আমার ব্যাঙাচি একদিন সাপ হবে

রিভিউ, শিল্প-সাহিত্য

তানিয়া চক্রবর্তী | 2023-08-31 21:34:33

লেটো গান লিখে যে ছেলের হাতেখড়ি সে-ই হবে ভবিষ্যতের এক চূড়ান্ত জনপ্রিয় কবি। রবিঠাকুরের সঙ্গে যার নাম কিছুকাল পরে একযোগে নেওয়া হবে তাকে লেটো গানের ওস্তাদ বর্ধমানের শেখ চকর গোদা বলেছিলেন “আমার ব্যাঙাচি একদিন সাপ হবে।” লেখার শুরুতে তাকে ব্যাঙ বলেই ডাকা হচ্ছিল—কিন্তু আলোর নিজস্ব মহিমায় তা ধোপে টিকল না :

আমি ব্যাঙ
লম্বা আমার ঠ্যাং
ভৈরবে রভসে বরষা আসিল
ডাকি যে গ্যাঙর গ্যাঙ
আমি সাপ, আমি ব্যাঙেরে গিলিয়া খাই
আমি বুক দিয়া হাঁটি
ইঁদুর-ছুঁচোর গর্তে ঢুকিয়া যাই

এমনটি লেখা হলো কাকে উদ্দেশ্য করে? লেখা হলো বাংলার জনপ্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে মাথায় রেখে। লিখলেন সজনীকান্ত দাস শনিবারের চিঠি নামক পত্রিকায়। সজনীকান্ত দাস অবশ্য শুধু নজরুল ইসলামকে নয় অন্যান্য তরুণ কবিদের বিশেষত জীবনানন্দ দাশকে তুলোধোনা করে ছাড়তেন তার নিষ্ঠুর নিন্দার ভঙ্গিতে। নজরুল ইসলামকে নামও দিয়েছিলেন বিটকেল কাজী যেমন জীবনানন্দকে জীবানন্দ। যে কবিতা আপামর বাংলাকে আজ অবধি রক্তেস্রোতে বীরের আলোয় আলোকিত করে রাখবে সেই ‘বিদ্রোহী’ নামক কবিতা এভাবেই তার জন্মলগ্নে গ্লানিতে ভরে ছিল।

তবে কবি তো ছিলেন আদতেই বিদ্রোহী তাই জীবনের পদে পদে লড়াই তাকে নিজের স্বকীয়তা সম্পর্কেও সচেতন করে রেখেছিল। সাধারণত পত্রিকা অনেকসময় লেখককে সতর্ক করে থাকে যে, লেখক যে লেখা পাঠাবেন সেটির কপি যেন তিনি রাখেন কারণ ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়—তা যে কিছু দোষের তা বলা উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু নজরুল ইসলাম এত আত্মপ্রত্যয়ী ও সচেতন ছিলেন যে, নিজের লেখা প্রসঙ্গে সম্পাদকের দফতরে তিনি যে চিঠি পাঠালেন তার কিছু অংশে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল—“যদি কোনো লেখা পছন্দ না হয় তা না ফেলে এ গরিবকে জানালে আমি ওর নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের পাথেয় পাঠিয়ে দেব। আর কারুর কাছে ও একেবারে worthless হলেও আমার নিজের কাছে ওর দাম ভয়ানক—আমি কোনো কিছুরই কপি রাখতে পারি না। সেটি সম্পূর্ণ অসম্ভব।”

জীবনে ভবঘুরের মতো বিভিন্ন সময়ে যে কোনো পর্যায়ের কাজ হোক— সাঁতার শেখা হোক, গান রচনা করা হোক, বিবাহ হোক, নিয়মের দিকে আঙুল তোলা হোক—সবকিছুতে এক অপরাজেয় সৈনিকের মতো এগিয়ে আসছেন। হয়তো যুবাবয়সে এই কারণে তিনি সৈন্যদলে নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন।

আরো পড়ুন সেই আলোমানুষের অপেক্ষা

‘নজরুলের জীবনকথা’ নামক বইটিতে মোরশেদ শফিউল হাসান এসমস্ত কথাই প্রায় বত্রিশটি পর্যায়ে লিখেছেন। এই লেখার উদ্দেশ্য যে বইটি থেকে অজানা এক নজরুলকে জানা, তা ঠিক নয়। বইটির আসল অভিব্যক্তি হলো বইটিতে নজরুল সম্পর্কে জানা কথাগুলির প্রাসঙ্গিকতা নিরুপণ করে তার আরো কাছে যাওয়া। গল্পের ছলে এক কবির ভিন্ন ভিন্ন জীবনের ভূমিকা, তার লেখার প্রতিবন্ধকতা, জীবনের মুহূর্ত উঠে এসেছে বারবার—তাতে নজরুল ইসলামের ঠিক কর্ম, ভুল সিদ্ধান্ত সবই প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, মাঝেমাঝেই নজরুল ইসলামের কিছু চিঠির অংশ এবং সেই সময়ের প্রাসঙ্গিকতা ধরে তার জীবনের পরিস্থিতি, ভাবনাচিন্তা, সময়ের প্রকাশভঙ্গি উঠে এসেছে। আজকের মতোই সেই সময়েও সাহিত্যসমাজ যে বিনা প্রশ্নে সাদরে কোনো কবিকে গ্রহণ করেনি—উল্টো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি, তীব্র সমালোচনা এবং পাল্টে যাওয়া অভিমতের মানুষের সম্মুখীন হতে হয়েছে বিচ্ছিন্ন প্রতিভাময় কবিদেরও তা এই বই পড়ে ধারণা করাই যায়।

নজরুল জীবনকথা ।। মোরশেদ শফিউল হাসান ।। প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

এই বই পড়েই জানা যায়, মোহিতলাল মজুমদার প্রারম্ভিকতায় কাজী নজরুল ইসলামের লেখাকে সাদরে কাছে টেনে নিলেন, সেই তিনি দীর্ঘ সময় পরে তাঁকে পরোক্ষে কবিতা চুরির দায় দিতেও ভোলেননি। ভালোবাসা, প্রশ্রয় তাও কি খুব কম পেয়েছেন? নিশ্চয় নয়—জীবনের শুরু থেকেই বহু মানুষের ভালোবাসা তিনি পেয়েছিলেন। নিজের কেউ না হয়েও কাজী রফিজুল্লাহ যে অসীম স্নেহ নজরুল ইসলামকে দিয়েছিলেন তা অতুলনীয়। বন্ধু শৈলজানন্দের নিবিড় বন্ধুত্ব, বিরজাসুন্দরী দেবী যাকে নজরুল ইসলাম মা বলেই ডাকতেন, গিরিবালা দেবী—এদের সকলের কুণ্ঠাহীন ভালোবাসা পেয়ে দুই বাংলার এত হৃদয়কাড়া জীবনীশক্তি তাঁর মধ্যে আরো ঘনীভূত হয়েছিল। সেই এক চূড়ান্ত ধর্মীয় ভাবাবেগের মুহূর্তে ভরা সময়েও মানবিকতার মাটিতে নিজেকে লেপে ফেলতে পেরেছিলেন গিরিবালার মতো নারীর প্রশ্রয় পেয়েই। তার মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তই নজরুলের জীবনসঙ্গিনী হলেন প্রমীলা ধর্মের সকল বেড়াজাল ভেঙে। ধর্মের গোঁড়া ভাবনার বিরুদ্ধেই হোক, মসকরা করে প্রত্যুত্তর দিতেই হোক তিনি ছিলেন শক্তিশালী ও উদার। জেলে থাকাকালীন অনশন ভাঙতেও তার প্রত্যয়ের আগুন জ্বলে ওঠে।

বইটির রচনার বিশেষত্ব হলো এই বইটি মোরশেদ শফিউল হাসান খুব নিরপেক্ষ ভঙ্গিমায় লিখেছেন। শুধু একজন লেখককে যেনতেন প্রকারণে গৌরবান্বিত করে লিখেছেন তা নয়—পরিস্থিতি, মুহূর্ত তাদের আনুকূল্য, প্রতিবন্ধকতা সব এখানে উজ্জ্বলভাবে স্পষ্ট। যে ব্যক্তি শুধু প্রিয় কবি হিসেবে নয় একটি মানুষের জীবনের প্রেক্ষাপট ধরেও তাঁকে জানতে চাইবেন তাঁর কাছে এটি অবশ্যপাঠ্য। তবে সামান্য কিছু জায়গায় সময় ও প্রাসঙ্গিকতা দু একটি প্রশ্ন নিয়ে আসে তবে তা গৌণ বলেও ধরা যায়। সামগ্রিকভাবে প্রথমা প্রকাশনীর এই বইটি নিরবচ্ছিন্নভাবে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে জানার জন্যে একটি সহজ ও সুন্দর বই।

এ সম্পর্কিত আরও খবর