মনের ঘূর্ণি থেকে
আলো মাখা পাহাড়
বিকেলে সূর্যের আলো লাল হয়ে গিয়ে সারা এলাকা ছুঁয়ে দেয়, যেন লাল রঙের ফেট্টি বেঁধেছেন তিনি। লাল টিব্বা নামক জায়গাটির নামকরণ এইকারণেই। এ প্রান্তে দাঁড়ালে ঐ প্রান্তে দেখা যায় হিমালয়ের সারি সারি ত্রিকোন সমাবেশ, মেঘ ছোঁবে ছোঁবে করেও যেন ছুঁচ্ছে না। দূরে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে রিক্সাচালক ভাইটি, ওই যে গাড়োয়াল গ্রাম ওখানেই ওর বাড়ি, পাহাড়ের কোলে। কোথাও কোনো গন্তব্যে এসে মন আবিষ্ট হয় না নতুন করে কারণ পথ যে সৌন্দর্য উজাড় করে বসে আছে সেখানে গন্তব্য শুধু নামের বাহানা। মুসৌরী, আউলি উত্তরাখণ্ডের এইসব জায়গা অদ্ভুত কোনো প্রান্তিক জায়গা নয়, অনেকেই ঘুরেছেন আর এই বৈদ্যুতিনের যুগে যারা ঘোরেননি তাদের জন্যও গন্তব্য খুবই সহজ ফলে কিভাবে যাবেন ইত্যাদি কথায় আর অযথা আসছি না। আসলে খুব ক্ষুদ্র জায়গাতেও প্রকৃতি কখনো কখনো আবেশের আবহাওয়া নিয়ে আসে—সময়টা ছিল ঠিক সেরকম প্রকৃতি যেন দরাজ হয়ে তার রূপের অপার প্রহেলিকার খেলা শুরু করেছিল তখন পাহাড়েও। দিগন্তরেখায় পর পর নীল নীল ত্রিভুজ এঁকেছে যেন কোনো এক সরল শিশু এমনই এলমেলো ভাবে দেখা যায় তাকে।
উঁচুতে উঠলে তার কাঠিন্য ও গাম্ভীর্য দৃঢ় হয় যেন পরিণত শিল্পীর তুলির টান। রাতের বেলা পাহাড়ের ওপর থেকে দেখা যায় সারা শরীরে যেন আলোর মালা খেলছে—চূনী,পান্না, হীরের চকমকি দ্যুতিতে সে যেন মোহের সীমায় নিয়ে পৌঁছে যায়। অনতিদূরে রোপওয়েতে করে গানহিলে পৌঁছে বৃষ্টি আর ওলের (কুচি তুষারের রাশি) যৌথসান্নিধ্য পেয়ে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠল—আগুনের আদরে যারা গাঁ সেঁকে নিচ্ছে তাদের সঙ্গ নিলাম—এই ঠান্ডা ও গরম দুজনেই কী অপরিহার্য একক সময় তা বুঝিয়ে দিল। দুপাশে গোধূলির রঙ্গে আমোদে মেতেছে গাছেরা, পাখিরা। সন্ধ্যের খুচখাচ খাবারের পসরা নিয়ে স্বামী-স্ত্রী, বাচ্চা ছেলের দল বসে আছে। কোথাও ভুট্টা, কোথাও গরম গরম ম্যাগি, কোথাও মোমো, আলুর বড়া, পাইনের শুকনো কোন—এসবের মাঝে টুং টাং উইন্ডচাইমের হাসি, শালের দোকান আবার কখনো একটানা অন্ধকার পথের নিভৃতির বাতাসে মনে হচ্ছে কখনো বা পার্থিব কখনো বা অপার্থিবের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
প্রকৃতি এত রূপ নিয়ে নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে কিছুকাল পরে করোনা এসে তাকে দেখার এই মুহূর্ত কেড়ে নেবে কিন্তু তাতে প্রকৃতির কী যায় আসে! সে অনন্তকাল ধরে এই গড়নে, এই ধারণের নির্বাক ভূমিকায় লালিত। অনেক উঁচু দিয়ে চিল বয়ে যায় তার, মেঝেতে লোমশ কুকুরেরা প্রেম করে, মালগাড়ি বয়ে নিয়ে পড়ুয়া যুবা ম্যাগির দোকান খোলে, কাঠের বাক্সে পালিশ নিয়ে দেরাদুনের কলেজে পড়া ছেলেটি পাহাড়ের স্বাধীনতা শুঁকে নেয়। ছেলে মেয়ে ক্যাফেতে নির্নিমেষ বসে থেকে সূর্যের আসা যাওয়া দেখে পাহাড়ের খাঁজে। যেখানে দু-ধাপ হেঁটে শ্বাস ওঠে সেখানে মানুষ এই জীবন পাখির মতো দেখে। উটের পিঠের মতো (ক্যামেলস ব্যাক রোড) সজাগ সবুজ-খয়েরী পাহাড়ের দিকে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যের বৃদ্ধা কফি খায় আর যৌবনে তার প্রেমের কথা মনে করে হয়তো—ভেসে আসে চার্চের ঘণ্টা, আজানের সুর। উটের পিঠের মতো পাহাড়ে কালো চাদর নেমে আসে। উটের সেই অনন্ত পথের দিকে কুয়াশায় ভরে অস্পষ্ট হয়ে যায়। পথিক ঘুমিয়ে পড়ে বন্ধ দোকানের গায়ে হেলান দিয়ে আর পাহাড় তার যৌবন ফিরিয়ে আনার প্রয়াসে যেন তন্দ্রা যায়।
পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে ঝরনা, ক্ষীণকায়া—তার রূপে ভয় পাওয়ার মতো সুন্দর সে নয় তবু পাহাড়ের সঙ্গে সে আছে। এই ক্যাসানোভা পাহাড়ের এক নিরাময় ভরসা হয়ে সে যেন জেগে আছে। নাম তার ভাট্টা, কুলকুল তার স্রোত, যেন সাবধানী! যেন সে জানে কিভাবে চলতে হয় এ রাজকীয় কঠিন জটিল পথে। তাই টিকে গেছে সে ঝরনা হয়েও পাহাড়ের কুটিল, দাম্ভিক প্রেমিক বুকে। দু দণ্ড সমতলে সে নিজেকে মেলেছে যেন নিচু গলায়। যেন প্রেমের কাছে নতিস্বীকার করে নিজেকে সমর্পণ করে রেখেছে। এক খাঁজ থেকে আরেক খাঁজে এসে তার দেখা মেলে তাও প্রয়াস নিলে। নাহলে তাকে চেনা বা দেখা খুব উজ্জ্বল হয়ে প্রকাশিত হয় না। সে যেন ক্ষমতাশালী প্রেমিক পাহারের এক অসহায় প্রেমিকা যার অভিযোগের কোনো স্থান নেই।
মুসৌরী থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে সরকুণ্ডা দেবীর মন্দির। হিমালয়ের কোলে এই মন্দির ও তার রূপ যেন হাতছানিতে ভরা। যেখানে গাড়ি পার্ক করা হয় তার থেকে প্রায় ২৭৫৬ মিটার ওপরে এর অবস্থান। হিন্দু শাস্ত্রের মিথ অনুযায়ী মহাদেবের তাণ্ডবের সময় সতীর ছিন্ন দেহাংশের পীঠস্থান হিসেবে এর প্রতিষ্ঠা। এখান থেকে চারপাশের পর্বত যেন এক বিশাল স্তূপীকৃত সারি সারি পাহাড়ের উঠোন। কেউ কেউ খচ্চর, ঘোড়ায় করে ওপরে ওঠেন তবে হেঁটে হেঁটে ওঠার কষ্ট যেমন আছে প্রকৃতির রূপ গোগ্রাসে গিলে খাওয়ার অবসরও তেমন।
আরো পড়ুন আমার ব্যাঙাচি একদিন সাপ হবে
এক একটি খাঁজে খাঁজে এক এক রকমের রূপ। দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে সবুজ গাছ, জমে থাকা বরফ আর দূরে ঘিরে রয়েছে হিমালয় পর্বতমালা। পর্বতমালা যেন শেকলে বেঁধে মধ্যে ঘূর্ণিতে বসিয়ে তার খেলা দেখাচ্ছে। বহু কষ্ট করে উপরে উঠে মনে হবে এই তবে স্বর্গের রূপ—চারপাশে বরফ, সূর্যকিরণে তার চকমক করছে মধ্যে মন্দিরের চূড়া, আর অবিরাম হাওয়ায় ভরে যাচ্ছে চারপাশ। পৃথিবী এখানে বড় শান্ত, মাঝে মাঝে মধ্য আকাশে চিল উড়ে যায়। সুন্দরকে দেখার সতর্কতা দেয় বুঝি বা! যে যুবক পাহাড় এতক্ষণ নাচিয়ে নাচিয়ে প্রলুব্ধ করে এখানে নিয়ে এলো সে এখানে এসে যোগী হয়েছে যেন। স্থির গভীর ঋজু রূপ তার—সেখানেও প্রেম জাগে তবু তাকে ছোঁয়া যায় না। মরুভূমির মরীচিকার মতো এ যেন পাহাড়ের প্রহেলিকা।