এসব শরীরভর্তি আত্মা

বিশেষ রচনা, শিল্প-সাহিত্য

তানিয়া চক্রবর্তী | 2023-09-01 19:11:38

“Sex without love is a meaningless experience, but as far as meaningless experiences go it’s pretty damn good.”

“The way you make love is the way God will be with you.”

এক তীব্র স্বর্গীয় অনুভূতির প্রাসঙ্গিকতা থেকেই হয়তো দ্বিতীয় এই বক্তব্যটি রুমি রেখেছিলেন। প্রথম বক্তব্যটি করেছিলেন আমেরিকার বিশিষ্ট পরিচালক উডি এ্যালেন। বিভিন্ন মানুষ তার মনোভাব, শরীরী সক্রিয়তা, হৃদয়, ব্যক্তিচরিত্রের ভিত্তিতে যৌনতা নিয়ে অজস্র কথা বলেছিলেন। ফলত যৌনতা জীবনের সঙ্গে কতখানি সৎভাবে যুক্ত, আদৌ যুক্ত কিনা এসকল প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি কারণ মানুষের ইন্দ্রিয়সচেতন জীবনে ভালোবাসার ভঙ্গিমার মধ্যে দিয়েই যৌনতা বহুসময়ে ঢুকে পড়েছে; কখনো যৌনতা লালসা ও হিংসা হয়ে গেছে; কখনো যৌনতা জন্মের বাহানা হিসেবে থেকে গেছে—তাই যৌনতা গোল গোল পথেই ঘুরে চলেছে ক্রমাগত।

তবু দূর থেকে যৌনতাকে দেখলে তার স্বরূপের কিছুটা বোঝা যায়—যে সেটা বুঝবে তাকে আবার শরীরী যৌনতাও জানতে হবে অথচ একই দেহ ও শরীরে এ পার্থক্য মন নির্ধারণ করতে অপারগ থাকে। ফলত বলে রাখা ভালো যৌনতার সম্যক রূপ আসলে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। ফলে যা লিখছি তা সিদ্ধান্তমূলক হতেও পারে নাও হতে পারে।

এ মানবশরীর আসলে সে মাংস যা আমরা খাই না—এ ভোগ তবে মহাভোগ। স্পর্শে, কামনায়, ছোঁয়ায় তাকে আস্বাদন করি। তার জন্য কিছু সংকেত, চিহ্ন, অঙ্গ আছে যা এই মাংসল চেতনাকে সমৃদ্ধ করে তোলে। আমরা উপভোগ করি, প্রকৃতি মূলত বাস্তু সামলায়। কারো উদ্দেশ্য সাধনে আমরা অধ্যাসে সুখী হওয়া জীব। শরীর আসলে আকাশের তুল্যমূল্য ক্যানভাস এত অনন্ত যে তাকে যৌন অঙ্গে, যৌনাচারে, যৌনশব্দে ভ্রমে বাঁধা হয়েছে—ফলে আসলে তা ভ্রমেরও মহিমা। আমরা ভাবি অঙ্গজ জনন, যৌন জনন—মানবেতর বেশিরভাগ প্রাণীতে উৎপাদন ও ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়াই মূল বস্তু। মানুষে আসলে তার মাত্রা চূড়ান্ত বদলে যায়—কারণ বোধের উত্তরণ ও তার অসীম প্রকরণ।

জীবনে যৌনতা কী? যৌনতা কী শুধুই শরীরী মিলন? আসলে তা যত না মিলনের রূপক ততোধিক ভাঙনের রূপক। যেমন আমরা যৌন শব্দের ব্যবহার বলি (স্তন, লিঙ্গ, যোনি) এগুলো তো মায়া, মমতা, জন্ম, রেচন, বর্জ্যের সংকেতেও পরিপূর্ণ রূপে প্রকাশিত। যদি দেহ এই পৃথিবীর ম্যাপ হয় তবে অঙ্গ তার ভূখণ্ড; সে উৎপাদনশীল না নিষ্কাশনকামী তা আলোচ্য নয়। এই যে যৌন শব্দ তাকে আমরা সর্বজনীন যৌনতার রূপকে যে ভাবি তা আমাদের ত্রুটি। তাই যৌন শব্দের ব্যবহার যৌনতার পরিচয় দেয় না সর্বদা। শরীর তো আসলে অশরীরী কারণ জন্ম থেকে সে ক্ষয় তথা বিয়োগের দিকে যায় তার দেহজ সংযুক্তিও আসলে তার বিযুক্তি! এই দেহ পূর্ণ অস্তিত্ব থেকে অনস্তিত্বে যায় ফলে এই নশ্বর দেহের যৌনতা আসলে খাবারের সঙ্গে জিহ্বার সম্পর্কের মতোই তাৎক্ষণিক গুরুত্বের—আসল উদ্দেশ্য উদরপূর্তির অথচ তার নিরূপণ স্বাদের আস্বাদনেই হয়। দেহ আসলে দেহকে বিয়োগ করে । দেহ শূন্য; আর এই শূন্যের ঘূর্ণিতে যৌনতা হলো মাতাল অবস্থা—এই সাংকেতিক উত্তেজনা আসলে মরীচীকার মতো কারণ কখনো এটি পূর্ণ সমাপ্তির জন্য তৃপ্ত হয় না; পুনরায় জাগ্রত হয়।

উর্দু ভাষার প্রসিদ্ধ লেখক কৃষণ চন্দরের গল্প ‘জঞ্জাল বুড়ো’ (অনুবাদ - অরুণকুমার মখোপাধ্যায়) গল্পে জঞ্জাল বুড়োর ক্ষয়িষ্ণু জীবনের শেষ মুহূর্ত কেবল মমতা ও স্নেহকে আশ্রয় করে পৃথিবীর এক রোমান্টিক, বিদগ্ধ মুহূর্ত তৈরি করে। জীবনের প্রারম্ভে দুলারী, তার শরীর, তার প্রেম, তার স্বামীসেবা, দুলারীর ফার্মের মালিকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া তাতে যে শিরশিরানি তৈরি করা যৌনতার আবেদন ছিল তা জঞ্জাল বুড়োর যন্ত্রণায়, বাৎসল্যে ধুয়ে মুছে ক্ষীণ হয়ে গেল—ভেতরে বায়বীয় আত্মিক অনুভূতি শরীরের বাইরের ভেতরের সকল কিছুকে তছনছ করে দিল।

আবার পাওলো কোয়েলহোর লেখা উপন্যাস ‘এগারো মিনিটে’ (অনুবাদ - সায়ন্তনী নাগ) শরীর অত্যধিকভাবে, পরীক্ষামূলকভাবে, যথেচ্ছাচারে, চূড়ান্ত স্বাধীনতায় বারবার মুক্ত হয়েছে। এখানে শরীর তার প্রতিটি বিন্দুকে, সময়কে উদযাপন করেছে অথচ সেখানেও শেষে শরীর আর থাকেনি। উপন্যাসের প্রথমদিকে নায়িকা মারিয়া তার ডায়েরীতে লিখছে “আমি আবিষ্কার করেছি কী কারণে একজন পুরুষ একজন মহিলাকে টাকা দেয়। সে সুখী হতে চায়। শুধুমাত্র অর্গ্যাজম পাওয়ার জন্য সে এক হাজার ফ্রাংক দেয় না। সে সুখী হতে চায়। আমিও চাই। সবাই চায়। অথচ কেউ সুখী নয়। আমার কী হারাবার আছে, যদি কিছুক্ষণের জন্য আমি ঠিক করি আমি হব একজন ‘…’। ভাববার বা লিখবার পক্ষেও এই শব্দটা এত কী কঠিন! কিন্তু এসো, নির্লিপ্ত হয়ে বলেই ফেলি! আমার কী হারাবার আছে যদি আমি কিছুক্ষণের জন্য এক বেশ্যা হব বলে ঠিক করি? সম্মান। সম্ভ্রম। আত্মমর্যাদা। যদিও আমি যখন ভাবি, দেখি আমার ওসব কিছুই ছিল না। আমার জন্মানোর কথা ছিল না। আমায় ভালোবাসার মতো কেউ ছিল না। এবার জীবন আমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিক।” এখানে শরীর তার শরীরী মুহূর্তকে চ্যলেঞ্জ করেছে। আবার এই উপন্যাসের অন্যত্র দেখা যায় অর্থের বিনিময়ে শরীরী খেলায় এমন লোক মারিয়ার জীবনে জোটে তাদের সঙ্গে নগ্ন অবস্থায় সে দেহ নয় দৃষ্টি আদান-প্রদান করে। একটা জায়গায় নায়িকা মারিয়া তার ডায়েরিতে লিখছে “কাল রাতে যখন র্যালফ হার্ট আমার দিকে তাকাল, সে যেন চোরের মতো একটা দরজা খুলল। কিন্তু যখন সে গেল, আমার কিছুই নিল না।—সব মানুষ তার নিজের কামনা অনুভব করে।—এ এক আবেগ যা আমার আত্মা বেছে নিয়েছে। আর এ এমন তীব্র যে আমার চারপাশের সবাইকে, সবকিছুকে সংক্রামিত করে।” এবার উপন্যাসের শেষে পর্যাপ্ত শরীরী মিলনের পর মারিয়া লিখছে “এ কোনো এগারো মিনিট নয়, এ অসীম। যেন আমরা দুজনেই আমাদের শরীর ছেড়ে বন্ধুত্ব এবং বোঝাপড়া নিয়ে আনন্দে হেঁটে চলেছি নন্দনকাননে। আমি নারী এবং পুরুষ, সেও পুরুষ এবং নারী। আমি জানি না এটা কতক্ষণ চলছিল, কিন্তু সবকিছু মনে হচ্ছিল নিঃশব্দ ধ্যানমগ্ন, যেন জগৎ ও জীবনের অস্তিত্ব নেই, তারা বদলে গেছে পবিত্র, নামহীন ও সময়হীন কোনোকিছুতে।”

আরো পড়ুন আলো মাখা পাহাড়

এই বক্তব্যের পরে উপন্যাসে র‌্যালফ তথা মারিয়ার পার্টনারের উক্তি পাই সেখানে, র‌্যালফকে মারিয়া প্রশ্ন করছে “একজন বেশ্যার প্রেমে পড়লে কী করে?” র‌্যালফ উত্তর দেয় “আমার মনে হয় এর কারণ, তোমার শরীর কোনোদিন আমার একার হবে না জেনে আমি মন দিয়েছি তোমার ঐ আত্মাকে জয় করাতে।” মারিয়া প্রশ্ন করে “তোমার ঈর্ষা হয় না?” র‌্যালফ উত্তর দেয় “তুমি বসন্তকে বলতে পারো না, এখানে এসো আর যতদিন সম্ভব থাকো।” এই উপন্যাস আসলে যৌনতাকে চেপে ধরে যৌনতাকে অতিক্রম করে ফেলেছে। ফলত যৌনতা আসলে যতখানি সুন্দর ও প্রশান্তি ততখানি সে একটা লোভ ও হাহাকার ফলে কামার্ত মানুষ নিজেও তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে।

৫ অগাস্ট দরজা খুলে দেখা গেল মেয়েটি নগ্ন হয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলেছিল ড্রাগের ওভারডোজ নিয়ে আত্মহত্যা। তিনি মেরিলিন মনরো। এই মৃত্যু নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। ছাপোষা সংসার থেকে শরীরের ডাক, শরীরের মাহাত্ম্য, নগ্নতার আবেদন, যৌনতার ভরপুর মন্থন নিয়ে যে মেয়ে নিজেকে স্বেচ্ছায় বাঁচিয়ে রেখেছিল সে শুধু মনের তাগিদে পাগল হতে থাকল! তার পুরুষের সংখ্যা বাড়তেই থাকল কাহিনীতে, জীবনে—তার চরিত্র, জীবন নিয়ে মানুষের আনন্দ, কুৎসা বাড়তেই থাকল কারণ সে যৌন সে শরীরী—অথচ শরীর তখন মন খুঁজছিল অথচ মানুষ বুঝেছিল শরীর অনর্গল বুঝি নতুন শরীর চায়। এই মননের খোঁজ, এটা সত্য হতে বাধ্য কারণ জীবনের মাত্রা তো এভাবেই আসে—বহু মূল্যবান বস্তুও বহুব্যবহারে লঘু হয়ে পড়ে—ফলে যদি দেহ কেবল দেহ হয় তবে তা কেবলমাত্র বস্তুই।

এ সম্পর্কিত আরও খবর