কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১০)

আত্মজীবনী, শিল্প-সাহিত্য

জিনি লকারবি ।। অনুবাদ: আলম খোরশেদ | 2023-09-01 20:02:07

ঈশ্বর কাউকে বলেন ‘থাকো’, কাউকে ‘যাও’

[পূর্ব প্রকাশের পর] “আমি হাসপাতালের কাজ চালিয়ে যেতে থাকি। আমার বিভাগ ছিল ক্যান্সার গবেষণা ও রেডিওথেরাপি, কিন্তু শহরে এরকম দাঙ্গাহাঙ্গামা ও হত্যাকাণ্ড, বিশেষ করে বন্দর এলাকায় সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসকে কেন্দ্র করে, চলতে থাকায় আমাকে অধিকাংশ সময়ই কাটাতে হচ্ছিল জরুরি বিভাগে।”

“২৬শে মার্চ রাতে ঘুমাতে যাবার সময় আমি রেবার কাছে স্বীকার করি যে, আমার খুব অস্থির ও বিষণ্ন লাগছে। আমি তাকে ব্যাখ্যা করে বলি, কাছেপিঠে কোথাও গুলির শব্দ পেলেই সে যেন বিছানা ছেড়ে মেঝেতে নেমে যায়। রাত দশটায় ঠিকই গোলাগুলি শুরু হলো।”

আমরা দুজন, এবং আমাদের পারিবারিক বন্ধু ও সাহায্যকারী, হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে খাবার টেবিলের নিচে আশ্রয় নিই এবং বাকি রাত সেখানেই কাটাই। সকালে আমরা আমাদের বিপজ্জনক অবস্থানের কথা উপলব্ধি করি। একটা রাস্তার একেবারে শেষ মাথায়, সেনাছাউনি থেকে মাত্র দু’শ গজ দূরে আমাদের বাড়ির অবস্থান। দুই দিক থেকেই আসা বুলেটগুলো আমাদের মাথার ওপর, চারপাশ এমনকি বাড়ির ভেতর দিয়েও ছুটে যাচ্ছিল। আমরা যে-এলাকায় ছিলাম সেটি ছিল শহরের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল। আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরের মোড়েই কমপক্ষে সাত হাজার লোককে নির্বিচারে মেরে ফেলা হয়েছিল। রাস্তার ধারের খোলা ড্রেনে গলেপচে যাবার জন্য ফেলে দেওয়া লাশের স্তূপ থেকে একজন আহত ব্যক্তি হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় তাকে পাওয়া গিয়েছিল ঘটনার কয়েকদিন পর।

“আমরা যেটুকু খাবার ও কাপড়চোপড় সঙ্গে নেওয়া সম্ভব নিয়ে মেডিকেল কলেজের উদ্দেশে রওনা দিই। আমরা তিনজন রেডিওথেরাপি বিভাগে আশ্রয় নিয়ে চারপাশটা একটু গুছিয়ে নিই। আমরা সেখানে তখনও পর্যন্ত রয়ে যাওয়া রোগীদের জন্য পরিবেশটাকে যতটা সম্ভব হাসপাতালতুল্য করে তুলি। নার্সদের প্রায় সবাই-ই চলে গিয়েছিল; কেবল পাঁচজন ডাক্তার তখনও ছিলেন। আমাদের কোনো খাবার, পানি কিংবা বিদ্যুৎ ছিল না। অষুধপত্রের কোনো অভাব ছিল না, অভাব ছিল কেবল সেগুলো প্রয়োগের জন্য দক্ষ মানুষগুলোর।”

আমি যতদিন বাঁচব, আমার চোখের দিকে কাতর চোখে চেয়ে থাকা এক বাবার মুখের অভিব্যক্তির কথা আমার মনে থাকবে। “আমি আপনাকে যত টাকা চান দেব”, তিনি দম না ফেলে বলেন। “শুধু আমার বাচ্চাগুলোকে বাঁচান।” তার পাশেই স্ট্রেচারে শোয়ানো ছিল তিনটি শিশু, এরই মধ্যে মৃত।

“একজন বৃদ্ধও মারা যাচ্ছিলেন। তিনি একটু পানি পান করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পাঁচশ সিটের এই সাততলা হাসপাতালের কোথাও এক ফোঁটা পানি ছিল না তাঁকে দেওয়ার মতো। আমি রোগীর শিরায় ঢোকানোর জীবাণুমুক্ত তরলের বোতল খুলে তাঁর শেষ ইচ্ছাটুকু পূরণ করি।”

“বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা সাহসের সঙ্গে চেষ্টা করে যাচ্ছিল পাহাড়চূড়ায় তাদের কৌশলগত অবস্থানগুলো ধরে রাখার জন্য। ২৮শে মার্চের রাতের বেলায় সব আলো নিভে যায়। সেই অন্ধকারের মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা শহরে ঢুকে পড়ে জোরপূর্বক। কেউ কেউ এসেছিল সাঁজোয়া যানে চড়ে, বাকিরা ড্রেনের ভেতর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে। ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও বিপুল গোলাবারুদে সজ্জিত পাকিস্তানি সৈন্যদের বিপুল সংখ্যাধিক্যের কাছে হার মেনে বাঙালি সেনারা এক পর্যায়ে পশ্চাদাপসরণ করে।”

“আমার দেওয়া সদুপদেশ উপেক্ষা করে রেবা স্নান করার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। সিকি মাইল দূরে নার্সদের হোস্টেলে তখনও পানি ছিল। সে যখন স্নান করছিল ঠিক তখনই সেই দালানটিতে বেশ কিছু কামানের গোলা এসে আঘাত করে। পানির তোড়ের শব্দে এবং অনেকদিন বাদে পরিচ্ছন্ন হতে পারার আনন্দে রেবা সেই গোলাগুলির শব্দ শুনতে পায়নি। অল্প যে-কটা মেয়ে ছিল সেখানে তারা পালানোর আগে রেবার বাথরুমের দরজায় আঘাত করে তাকে সচেতন করে। সে তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টে দৌড়ে আসতে থাকে আমাদের কাছে। আমি তাকে হোঁচট খেয়ে জুতোজোড়া খুইয়ে পড়ে যেতে দেখলে, কোনোমতে খালি পায়েই তাকে টেনে নিয়ে আসি নিরাপদ আশ্রয়ে।”

বাঙালিদের প্রতিরোধ ভেঙে গেলে, পাকিস্তানি সেনারা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। একজন ক্যাপ্টেন একদিন হাসপাতালে এসে, কর্মচারীদেরকে বেদম মারপিট করে বলে, “আমি যদি এখানে কোনো গোলাবারুদ পাই তাহলে পুরো হাসপাতালটা উড়িয়ে দিয়ে প্রত্যেককে গুলি করে মারব।”

“আরেক ক্যাপ্টেন ওপরের তলায় গিয়ে জানালায় দাঁড়িয়ে তার নিশানা পরীক্ষা করতে শুরু করে। তার দৃষ্টিসীমায় যে কোনো পথচারীকে দেখলেই তাকে মাটিতে শুয়ে পড়ার হুকুম দিত এবং তার পরপরই গর্জে উঠত তার অস্ত্র। আমিও যে কোনো দিন সেই প্রাণঘাতী হুকুম শোনার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকি।”

৩১শে মার্চ হাসপাতালের এক প্রান্তে অবস্থিত ডাক্তারদের হোস্টেলে বসে আমরা খাচ্ছিলাম। হসপাতালের মূল লবিতে আসার পর আমরা ওপরতলায় বুটের লাথির শব্দ পাচ্ছিলাম।

হঠাৎ করে দেখি এক সেন্ট্রি আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে আছে। “আমরা এই বিল্ডিং থেকে গুলির শব্দ পেয়েছি। আমরা এ জায়গাটা ভালো করে তল্লাশি করে দেখব,” সে ব্যাখ্যা করে বলে।

“আমাদেরকে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে নিয়ে একটা ব্যক্তিগত ঘরে আটকে রাখা হয়। আমরা কোনো অপরাধ করিনি, মাতৃভাষা ছাড়া আমাদের আর কোনো দোষ নেই। আমরা যে বাঙালি ছিলাম!”

“একজন ক্যাপ্টেন ও তার কিছু চেলা দুদ্দাড় করে এসে ঘরে ঢোকে। হাসপাতাল পরিদর্শনের সময় তারা একজন বিহারি রোগীর দেখা পায়, যে-তাদের কাছে অভিযোগ করে, গত পাঁচদিন ধরে নাকি তার ব্যান্ডেজ বদল করা হয়নি। একজন উর্দুভাষী রোগীর সঙ্গে এরকম অশ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ করার জন্য ক্যাপ্টেন সাহেব রাগে ফুঁসছিলেন। তিনি আমাদের দিকে তাঁর বন্দুক উঁচিয়ে ধরেন। তাঁর এক স্বদেশী, পশ্চিম পাকিস্তানের এক মেডিকেল শিক্ষার্থী, তাঁকে মিনতি করে বলে: ‘আমাদের হাসপাতালে মাত্র পাঁচজন ডাক্তার আছেন। তাঁরা হয়তো এমন সামান্য একটি বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় পাননি।’ ক্যাপ্টেন তার যুক্তিতে কান দেন না। বন্দুক উঁচু করে তিনি বলেন, ‘তোমাদের সবাইকেই মরতে হবে’।”

“ঠিক ঐ মুহূর্তে বারান্দায় পাহারারত এক সৈনিক দৌড়ে এসে চিৎকার করে বলে, ‘তাড়াতাড়ি আসুন, আমরা একজন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাকে দেখতে পেয়েছি।’ ক্যাপ্টেন তখন ঠিক একটা গুলির মতো ছিটকে গেলেন। তাঁর লোকেরাও তাঁকে অনুসরণ করল। (কেউ কেউ তক্ষুণি অভিযানে নেমে পড়তে চাইছিল, তবে অনেকেই বিকাল চারটার জলখাবারের জন্য সটকে পড়ার তালে ছিল।) হঠাৎ আমি লক্ষ করি যে, সবাই চলে গেছে। একজন সৈন্যও সেখানে ছিল না আমাদের পাহারা দেবার জন্য।”

“বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে, বিল্ডিংয়ের বাইরে বেরিয়ে একটা অল্পব্যবহৃত ফটক গলে পড়ন্ত বিকেলের অন্ধকারে মিশে যাই। তারপর, তখনও মুক্তিবাহিনীর দখলে থাকা এলাকায় অবস্থিত আমার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমরা আর একবারের জন্যও থামিনি। তবে সেটা ছিল স্রেফ একরাতের বন্দোবস্ত। পরদিন ভোরে সিলভেস্টার, রেবা, আমি আর দুই মুসলিম ডাক্তার শহর ছেড়ে পালাই। আমার মাথায় ছিল, পটিয়া পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে সোজা ভারত চলে যাওয়ার চিন্তা। তখন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছিল। আমি এর আগে চিকিৎসা-ত্রাণের কাজ করেছি, নিশ্চয়ই সেখানকার কোনো শিবিরে আমি কাজ পেয়ে যাব। কিন্তু রেবা, যে-তখন তিন মাসের গর্ভবতী ছিল, যথেষ্ট ধকল পুইয়েছে এর মধ্যে। সে আর দৌড়ঝাঁপ করতে চাইল না।”

‘আমি আমাদের বাড়ির গির্জার একটি মেয়েকে চিনি, মালুমঘাট হাসপাতালে কাজ করে,’ রেবা বলে, ‘চলো আমরা সেখানেই যাই। তারা নিশ্চয়ই আমাদের ঢুকতে দেবে।’

“আমি একটু সংশয়ে ছিলাম, সেটা স্রেফ আমরা একেবারে আগন্তুক বলে নয়, আমার ‘খ্রিস্টান’ পরিচয়টা নিয়েও। অবশ্যই আমি খ্রিস্টান ছিলাম। খ্রিস্টান পরিবারেই আমার জন্ম। কিন্তু উচ্চশিক্ষা আমার দৃষ্টিকে প্রসারিত করে দিয়েছে। আমি তখন ভাবতাম যে, আপনি বাইবেল পড়লে বাইবেলে বিশ্বাস করবেন, আর বিজ্ঞান পড়লে বিশ্বাস করবেন বিজ্ঞানেই। যারা মনে করেন বাইবেলই সত্য, তাঁদের ওখানে গিয়ে আশ্রয় নেবার ব্যাপারটা আমাকে তেমন টানেনি, কিন্তু আমি এও বুঝেছিলাম যে, রেবার ওপর আর চাপ দেওয়া যাবে না।”

“আমরা এপ্রিলের ৪ তারিখ, রবিবার শেষ বিকালে মালুমঘাট খ্রিস্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছাই। আমাদেরকে তাদের গ্রহণ করার ব্যাপারে দুশ্চিন্তার তেমন কিছু ছিল না। রেবা তার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে, এবং বেকি ডেইভি, হাসপাতালের ম্যাট্রন, বাকিটা করেন। তিনি আমাদের থাকার জায়গারও ব্যবস্থা করেন। আমাদের গেরস্থালির প্রয়োজনগুলোও তিনিই মেটান। তিনি আমার স্ত্রীর জন্য শাড়ি, পেটিকোট ও জুতার বন্দোবস্ত করেন। তিনি একজন দারুণ মানুষ ছিলেন।”

“ধর্মীয় ব্যাপারগুলোতে আমরা দাশ পরিবারের সঙ্গে জোট বাঁধি। তাঁরা ঈশ্বর ও বাইবেল বিষয়ে তাঁদের সোজাসাপ্টা চিন্তাভাবনাসমূহ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেননি; তাঁরা খ্রিস্টের জীবন যাপন করতেন। আমাকে তাঁরা তাঁদের সঙ্গে প্রার্থনা করতে উৎসাহিত করতেন। আমি আন্তরিকভাবেই এই প্রার্থনা ব্যাপারটাকে একটু পরখ করে দেখতে চেয়েছিলাম। তিনি আসলে কে এবং তিনি ঠিক কতটা করতে পারেন, আমাদের জন্য সেটা প্রমাণের একটা সুযোগ আমি দিতে চেয়েছিলাম ঈশ্বরকে।”

ডা: পিটারের সঙ্গে আপনাদের আবারও দেখা হবে। [চলবে]


কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৯)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৮)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৭)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৬)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৫)

এ সম্পর্কিত আরও খবর