কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ২)

আত্মজীবনী, শিল্প-সাহিত্য

জিনি লকারবি ।। অনুবাদ : আলম খোরশেদ | 2023-08-30 08:22:54

জয়বাংলার দেশে

[পূর্ব প্রকাশের পর] মাইকে করে শহরের বড় মাঠ, পার্ক ও স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠেয় রাজনৈতিক দলের সভাসমাবেশসমূহের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল দিনরাত। কখন কোথায় এইসব সভাগুলো হবে আপনাকে তার হিসাব রাখতে হতো, কেননা তখন শহরের সেইসব অঞ্চল দিয়ে চলাফেরা করাটা ছিল প্রায় অসম্ভব। সেরকমই একটি মিছিলে আটকা পড়ে এক সন্ধ্যায় আমার অফিসের একটা মিটিং হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল—এক ঘণ্টায় আমি রাস্তার মাত্র একটি মোড় অতিক্রম করতে পেরেছিলাম সেদিন। শহরের রাস্তাগুলো ছেয়ে থাকত যত প্রচার-প্রচারণার বিজ্ঞাপন ও শ্লোগানে আর শান্তি, সমৃদ্ধি, স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি সম্বলিত পোস্টারসমূহে।

অবশেষে সেই বিখ্যাত দিনটি, ৭ই ডিসেম্বর ১৯৭০, উপস্থিত হলো। লোকজন সব রাস্তায় নেমে এলো, তাদেরও সবারই গন্তব্য স্কুল, অনুষ্ঠানকেন্দ্র, আদালত ভবনে স্থাপিত ভোটকেন্দ্রসমূহ—যেখানে স্বেচ্ছাসেবীরা বসে আছে তাদের ব্যালট সংগ্রহের জন্য। প্রথমবারের মতো নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সবাই ভোট দেওয়ার সুযোগ পেল। ভোটের পরে একজন দিনমজুর তার মার্কিন মনিবের দপ্তরে গিয়ে হাজির হয়। চোখে পানি নিয়ে সে তার বুড়ো আঙুলখানি বাড়িয়ে দেয়। “আমার আঙুলের দাগটা দেখুন”, সে চিৎকার করে বলে, “এটা দিয়েই আমি আমার ভোট দিয়েছি।”

নির্বাচন বৈধ ও সুষ্ঠু ছিল, কিন্তু তার ফলাফল পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না।

সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ধরেই নিয়েছিলেন যে, জাতীয় সংসদের মোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৬৯টি আসনের ৬০ শতাংশ বড়জোর জিততে পারে আওয়ামী লীগ। বাকি আসনের ভোটাররা, তিনি ভেবেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানি প্রার্থীদের সমর্থন দেবে, যাতে করে মুজিব সারাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। কিন্তু বিস্ময়কর এক বিজয়ের ঘটনায় আওয়ামী লীগ ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আসনেই জয়ী হয়—যা ছিল সংসদের সামগ্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যথেষ্ট। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাধরেরা মুজিবকে চাপ দিচ্ছিলেন তাঁর ছয় দফার দাবিগুলোর ব্যাপারে আপোষরফা করার জন্য। জুলফিকার আলি ভুট্টো, পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস্ পার্টির প্রধান, যারা মোট ৮০টি আসনে জয়ী হয়েছিল, দাবি করেছিলেন যেন বাণিজ্য ও বিদেশি সাহায্যের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের হাতে থাকে। মুজিব এতে সম্মত না হলে ভুট্টো ১৯৭১ সালের তেসরা মার্চে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ অধিবেশন বয়কটের ঘোষণা দেন।

ফেব্রুয়ারি মাসে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সভা অনুষ্ঠিত হয়। তবে তা শেষ হয় অচলাবস্থায়। বাঙালিরা আঁচ করতে পারে যে, নির্বাচনের আগে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে না। সংখ্যাগুরু বাঙালি ও অবাঙালি বিহারিদের মধ্যেকার দীর্ঘদিনের শত্রুতা তখন রক্তাক্ত ধর্মঘট ও দাঙ্গারূপে বিস্ফোরিত হয়। লন্ডন অবজার্ভারের ১৮ই এপ্রিল ১৯৭১ সংখ্যায় বিহারিদের সম্পর্কে বলা হয়:

১৯৪৭ সালে দেশভাগের রক্তারক্তির সময় হিন্দুদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবার জন্য, ভারতীয় রাজ্য বিহারের এই উর্দুভাষী মুসলমানেরা শরণার্থী হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানে আসে। বিহারিরা, যাদের অধিকাংশই ছিল বণিকশ্রেণির, দ্রুত ভারতে পালিয়ে যাওয়া হিন্দুদের দোকানপাট দখল করে বসে। বাঙালিদের এই আতিথেয়তার বদলা দেয় তারা ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষী সৈন্যদের দালালি ও দেখভালের কাজ করে, যাদের সঙ্গে তারা অধিকতর নৈকট্য অনুভব করত। চট্টগ্রাম শহরে রাত্রি নামলে বেসামরিক গাড়িতে করে সেনাবহিনীর গুদামের অস্ত্রশস্ত্র বিতরণ করা হতো অবাঙালিদের ঘরে ঘরে। হঠাৎ করে সেই বাড়িগুলোতে অতিথিদের আগমন বেড়ে গেল—সাদা পোশাকপরা কমান্ডোসেনাদের। এইসব ঘটনার খবর জানাজানি হয়ে গেলে গুজবের ডালপালাও বাড়ে এবং বাঙালিরা তখন বাঙালি ছাড়া আর সবাইকেই অবিশ্বাস করতে শুরু করে। মার্কিন মিশনারিরাও এই রাজনৈতিক ডামাডোল থেকে মুক্ত ছিল না। আমার তা জানার যথেষ্ট কারণ ছিল।

এটা শুরু হয়েছিল খুব সাদামাটাভাবেই। আমাদের গির্জায় প্রার্থনা করতে আসা এক পরিবারের জনৈক তরুণ সদস্যের যক্ষা হয়েছিল। পরিবারটি যথেষ্ট আর্থিক দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তার ওপর বাড়ির বড়কর্তাও ভুগছিলেন কর্কটরোগে। আমি পুরো পরিবারটিকেই সরকারি যক্ষা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম আর তাদের পরিচালিত স্বাস্থ্যনিবাসের নির্বাহীর সঙ্গেও দেখা করেছিলাম এই আশায়, যদি তরুণটিকে সেখানে বিনা পয়সায় ভর্তি করে দেওয়া যায়। তো, ছেলেটিকে আমি নিজেই গাড়ি চালিয়ে সেখানে রেখে এসেছিলাম এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে, প্রতি সপ্তাহেই আমি তার পরিবারের কাউকে না কাউকে নিয়ে আসব তার কাছে।

আর তারপর আসে ১৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সাল।

আমি ছেলেটির মা, ঠাকুরমা, দশ বছরের বোন ও ঊনিশ বছরের ভাইকে নিয়ে তাকে দেখতে যাই। আমাদের খুব সুন্দর সময় কাটে সেখানে। আমি খাবারদাবার ও সেবার মান নিয়ে তার অভিযোগ শুনি এবং এই সিদ্ধান্তে আসি যে, সেখানে সে ভালোই রয়েছে। বাড়ি ফেরার পথে, ছোট মেয়েটি কোনোদিন সমুদ্র দেখেনি বলে, আমরা মূল রাস্তা ছেড়ে কয়েকমিনিটের মতো ভেতরের দিকে এগিয়ে যাই। সেই রাস্তায় প্রচুর নির্মাণসামগ্রী পড়ে ছিল : আলকাতরার ড্রাম, ইটপাথরের স্তূপ ও একটি গাড়ি। আচমকা একটি বাচ্চা মেয়ে রাস্তা পেরুতে শুরু করে। আমি ব্রেকে চাপ দিয়ে হর্ন বাজাতে থাকি।

মেয়েটি রাস্তা না পেরিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় এবং আমাকে দেখিয়ে বলে ওঠে : “দেখো, একটা মেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে।”

তারপর সে সরাসরি আমার গাড়ির দিকে এগিয়ে আসে।

আমি কোনোদিনই নিশ্চিত করে বলতে পারব না, এরপর কী হয়েছিল। ব্রেক কাজ করেনি, নাকি মেয়েটাই গাড়ির নিচে গড়িয়ে গিয়েছিল নাকি—আমি জানি না। কিন্তু অই মুহূর্তে আমি তার ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিই!

আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, বলাই বাহুল্য, গাড়ি থামিয়ে গিয়ে দেখা তাকে কোনো সাহায্য করা যায় কিনা। নির্মাণসামগ্রীর জঞ্জালের মধ্যেই এঁকেঁবেঁকে গাড়িটি পার্ক করার একটা জুতসই জায়গা খোঁজার মধ্যেই আমি শুনতে পাই, ঊনিশ বছরের নির্মল চিৎকার করে বলছে, “দিদি চালিয়ে যান, তাড়াতাড়ি গাড়ি চালান।”

ততক্ষণে প্রচুর মানুষ আমাদেরকে ঘিরে ধরেছে। বিশাল বিশাল ইট ও পাথর ছুঁড়ে মারা হচ্ছিল আমাদের দিকে, আমি স্টিয়ারিং হুইলে মাথা নামিয়ে সেই শিলাবৃষ্টি থেকে বাঁচার চেষ্টা করি। আমি মরে গেছি ভেবে নির্মল গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে পাগলের মতো ঘোরাতে থাকে। আমি সোজা হয়ে বসে, অ্যাক্সিলেটরে জোরে চাপ দিই, কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থাতেই যে-গাড়ির গায়ে তেমন একটা জোর ছিল না, তাকে নিয়ে এই লোহালক্কড়ে-ঢাকা পথে আমি বেশিদূর এগুতে পারি না।

ভিড় করে আসা লোকের দঙ্গল রাস্তায় সদা-উপস্থিত বেবিট্যাক্সি ও সাইকেলগুলো দিয়ে আমাদের রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে শুরু করে।

তারপর শুরু হয় সত্যিকারের সংকট। তারা আমার গাড়ির চাবি নিয়ে নেয়, গাড়িটাকে চিৎ করে ফেলতে চেষ্টা করে, সামনের উইন্ডশিল্ডের জায়গায় সৃষ্ট বিশাল ফুটো দিয়ে তারা নির্মলকে টেনেহিঁচড়ে বার করে নিয়ে বেদম পেটাতে শুরু করে।

ঘটনার পরম্পরা আমার কাছে এখনো একটু অস্পষ্ট, তবে হঠাৎ করে একজন পাকিস্তানি প্রকৌশলীর আগমনের কথা মনে আছে। তিনি ঘটনাটা আন্দাজ করেন, একজন সুদর্শন ব্যক্তিকে গাড়ির কাছে পাঠিয়ে তিনি নিজে যান পুলিশের কাছে। আমাদেরকে পাহারা দেবার জন্য যাকে পাঠানো হয়েছিল তিনি আসলে একজন দোকানদার ছিলেন, যিনি আবার স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের একজন নির্বাচিত সদস্যও। তিনি জনতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কাজটা ভালোভাবেই করেন, একই সঙ্গে আমাদের বলতে থাকেন যে, তিনি না এসে পড়লে আমাদের সবাইকে মারা পড়তে হতো, তবে এখন যেহেতু তিনি আছেন, তখন আমাদের আর ভয়ের কিছু নেই! এই হট্টগোলের মধ্যে নির্মল এক ফাঁকে সটকে পড়ে এবং রিকশা করে ছয় মাইল দূরে, চট্টগ্রাম শহরে আমাদের মিশনের সদরদপ্তর তথা বাইবেল ইনফরমেশন সেন্টারে গিয়ে হাজির হয়।

নির্মল যখন সাহায্যের জন্য ছুটছিল, তখন আমি, ছোট মেয়েটি, তার মা ও ঠাকুরমা শত্রুপক্ষে পরিপূর্ণ সমুদ্রের মধ্যে একটি দ্বীপের মতো বসে ছিলাম।

‘বিদেশি!’, ‘আমেরিকান!’, ‘খ্রিস্টান!’ এই অভিধাগুলো গালির মতো করে বারেবারে ছুঁড়ে মারা হচ্ছিল আমাদের দিকে। আমি আমার স্থান বদল করার সাহস পাই না, কেননা আমি ভাঙা কাচ আর ইটের টুকরো দ্বারা চতুর্দিকে পরিবেষ্টিত হয়ে ছিলাম।

মানুষগুলো যখন গাড়ির ওপর হামলে পড়ছিল তখন ছোট মেয়েটি আতঙ্কে ছটফট করছিল। তার মা আমার কথা বলে জনতার সঙ্গে বোঝাপড়া করার চেষ্টা করছিলেন। “সে একজন নার্স। তাকে সাহায্য করতে দিচ্ছেন না কেন? আপনারা ছোটো বাচ্চাটিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দিচ্ছেন না কেন? আমাদের একটা ভালো হাসপাতাল আছে। মেয়েটি সেখানে ভালো হয়ে যাবে।”
বৃদ্ধাটি পেছনের সিটের এক কোনায় সোজা হয়ে বসে ‘হায় যিশু’, ‘হায় যিশু’ করেই যাচ্ছিলেন।

দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে। আর সন্ধ্যা সাতটায় দিকে আমাদের মিশনের রেভারেন্ড রেইড মিনিখ আসেন অকুস্থলে। (নির্মলের মুখ থেকে ঘটনার রুদ্ধশ্বাস বর্ণনা শুনে তিনি এত দ্রুত ঘটনাস্থলের দিকে রওনা দেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে ততদিনে তিনদফা দায়িত্ব পালন-করা প্রবীণ মিশনারি রেভারেন্ড জিন গুরগানুসকেও বলে আসতে পারেননি, তিনি কোথায় যাচ্ছেন। জিন শুধু অ্যাক্সিডেন্ট শব্দটি শুনতে পান, আর কিছু নয়।) ঠান্ডা, অন্ধকারে সেই দোমড়ানো গাড়ির ভেতরে বসে থাকা আমাদের কাছে রেইডকে তখন হোন্ডায় চেপে আসা, ‘চকচকে বর্মগায়ে একজন সেনাপতির’ মতো মনে হয়েছিল।

তিনি কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন এবং দ্রুতই আমরা একটা পুলিশের গাড়িতে করে বাড়ির দিকে (তিনি ভেবেছিলেন আর কি) যেতে থাকি। পুলিশ চালকের অন্য ভাবনা ছিল মনে। সে আমাদেরকে থানায় নিয়ে যায়, যেখানে আমাকে গণ্য করা হয় একজন ‘অপরাধী’ হিসাবে। আমি উঠে দাঁড়ালে তারা আমাকে বসতে বলে। একসময় তারা নির্মলের পরিবারকে যেতে দেয়, এবং তারা আমার খবর জানাতে সোজা গিয়ে হাজির হয় গুরগানুসের বাড়িতে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই জিন এসে উপস্থিত হন। এখন তাদের বন্দী হলো দুজন! আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের একজন বিশুদ্ধ ভদ্রলোক, জিন বুঝেছিলেন ততক্ষণে আমার একটু ‘হালকা হবার’ প্রয়োজন পড়ার কথা। তিনি খুব বিনয়ের সঙ্গে পুলিশ অফিসারের কাছে তাদের বাথরুমের অবস্থান বিষয়ে জানতে চান।

“এখানে সেরকম কিছু নেই,” তার ত্বরিৎ জবাব আসে।
“কী বলছেন আপনি, অবশ্যই কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা থাকবে এখানে,” জিন বলেন।
“আপনারা সেটা ব্যবহার করতে পারবেন না। আপনারা ঘর ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন না।” অফিসার চিৎকার করে বলেন।
“আপনি এরকম একটি অনুরোধে কিছুতেই না করতে পারেন না,” জিন জোর দিয়ে বলেন।

অফিসার তখন হার মানেন। বাইরে তখন অন্ধকার হলেও জিন আর আলো চেয়ে তাঁর ভাগ্যের ওপর বাড়তি কোনো চাপ সৃষ্টি করার ঝুঁকি নেন না, তিনি একটা বাচ্চা ছেলেকে রাস্তার ওপারের দোকান থেকে মোমবাতি কিনে আনতে পাঠান। আমরা তখন বাইরের ঘরের দিকে এগুতে থাকি : মোমবাতি হাতে একটি ছোটো ছেলে, একজন পুলিশ প্রহরী, জিন ও আমি।

রাত সাড়ে নয়টার দিকে মিনিখ সব আইনি ঝামেলার ফয়সালা করে ফেরত আসেন। ‘জনতা’, যার মধ্যে ছিল ছোট মেয়েটির গ্রামের লোকজন, (তবে মেয়েটির বাবা মায়ের সম্পর্কে খুব কমই জানা গিয়েছিল), চায়নি পুলিশ কোনো মামলা করুক। জনতা একটা জরিমানা নির্ধারণ করে—ছয়শত টাকা। এটাকে নাকি কম করেই ধরা হয়েছে কেননা : এক. ঘটনার শিকার মেয়ে, দুই. তার কোনো শিক্ষাদীক্ষা ছিল না, তিন. সে গরিব ঘরের মেয়ে ছিল। আমার কাছে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় ছিল এটাই যে, তাদের মধ্যে একজনও একটি প্রাণের বিয়োগে কোনোপ্রকার দুঃখপ্রকাশ করেনি। ভাবখানা ছিল এরকম যে, “কী হয়েছে যে সে মারা গেছে! সবাইকেই তো মারা যেতে হয়।” তারা ঘটনাটির পুরোপুরি একটি জাতীয়তাবাদী ও রাজনৈতিক চেহারা দিতে চাইছিল : আমি বিদেশি। আমি একজন বাঙালির ক্ষতি করেছি।

বেশ কয়েক সপ্তাহ পরেই কেবল আমি বুঝতে পারি আমার অবাঙালি হওয়ার বিষয়টা সেদিন কতখানি বিপক্ষে গিয়েছিল আমার।

পরে নির্মল সেই যক্ষা হাসপাতালে তার ভাইকে দেখতে গিয়েছিল আবার। ঝোঁকের মাথায় সে দুর্ঘটনাস্থলের কাছেই একটি চায়ের দোকানে ঢোকে এবং কৌশলে আলোচনাকে সেদিনের ঘটনার দিকে নিয়ে যায়।

“আপনাদের মনে আছে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ এখানে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল?” সে জিজ্ঞাসা করে।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ”, সবাই তার বর্ণনা দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে।
“একজন সাদা মেমসাহেব গাড়িটা চালাচ্ছিলেন,” সবাই একযোগে বলে ওঠে।
“কী ঘটেছিল আসলে?” নির্মল তাদের উস্কে দেয়, আর তারাও তাদের মতো করে খুঁটিনাটির বিবরণ দিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সে জিজ্ঞাসা করে, “মেয়েটি কি মরেই গিয়েছিল?”
“মারা গিয়েছিল? না, সে মারা যায়নি তো! আপনি তাকে দেখতে চান?”

নির্মল ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। আমাদেরকে এই গল্প করতে করতে সে তার রাগ চেপে রাখতে পারছিল না এই কারণে যে, তারা আমাদেরকে বোকা বানিয়ে ‘জনতা’র কথা বলে আসলে স্থানীয় নেতাদের পকেট ভারি করেছিল।

আমার সেটা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। বাচ্চা মেয়েটা বেঁচে গিয়েছিল সেটাই বড় কথা! তবে, সেদিনের ঘটনাটিকে ঘিরে আমার মনে সারাজীবন এক অদ্ভুত, বর্ণনাতীত অনূভূতি জেগে থাকবে, সন্দেহ নেই। [চলবে]


কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১)

এ সম্পর্কিত আরও খবর