মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রয়োজন

, যুক্তিতর্ক

মাহমুদ আহমদ | 2023-09-01 06:34:43

গত কয়েক দিন ধরে গাজায় ইসরায়েলিরা ভয়াবহ নারকীয় তাণ্ডবলীলা চালানো শুরু করেছে। ঈদের দিনেও জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদ চত্বরে ঢুকে ইসরায়েলি পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেটে তিন শরও বেশি ফিলিস্তিনি আহত হওয়ার পর গাজা ভূখণ্ড থেকে সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলের দিকে রকেট ছোড়া শুরু করে। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর এমন নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে আমরা তীব্র নিন্দা জানাই।

আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের মুসলমানদের ওপরও নির্মম এবং বর্বর হামলা পরিচালিত হয়েছে এবং লাখ লাখ রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে মাতৃভূমি ছেড়ে আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছে।

এমন বর্বর ও নিষ্ঠুর হামলা শুধু ফিলিস্তিনিদের ওপর বা মিয়ানমারেই নয় বরং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে। সমগ্র বিশ্বে কেন মুসলমানরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে? এর একটাই কারণ, তাহল মুসলিম আজ শতধা বিভক্ত হয়ে পরস্পর ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত।

মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর পরস্পরের মাঝেই নেই ঐক্য। মুসলমানদের এই অনৈক্যের কারণেই ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়তে দ্বিধাবোধ করছে না। সমগ্র মুসলিম বিশ্বের এই চরম বিপর্যয়ের একমাত্র কারণ-তাদের আজ কোন ঐশী নেতা নেই। যেহেতু মুসলিম জাহান আজ ঐশী নেতৃত্ব শূন্য অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে তাইতো এই অধঃপতন। মুসলিম বিশ্বের একতাই পারে জাতি সমূহকে শক্তিশালী জাতিতে রূপান্তরিত করতে। আজ যদি সমগ্র বিশ্বের ইসলামী এককক নেতা থাকতো তাহলে কারো এই সাহস থাকতো না মুসলমানদের ওপর এমন নির্মম অত্যাচার করার।

সারা পৃথিবীতে আজ ইহুদী, নাসারা আর মুশরিকরা তাদের ক্ষমতা বিস্তার করতে চায়। এ কারণে তারা সারা পৃথিবীতে তাদের অপশক্তির ক্ষমতা পাকা-পোক্ত করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই সন্ত্রাসী কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে ইঙ্গ-মার্কিন পরাশক্তি। ইঙ্গ-মার্কিন এ পরাশক্তি কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো বা পরোক্ষভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ইহুদী, নাসারা আর মুশরিকদের মূল টার্গেট হচ্ছে মুসলিম জনগোষ্ঠী। তারা জানে যতো দিন মুসলিম জাতি মাথা উঁচু করে থাকবে, ততোদিন তাদের ক্ষমতা পৃথিবীর বুকে টিকে থাকবে না। তাই তারা সংঘবদ্ধ হয়ে মুসলিম নিধনে অগ্রসর হচ্ছে। এই টার্গেট নিয়ে আজ গোটা পৃথিবীতে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের স্টীমরোলার চালিয়ে যাচ্ছে। যাতে মুসলমান পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে।

বর্তমানে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, আরাকান, চেচনিয়া, বসনিয়া, আফগানিস্তান, হার্জেগোভিনা, লেবানন, ইরাক প্রভৃতি মুসলিম দেশ। সামান্য অজুহাত দেখিয়ে শান্তিপ্রিয় মুসলিম দেশগুলোর ওপর টনকে-টন বোমা ফেলে তাদের ঘাড়ে দৈত্যের মতো চেপে বসছে। এতে লাখ লাখ নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশু অকাতরে মারা যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো এই মৃত্যুলিলা খেলা আর কতকাল চলবে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলতে পারি যতদিন সমগ্র মুসলিম বিশ্ব এক ঐশী নেতৃত্বের পতাকাতলে না আসবে ততো দিন এই মৃত্যুলিলা খেলা বন্ধ হবার নয়।

আমরা ইরাক, আফগানিস্তানের কথা বাদই দিলাম, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কথাই যদি ধরি তাহলে দেখতে পাই আধিপত্যবাদীদের হাতে দীর্ঘদিন ধরে শৃংখলিত হয়ে আছে ৮০ লাখ নিরীহ কাশ্মীরবাসীর জীবন। ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে এই উপত্যকায়, তবু বিশ্ববাসী কেন নিরব?

যেহেতু প্রায় সমগ্র এলাকাটি মুসলমানদের, তাই স্বভাবতঃই পৃথিবীর সব মুসলমান অবশ্যই এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন।

বিশেষ করে, মুসলিম দুনিয়ার সবচেয়ে প্রিয় স্থানদ্বয় পবিত্র মক্কা এবং মদিনাও আজ বিপদ ও ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন। যেসব মুসলিম রাষ্ট্র আজ ইসলামের নামে বড়াই করছে, প্রকৃতপক্ষে তাদের কর্মকাণ্ড ইসলামি শিক্ষা বা ন্যায়-নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। বরং তারা নিজ স্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট। এ জন্যই ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন কার্যক্রম ও পদক্ষেপে স্ববিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। আজ যদি সবাই কোরআনের শিক্ষা অনুযায়ী একক নেতেৃত্বের অধিনে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব চলতো তাহলে অবশ্যই মুসলমানরা সর্বত্রে মার খেত না।

ইসলাম আল্লাহর মনোনিত ধর্ম। তাই ইসলাম মানুষের মনে অসাধারণ গুণের ও মাহত্মের উন্মেষ ঘটাবে এটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতপক্ষে ঘটেছিলও তাই। স্বনিষ্ঠ ইসলাম অনুসারীদের মাঝে দেখা গিয়েছে বহু অসাধারণ গুণের ও মাহত্মের সমাবেশ। একনিষ্ঠ ইসলামের অনুসারীরা হয়েছিল সকল অসাধারণ মানবিক, নৈতিক ও মহৎ গুণের অধিকারী।

এজন্যই ইসলামের অনুসারী মুসলমানরা সর্বক্ষেত্রে অতি আশ্চর্যজনক সাফল্য লাভ ও সুমহান কীর্তি স্থাপন করে সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে এক অতি গৌরবোজ্জল ঐতিহ্য। তাদের সে সাফল্য প্রকৃতই অতীব বিস্ময়কর। মুসলমানেরা হয়েছিল বিশ্বের অর্ধেকের মালিক। তারা প্রবল প্রতাপ ও শান-শওকতের সঙ্গে শাসন করেছে অর্ধজাহান। শৌর্যবীর্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থনীতি প্রকৃতি সকল ক্ষেত্রেই তাদের সাফল্য ছিল অতীব চমকপ্রদ। কোন ক্ষেত্রেই কোন জাতিই ছিল না তাদের সমকক্ষ।

মুসলমানেরা বিশ্বে সকল ক্ষেত্রেই ছিল শীর্ষস্থানীয়, নেতৃস্থানীয়। যুদ্ধ হতে শুরু করে জীবনের সকল ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনে সক্ষম হওয়ায় তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বব্যাপী। সে যুগে মুসলমানেরাই দিয়েছিল বিশ্বনেতৃত্ব। অসাধারণ জাতিরূপে, শ্রেষ্ঠতম জাতিরূপে মুসলমানেরাই লাভ করেছিল প্রতিষ্ঠা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের সাফল্য ও খ্যাতি এতই অসাধারণ ছিল যে, তারা আখ্যায়িত হয়েছেন বহু আলংকারিক বিশ্লেষণে, প্রশংসিত হয়েছেন উচ্চসিত ভাবে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বড় বড় মনীষীগণ কর্তৃক। বহু অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ায় মুসলমানেরা উন্নতির শীর্ষে পৌঁছেছিল সত্য, তবে একথা বলাই বাহুল্য যে, পরবর্তীকালে সময়ের সঙ্গে তাল রেখে আরও এগিয়ে যেতে, নিজেদের সে প্রতাপ, প্রতিপত্তি, প্রাধান্য ও বিশ্ব নেতৃত্ব বজায় রাখতে তারা হয়েছিল ব্যর্থ।

এর কারণ কি? শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে এবং অর্ধ জাহান শাসনের বিশ্বনেতৃত্ব যাদের গৌরবময় ঐতিহ্য, তা আজ কোথায়? আজ এত এত মুসলমান দেশ থাকা সত্তেও কেন পারছে না মিয়ানমারে গণহত্যা বন্ধ করতে? কেন পারছে না মুসলমান বিশ্বনেতৃত্ব দান করতে? এর একমাত্র কারণ হলো-মুসলিম বিশ্বের কোন একক নেতা নেই। নেতা শূন্য বলেই মুসলমানরা সমগ্র বিশ্বে অপদস্থ হচ্ছে। আজ এ অনৈক্যের কারণেই দেশে-দেশে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই আছে, এ শেষ হবার নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না মুসলিম বিশ্ব এক ইমামের নেতৃত্বে চলবে। যে জাতির কোন আধ্যাত্মিক নেতা নেই, সেই জাতিকে কী জীবিত বলা যায়? সে জাতি তো মূলত মৃত।

আজ সমগ্র বিশ্বে কোটি কোটি মুসলমান রয়েছে ঠিকই কিন্তু তাদের নেই কোন নেতা, যিনি সবার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহর নিকট চাইবেন, জাতির দুঃখে পাশে এসে দাঁড়াবেন। কেউ কি আজ বলতে পারে যে, তাদের এই ধরনের আধ্যাত্মিক নেতা রয়েছে? কোন মুসলিম সম্প্রদায় আজ এমন নেই যারা বলতে পারবে যে তাদের এমন এক নেতা রয়েছেন, যিনি আমাদের জন্য দোয়া করেন, আমাদেরকে আলো দেখান। বর্তমান সমগ্র বিশ্বের একক ইসলামি নেতার খুবই প্রয়োজন। একক নেতৃত্ব ছাড়া বিশ্বের মুসলমান মাথা উঠিয়ে দাঁড়ানো কোন মতেই সম্ভব নয়। সমগ্র মুসলিম বিশ্বের আবার মাথা তুলে দাঁড়ানো খুবই প্রয়োজন।

লেখক: ইসলামী গবেষক কলামিস্ট, -মেইল- masumon83@yahoo.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর