কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১)

  • জিনি লকারবি ।। অনুবাদ : আলম খোরশেদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

ভূমিকা

বই লেখার চেয়ে দূরবর্তী আর কিছু ছিল না আমার মনে। ১৯৭১-এর ঘটনাসমূহ আমার হৃদয়মনে এমন গভীরভাবে দাগ কেটে আছে যে, সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য কোনো লিখিত বয়ানের দরকার পড়ে না। আমি সেইসব ঘটনাকে লিপিবদ্ধ করে রাখি, এহেন পরামর্শের প্রতিক্রিয়া ছিল তাই স্রেফ হেসে উড়িয়ে দেওয়া।

সেই বছরটি আমার মনে যে-স্মৃতি ও অনুভূতির উদ্রেক করে সেগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য দলিলপত্র কোথায় পাব আমি? আর, একটি পাণ্ডুলিপিকে গুছিয়ে তোলার মতো এত সময়ই বা আমার কোথায়? সেই সঙ্গে রয়েছে ইতোমধ্যেই কাজে ঠাসা দিনের ব্যস্ততার মধ্যে আরো কিছু নাছোড় প্রয়োজনের নিরন্তর রক্তচক্ষু প্রদর্শন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ভাবতে ভাবতে এবং প্রার্থনায় বসে আমি টের পাই, আমি আসলে এই প্রস্তাবনাটিকে মনে মনে বিবেচনা করছি। আমরা যারা সেই দিনগুলোতে বেঁচেছিলাম এবং জেনেছিলাম প্রভুর ওপর নতুনভাবে নির্ভর করা বলতে আসলে কী বোঝায়, শুধু আত্মরক্ষার জন্যমাত্র নয়, বরং জরুরি রসদ সরবরাহর জন্যও বটে, তাদের দায়িত্ব রয়েছে এই বাঁচার কৌশলগুলো অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার।

বিজ্ঞাপন

পড়ার টেবিলের ড্রয়ার ঘেঁটে আমি আঁকিবুঁকিকরা কাগজপত্র, পত্রিকার কাটিং এবং একখানা নোটবই, যাকে আমি মজা করে বলতাম ‘আমার জার্নাল’, খুঁজে বার করি। এইসব আরম্ভ থেকেই উৎপত্তি হলো অবশেষে এই আস্ত গ্রন্থটির।

আমরা যারা এই দেশে কাজ করছিলাম তাদের কাছে নাটকীয় এবং বিয়োগান্ত ঘটনাবলি অপরিচিত ছিল না মোটেও। ১৯৬৩ সালে মিশনারিদলে যোগ দেওয়ার পর থেকে আমরা এই এলাকার বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়গুলো দেখেছি, যে-স্থানটিকে বর্ণনা করা হতো ‘উপকূলীয় অঞ্চলে ঝড় ডেকে আনা জলবায়ুজনিত শোষণবাটি’ বলে; আমরা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের সবচেয়ে মেধাবী ভাষাবিদ বন্ধুটিকে মৃত্যুবরণ করতে দেখেছি; একসঙ্গে মারাত্মক এক রোগভোগ করেছি, যার কারণে আমাদের হাসপাতাল এবং মিশনের অন্যান্য দপ্তর পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হয়েছিল; এই অঞ্চলে খ্রিস্টের নামে নিবেদিত গির্জার জন্মপ্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে গিয়ে হতাশা ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় বেঁকে গিয়েছি।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু ১৯৭১-এর ঘটনাসমূহ এর সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়।

এই বইয়ের ভেতর দিয়ে আমার, আমার সহকর্মীদের এবং বাংলাদেশি ভাইবোনদের (খ্রিস্টান ও অখ্রিস্টান নির্বিশেষে) যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা বর্ণনার উদ্দেশ্য আমার দ্বিবিধ:
—এই সময়টাতে যে-অসংখ্য ছেলেমেয়ে ও নারীপুরুষ তাদের অব্যর্থ প্রার্থনা ও বস্তুগত সাহায্যের মাধ্যমে আমাদের উপকার করেছেন তাদেরকে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যোগানো
—তাদের সেই প্রার্থনারাশিকে, সত্যিকার ‘শেষহীন প্রার্থনা’টুকু এই নবজাত বাংলাদেশ ও তার পুনর্গঠনে লিপ্ত নবীন সরকারের উদ্দেশ্যে ন্যস্ত করা

বহু লোকেরই ধারণা নেই যে, ঈশ্বর তাদের ভালোবাসেন ও তাদের বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে তিনি আগ্রহী এবং যিশু তাদের জন্যই প্রাণ দিয়েছেন। প্রার্থনায় সমবেত বিশ্বের সকল খ্রিস্টধর্মীর প্রচেষ্টায় আমরা বাংলাদেশে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারি, যাতে করে সকল জাতি ও বর্ণের বিশ্বাসীরা এই সুসমাচারটুকু প্রচার করে যেতে পারেন।

জিনি লকারবি
চিটাগাং, বাংলাদেশ

বার্তা২৪-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণিত অধ্যায়


জয়বাংলার দেশে

এখন মধ্যরাত। জানালাগুলো আটকানো ও অর্গলবদ্ধ। সব দরজায় তালা। সামনের সিঁড়িতে কাঁটাতার বিছানো। বাঁশের আসনে বসা একটা ছোটখাটো সাদাকালো কুকুর, চোর আসার সামান্যতম ইঙ্গিতেও খেঁকিয়ে ওঠার জন্য উৎকর্ণ। কেননা এটা বাংলাদেশ—একটি ক্ষুধার্ত দেশ!

বাইরে তখনও গুঞ্জরিত হচ্ছিল মানুষজনের আওয়াজ। গাড়িরা দ্রুত ধাবমান। একজন রিকশাচালক তার ঘণ্টি বাজায়। বাচ্চারা কাঁদে। ঘুমাতে যাবার আগে বুড়িরা সুপুরি ছেঁচে, দিনের শেষ পানটি মুখে দেবে বলে। পুরুষেরা পায়চারি করে, এবং দিনের এই সময়েও কেউ একজন ঠিকই চিৎকার করে বলে ওঠে, জয় বাংলা! কেননা এটা বাংলাদেশ—একটি সুখী দেশ।

ক্ষুধা এখানে বরাবরই ছিল; আনন্দই বরং নবাগত।

আমি যখন নিউইয়র্কের ব্রুকলিন মেথডিস্ট হাসপাতালের ধাত্রীবিদ্যা স্কুলের ছাত্রী ছিলাম, তখনই জীবনে প্রথম জন্ম নামক অলৌকিক ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করি। আমি তখন জানতাম না যে, একদিন, অর্ধেক পৃথিবী দূরে, একটি গোটা জাতির জন্মদৃশ্যের সাক্ষী হবার সৌভাগ্য হবে আমার।

ঐতিহাসিকেরা সম্ভবত এটা স্বীকার করবেন যে, ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তানের দেশ ভাগাভাগির সময় থেকেই একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে বাংলাদেশের উৎপত্তি অনিবার্য ছিল। তবে, আমরা যারা এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গেছি তাদের কাছে এটা ছিল এক নিদারুণ যন্ত্রণাদায়ক জন্ম। একটা স্বাধীন দেশের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের অনুকূলে ছিল না কিছুই। অবশিষ্ট পাকিস্তান থেকে হাজার মাইলেরও বেশি দূরে অবস্থিত, একটি শত্রুরাষ্ট্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন, পূর্ব পাকিস্তান ছিল ব্রাত্য ও সৎবোনতুল্য। তদুপরি, এই দুই অংশের মধ্যে সাদৃশ্যও ছিল খুব কমই। পশ্চিম পাকিস্তানিরা লম্বা, তাগড়া, সামরিক জাতি; বাঙালিরা ছোটোখাটো, কোমল ও কবিস্বভাবের। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আকৃতি, প্রকৃতিতে আরবি-সদৃশ ভাষা উর্দুতে কথা বলে, আর বাঙালিরা তাদের সংস্কৃত-দুহিতা বাংলাকে নিয়ে গর্ব করে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা গম, আটাখেকো জাতি আর বাঙালির পাতে ভাত না থাকলে মনে করে তার খাওয়াই হয়নি বুঝি। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ব্যবসাবুদ্ধিতে দড়, আর বাঙালিরা ঐতিহাসিকভাবে কৃষিকর্মে সিদ্ধহস্ত।

এমনকি আবহাওয়াও ছিল ঐক্যের বিরোধী। পশ্চিম পাকিস্তানের ভূপ্রকৃতি ছিল চরম ভাবাপন্ন: সুউচ্চ পর্বত আর রুক্ষ মরুভূমি, পাহাড় থেকে নেমে আসা জলধারা আর তপ্ত, শুকনো সমতলভূমি। বাংলা হচ্ছে নদী আর শ্যামলবরণ উর্বর কৃষিজমিতে ছাওয়া, ধানচাষের মৌসুমে যা মহামূল্যবান হিরে-মাণিক্যের মতো চকচক করে ওঠে। বস্তুত, যে-একটিমাত্র বন্ধন এই দুটি বিচ্ছিন্ন অংশকে এক করে রেখেছিল সেটি হচ্ছে ইসলাম ধর্ম। তবে পূর্ব অংশে সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিশাল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজনের মেলামেশার কারণে এমনকি এই বন্ধনটিও বুঝি তেমন মজবুত ছিল না।

পাকিস্তানের গঠনপ্রক্রিয়ার একেবারে ভিত্তিমূলে প্রোথিত এইসব প্রকট পার্থক্যের কারণেই যে এই বৈষম্যেরও সূত্রপাত, সেটা বুঝতে তেমন কষ্ট হওয়ার কথা নয়। বহু ক্ষেত্রেই এই বৈষম্য দৃশ্যমান ছিল। সম্ভবত সবচেয়ে প্রকট ছিল এইগুলো:
এক. পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ ও পণ্য, যেমন পাট ও চা, থেকে উপার্জিত অর্থ এবং প্রাপ্ত বিদেশি সাহায্যের সিংহভাগই পূর্বকে বঞ্চিত করে পশ্চিম পাকিস্তানে চালান হয়ে যেত।
দুই. অর্থনৈতিক নীতিমালার পক্ষপাতও ছিল পশ্চিমাংশের প্রতি: শুল্ককাঠামো ও নীতিমালা, আমদানি অনুমতিপত্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির কারণে পশ্চিম থেকে পণ্য কিনতে বাধ্য হতো পূর্ব পাকিস্তান। প্রায়শই সেগুলো হতো অতীব নিম্নমানের, যা সাধারণ বিশ্ববাজার থেকেই অনেক কম দামে কেনা যেত।
তিন. উচ্চশিক্ষার সুযোগ ও বিদেশে পড়াশোনার জন্য বৃত্তিসমূহও অশোভনরকম অধিক হারে বরাদ্দ থাকত পশ্চিম পাকিস্তানি প্রার্থীদের জন্য।
পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের হিসাব মতেই ১৯৬৯-১৯৭০ বছরের অর্থবছরে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৬১ শতাংশ বেশি ছিল।

কিন্তু একজন ঠিকই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন এই লাঞ্ছিত, বঞ্চিত বাঙালিদের স্বার্থরক্ষায়। তাঁর নাম? শেখ মুজিবুর রহমান—আদর করে যাকে সবাই ডাকত ‘মুজিব’ বলে। তিনি বাঙালির কাছে কোনো আগন্তুক ছিলেন না। একটি মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণকারী এই মানুষটি মফস্বলের এক মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা শেষে প্রথমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়ন করেন। সেখানেই তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য ছাত্রদের সংগঠিত করতে থাকেন। তাদের দাবি আদায়ের লক্ষে তিনি তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠন করেন। এই অপরাধের জন্য তাঁকে জেলে প্রেরণ করা হয় এবং পরবর্তী দুই দশক তিনি দেশের বিভিন্ন কারাগারে কেবল আসা-যাওয়া করতে থাকেন। তাঁর অপরাধ যে আসলে কী ছিল সেটা কখনোই স্পষ্ট করে বলা হয়নি, কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাঁকে শত্রু ও পাকিস্তানের প্রতি হুমকি বলে বিবেচনা করত। ১৯৬৬ সালে তিনি ছয় দফা প্রণয়ন করেন, যা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন দাবি তোলে: স্বায়ত্তশাসন, স্বাধীনতা কিংবা বিচ্ছিন্নতা নয়! মুজিবের এই রাজনৈতিক মঞ্চ পশ্চিম পাকিস্তানের ইসলামাবাদভিত্তিক কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অবসান দাবি করে কার্যত। কেবল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র দপ্তর থাকবে কেন্দ্রের অধীন আর বাকি সব; শুল্ক, বাণিজ্য ও বিদেশি সাহায্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ ন্যস্ত হবে দুই প্রদেশের ওপর।

বাতাসে বিপদের আভাস পাওয়া যায়।

চট্টগ্রামের জীবন, ঘূর্ণিঝড় আর অন্যবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাঝখানে, কখনোই সেই অর্থে স্বাভাবিক ছিল না (সেটার মানে যা-ই হয়ে থাকুক)। তবে, তার চেয়েও অন্ধকার ও অলক্ষুণে মেঘের ছায়া এই অঞ্চলের নড়বড়ে নিরাপত্তাকে ভয় দেখাচ্ছিল তখন।

রাজনৈতিক সংকট ঘনিয়ে আসছিল।

অশান্ত পূর্ব পাকিস্তানকে, যার জনসংখ্যা ছিল পশ্চিম থেকে কয়েক কোটি বেশি, শান্ত করার জন্য ১৯৭০ সালের কোনো এক সময়ে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

সেই নির্বাচনের সময় অবশ্য পাল্টাতে থাকে, অংশত, সম্ভাব্য তারিখের আগে-আগে এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মানবেতিহাসের ভয়ঙ্করতম জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়টির কারণে, যার আঘাতে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের মৃত্যু এবং কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটে।

ধ্বংসযজ্ঞের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর সবার চিন্তা আবার নির্বাচনের তারিখের দিকে নিবদ্ধ হয়। দেশের তেইশ বছরের ইতিহাসে সেই প্রথমবারের মতো একটি অবাধ ও উন্মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল।

কিন্তু যেখানে মাত্র বিশ শতাংশ মানুষ সাক্ষর সেখানে নির্বাচনের প্রচারণা চালানো এবং তা বাস্তবায়িত করা কিভাবে সম্ভব? কেমন করে? অবশ্যই ছবি ব্যবহার করে। রাস্তার প্রতিটি কোনা, প্রতিটি ল্যাম্পপোস্ট, দেয়ালের প্রতিটি শূন্যস্থান কোনো না কোনো দলের প্রতীকচিহ্নে ভরে ওঠে। সেগুলো ছিল সাইকেল, গরুর গাড়ি, হাতি, দাঁড়িপাল্লা, ছাতা ইত্যাকার নিত্যব্যবহার্য বস্তুর ছবি, যা এমনকি নিরক্ষর লোকেরাও চিনতে পারত সহজেই। বিশটিরও বেশি দলের সবারই ছিল একটি নির্দিষ্ট প্রতীক। তবে অগুরুত্বপূর্ণ এইসব জিনিসের ছবিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল, শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রতীক তথা নৌকার ছবি। [চলবে]