সেই আলোমানুষের অপেক্ষা
পরিস্থিতি এখন খুব সুখের নয় তবু আশা, যেমন দিন ছিল তেমন নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। সে তো আসবেই, যে ভারসাম্যের তাগিদে এই প্রকৃতিব্যাপী হেলদোল শুরু হলো সে তো ভারসাম্য আনবেই কিন্তু কথা হলো এই অজস্র জনজীবন, এই অজস্র ক্ষতির পূরণ কী হবে? যদি তা অপূরণীয় হয় তবে ধরে নিতে হবে তা সাজা—আর সেই সাজার মধ্যে ক্রমাগত কাটিয়ে আমরা কি জীবনের সুচারু রূপকে ধারণ করতে সক্ষম হব নাকি সব ফিরে পাওয়ার উল্লাসে আবার মানুষরূপী রাক্ষসে পরিণত হব পুনরায়! যদি হয়েও যাই তাতে প্রকৃতির কিছু যায় আসে না, তার দেহের ক্ষুদ্র ক্ষতি সে পূরণ করে নিতে জানে কিন্তু আমরা নিরুপায়—এই উপায়হীনতা আমাদের অক্ষমতা নয় আমাদের সহিষ্ণুতা ও বোধ তৈরির অস্ত্র হওয়া উচিত ছিল। উৎসমূলে অবস্থান করে তাকেই অতিক্রান্ত করতে চাওয়া হয়তো অন্যায় নয় কিন্তু তার ওপরে অবাধ স্বৈরাচার অন্যায়। পৃথিবীর কোথাও মানুষের মধ্যেই মানুষ সেই স্বৈরাচার মেনে নেয়নি। প্রকৃতি যার অনবরত তৈরি হওয়া প্রতিটি উপকরণে আমরা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীবের মতোই নির্ভরশীল তাকে ছাড়ানোর সময় তাকেই ব্যবহার করতে হয় মানুষকে ফলত এটা যেন মানুষকে গার্হস্থ্যে পাঠানোর আগে ব্রহ্মচর্যে ফিরিয়ে এনে শিক্ষা প্রদান।
এই করোনা ভাইরাস এখন অবধি বিশ্বে ষাট হাজারের ওপর মানুষের প্রাণ নিয়েছে বিভিন্ন দেশে—তার কী কারণ, কিভাবে ছড়াচ্ছে সবকিছুর বিজ্ঞানসম্মত কারণ ইতোমধ্যেই সচেতন মানুষেরা জেনে গেছেন, এই নিয়ে নতুন করে কিছুই বলার নেই। এর আগেও মানুষের শরীরের ভাইরাসের আক্রমণ হয়েছে ভয়াবহ—প্লেগ, ইবোলা, এইচ ফাইভ এন ওয়ান, মারবুর্গ,ডেঙ্গু, এইডস, পোলিও ইত্যাদি। ১৭২০-এ প্লেগ, ১৮১৭-তে কলেরা, ১৯২০-এ স্প্যানিশ ফ্লু। কোরান, হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, বাইবেল তাদের নিজেদের ধর্মীয় মতামত দিয়ে এদের একেকটা ব্যাখ্যা খুঁজেছে। বিজ্ঞান ক্রমাগত চেষ্টা করে ভ্যাকসিন বার করেছে কিন্তু সমস্ত কুসংস্কার, ধর্মীয় সীমাবদ্ধতা বাদ দিয়ে একটি প্রশ্ন মনে কি আসে না—কেন কখনো কখনো পর্যুদস্ত হয়ে যাই আমরা এতটা? আসলে আদানের প্রদানের ব্যবহার যেখানে ভারসাম্যমূলক সেখানেই আমরা নিরন্তর মহাখাদক হয়েছি, আমাদের ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, আমাদের নির্বিচারে গাছ কাটা আবাসন বানানো, যুদ্ধের মহা আগ্রাসী মনোভাব, হিংসা বিদ্বেষ সব কি শক্তির অনুকূলে?
ভাবতে অবাক লাগে যে জীব আপন উচ্চকিত প্রকাশে দম্ভ নিয়ে লম্ভঝম্ভ করে বেড়ায় সেই তাকে নিরীহ প্রাণীর মতো খাদ্যসংগ্রহ করে পুনরায় ঘর নামক গর্তে ঢুকে পড়তে হচ্ছে—মশকরার কিছু নয়, মানুষ আবার তার শক্তি ফিরে পাবে লম্ফঝম্ফ করবে কিম্বা আমরা সকলেই করব তবু যদি ক্ষণিকের জন্য ভাবা যেত আমরা তুচ্ছ! যত উন্নতি করি না কেন যার মধ্যে থেকে যার উপকরণ নিয়ে নিত্য এই উন্নতি তার মতিগতি বোঝা বা তাকে আয়ত্তে কখনোই সে পূর্ণমাত্রায় আনতে পারবে না তাই তো অজস্র সূত্রের মধ্যেই ব্যতিক্রম উঁকি মেরে পালায় ফলে নতুন সূত্র আসে আবার পুনরায় এক ঘটনা ঘটে। একটি ভাইরাস তথা একটি বিপর্যয় এই মুহূর্ত এনে দিল যে, যে যেটুকু পাব তাই খাব কেবল যেন সচেতন থাকি মানে আমাদের হাতে অনিবার্য কিছু নেই। কোনো ধর্মীয় বোধ ধরে নয় কেবল দর্শন হিসেবে গীতার এই কথাটি মনে আসে—“সৎ-এর কখনো অনস্তিত্ব হয় না আর অসৎ-এর কখনো স্থিতি হয় না—এখানে সৎ বা অসৎ যে ভালো মন্দের স্পষ্টত রূপক তা কিন্তু নয়। আসলে অসৎ সেইসব পার্থিব নশ্বর তথা ক্ষণস্থায়ী, যা কখনো আমাদের ছিল না কখনো আমাদের পূর্ণরূপে হবেও না; আর সৎ হলো সেই আত্মিক দর্শন বা জ্ঞান যা প্রতিকূলে অনুকূলে সবজায়গায় আমাদের প্রয়োজন অথচ আমরা এই নশ্বর অসৎকে নিয়েই তো লোভাতুর, তাই তো লোভীর মতো দাপিয়ে বেরিয়েও শূন্য হয়েই বসে আছি একমাত্র সৎ সেই আত্মিক দর্শনের কাছে গেলে শান্তি পাচ্ছি। তাই তো বলা হয়েছে ভোগও আসলে আমাদের হয় না, সব ভোগই কোনো না কোনো পথে বেরিয়ে যায়—শুধু যে আপেক্ষিক ভোগী সে সুখে, আনন্দে, লোভে, কষ্টে দূষিত হতে থাকে—অনেকটা ধূমপানের মতো ধোঁয়া আসলে গৃহীত হয়েও বেরিয়েই যায় শুধু মাঝপথে ধূম্রপায়ীকে দূষিত করে দিয়ে যায়”—শুনতে বা প্রাসঙ্গিকতায় ধর্মীয় হলেও ভাবলে বোঝা যায় এটা যুক্তিযুক্তভাবেই সত্যি।
আরো পড়ুন↴ গল্পের ওপারে মৃত্যুর হাতছানি
ভোগ তো আমরা ছাড়তে পারব না কিন্তু যদি নিয়ন্ত্রণ পারি তাও কি কম নয়! প্রকৃতির অপার রূপের সামনে একা একা দাঁড়ালে যেমন বোঝা যায় এই বিশাল ভয়ানক সুন্দর যার গায়ে পিঠে চড়ে তাকে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছি সে দুরন্ত, সে অবাধ্য, সে বলীয়ান নিজ শক্তিবলে, আমরা কেবলই তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রেক্ষক। উত্থানে পতনে আমরা তার আনুকূল্য পেলে বেঁচে যাব শুধু আর সেটাও তীব্র অনিশ্চিয়তায় ভরা—এই অভিযোজনের ভিন্নতা, এই অভ্যাস-অনভ্যাসের চরিত্র প্রকৃতি নিজ অঙ্গের আনুকূল্য ধরে বানিয়ে নিয়েছি আমরা সেই গা ধরে বেড়ে ওঠা বাস্তুর একেকটা ধাপে অবস্থান করি মাত্র।এই মুহূর্ত কিভাবে কতখানি প্রভাব ফেলল তাকে কাউন্টার না করে যদি এই প্রকৃতিকে আদতেই ভালোবাসি তাহলে কে বলতে পারে যোগ্যতম যোগ্যতমই রয়ে গেল অনন্তের পথে তাকে ইতিহাস হতে হলো না কেবল।