন না। তাদের চর্চার বিষয় প্রেম। তাপসী রাবেয়া বলতেন, ‘আমি আগুন দিয়ে বেহেশত পুড়িয়ে দেব, পানিতে নিভিয়ে দেব দোজখ; যেন বেহেশতের লোভে আর দোজখের ভয়ে লোকে এবাদত না করে; যেন লোকে আল্লাহকে ভালোবেসে তার প্রেমেই চালায় সকল এবাদতি কার্যক্রম।’

কিন্তু কেউ যদি বেহেশতের লোভেই মাতাল হয়ে থাকে, তা নিয়ে কীইবা করার আছে?

মদ খেলে যেমন বেহুঁশ হয়ে যায়, তাল হারায়, তেমনি প্রেমে পড়লেও মানুষ হুঁশবোধ হারায়। হুঁশ যে হারায় তার চমৎকার একটা বর্ণনা আছে কোরান শরিফে। জুলেখার নামে ইউসুফকে নিয়ে যখন বদনাম ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে, তখন নিজের সখিদের একটা পরীক্ষায় ফেললেন তিনি। সবাইকে একহাতে একটা করে লেবু ও অন্য হাতে ছুরি দিয়ে বসিয়ে দিলেন তিনি, বলে দিলেন, যখন তিনি কাটতে বলবেন ঠিক তখনই যেন কাটে তারা লেবু। তিনি আয়োজন করে রেখেছিলেন ইউসুফের ঘরে প্রবেশের। যেই মুহূর্তে ইউসুফ এসে ঘরে ঢুকলেন তক্ষুণি জুলেখা বললেন, ‘কাটো।’ সখিরা সবাই একযোগে কাটল বটে, কিন্তু অপরূপ সৌন্দর্যবান ইউসুফকে দেখে তারা এমনই বেহুঁশ হলো যে লেবুর বদলে নিজের হাত কেটে ফেলল প্রত্যেকে। এরকমই উচাটন হয়ে পড়তেন রাধা কৃষ্ণের বাঁশি শুনে। কিন্তু আমার ভেতরে যে প্রেমানন্দ বয়ে যাচ্ছে তা তো কেউ ঠাহর করতে পারছে না। তাতে আমি কী করতে পারি?

জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, করণীয় ও পদ্ধতি এইসব নিয়ে কতই না ওয়াজ-নসিহত, কতই না ডিসকোর্স-বিশ্লেষণ, কতই না বাগাড়ম্বর! কিন্তু নিজের অহম-আমিত্ব-ইগো-খুদির পিছনে যে মুক্ত-অনন্ত-শাশ্বত পরমানন্দ রয়েছে, রবীন্দ্রনাথ যার কথা এভাবে বলেছেন :

আপনারে দিয়ে রচিলি রে কী এ
আপনারই আবরণ,
খুলে দেখ দ্বার অন্তরে তার
আনন্দনিকেতন।

তার খবর যদি কেউ না রাখে ও না
খোঁজে—আমি কী করতে পারি?


সবকো মালুম হ্যায় ম্যায় শরাবি নেহিঁ গজলটির রচয়িতা আনওয়ার ফররুখাবাদী। তিনি ফানা ছদ্মনামেও রচয়িতা হিসাবে পরিচিত। তিনি একজন সুফি কবি ছিলেন। গজল, কাওয়ালি, অন্যান্য ধরনের গান ও কবিতার রচয়িতা তিনি। ১৯২৮ সালে জন্ম তাঁর, প্রয়াত হন ২০১১ সালে। কারবালার বিষয় নিয়ে বিখ্যাত মর্সিয়া গান লেখেন তিনি, সামসাদ বেগম সেটি গেয়েছেন। তার লেখা গজল ‘ইয়ে জো হালকা হালকা সরুর হ্যায়’ নুসরাত ফতেহ আলি খান ও অন্যান্য শিল্পীরা গেয়েছেন। বর্তমান গজলটি পঙ্কজ উদাস গেয়েছেন :

সকলেই জানে, আমি মদখোর নই
তবু যদি কেউ বাড়ায় গ্লাস তো
আমি কী করতে পারি?

শুধু একবার চোখে যদি চোখ পড়ে
কসম তখন ভেঙে যায় যদি
আমি কী করতে পারি?

অল্প লোকেই এমন ভাগ্যবান,
দৃষ্টির মদ খেয়ে তারা নেশা করে;
অল্পজনেই অনুমতি দেয় খেতে
মায়া চোখ হতে যেই মদ ঝরে পড়ে।

আমার শপথ যদিও বড্ড কড়া
কিন্তু বলো তো, আমি কী করতে পারি?
মদ না খেয়েই উল্লাস যদি জাগে
আমি কী করতে পারি?

শুধু উল্লেখ আছে রঙ আর নুর
ওমনি জিকির : জান্নাত আর হুর,
আমি করি পান সৌন্দর্যের মদ
বিজ্ঞজনেরা তাতেই নেশায় চুর :
আমি কী করতে পারি?

শুঁড়িঘরে যত মত্তজনেরা ভাবে
তাদের মতন আমিও বুঝি মাতাল,
যেহেতু আমিও তাদের মতন করে
প্রায়শ হারাই তাল।

যদিও আমার শিরায় শিরায় বয়
প্রেমানন্দের ঢেউ
কিন্তু যদি তা বুঝতে না পারে কেউ,
আমি কী করতে পারি?

যদিও কেবল বাকোয়াজি করে যাও—
অহম পেরোলে আনন্দধারা আছে
সেটা না জানতে পাও,
এ জীবন এক মহা আনন্দ, যদি
মদ খেয়ে মজা পেতে না-ই শেখো,
আমি কী করতে পারি?


আরো পড়ুন সৈয়দ তারিকের অনুবাদে বুল্লে শাহ’র কবিতা

এ সম্পর্কিত আরও খবর