কে বাস্তবায়ন করবে শ্বেতপত্রের সুপারিশ?
একটি চৌবাচ্চায় যতই পানি ভরা হোক, সেখানে ছিদ্র থাকলে পানি ধরে রাখা সম্ভব হবে না। একদিক দিয়ে পানি ঢালা হলেও ছিদ্রের কারণে অন্য দিক দিকে সব পানি বের হয়ে যাবে। চৌবাচ্চা পরিণত হবে শুষ্ক ও পানিশূন্য ভাণ্ডে। ফলে পানি সংরক্ষণ করতে হলে সবচেয়ে আগে চৌবচ্চার ছিদ্র সারাতে হবে।
দুর্নীতি হলো চৌবাচ্চার ছিদ্রের মতো। যতই আয় হোক, উৎপাদন হোক, দুর্নীতি থাকলে সঞ্চয় ও সমৃদ্ধি বলতে কিছুই হবে না। অভাব ও হাহাকার লেগেই থাকবে। তাই সমাজকে উন্নত, দারিদ্র্য মুক্ত ও আর্থিকভাবে মজবুত করতে হলে অবশ্যই দুর্নীতি দূর করতে হবে।
জুলাই বিপ্লবের পর যে সরকার বাংলাদেশের ক্ষমতায় এসেছে, তা অতীতের গতানুগতিক সরকারের মতো নয়। এই সরকারের শরীরে লেগে রয়েছে মানুষের রক্ত-মিশ্রিত অঙ্গীকার পালনের দায়বদ্ধতা। যার মধ্যে রয়েছে বৈষম্য রোধ করা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজের উপর অর্পিত দায়িত্বসমূহ পালনের পথে বেশ কিছু কাজ করেছে। যার ভিত্তিতে কিছু সংস্কার ও পরিবর্তন সম্ভব হবে এবং দুর্নীতি, অনিয়ম ও বৈষম্য রোধ করা সহজ হবে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের লক্ষ্যে শ্বেতপত্র প্রকাশ। যাতে এসব সেক্টরে অনিয়ম, বৈষম্য ও দুর্নীতির প্রকৃত কার্যকারণ স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। দেশের নেতৃস্থানীয় বিশেষজ্ঞদের দিয়ে প্রণীত এইসব শ্বেতপত্র বস্তুনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত দলিল স্বরূপ, যার সুপারিশের ভিত্তিতে দুর্নীতি, বৈষম্য ও অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে এবং প্রতিরোধের পথ প্রশস্ত হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্নহলো, এইসব শ্বেতপত্র প্রকাশই শেষ কথা? নাকি এগুলোর বাস্তবায়ন করাই জরুরি বিষয়? অবশ্যই এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। নচেৎ অতীতের মতো বস্তাবন্দী হয়ে এগুলো পোকার পেটে যাবে। যদি পোকা খাদ্য হয়, তাহলে এতো আয়োজন করে এগুলো প্রণয়ন ও প্রকাশ করা হলো কেন? এই প্রশ্ন জনমতে সৃষ্টি হবেই।
অতএব, জরুরি ভিত্তিতে এসবের বাস্তাবয়ন করতে হবে। কিন্তু কে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে? যে সরকার এগুলো প্রণয়ন করিয়েছে, বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাদের উপরই বর্তায়। ভবিষ্যতের সরকার এসব কাজের দায় দিতেও পারে কিংবা না-ও নিতে পারে। তাছাড়া ভবিষ্যতের সরকারগুলো জুলাই বিপ্লবের রক্তরঞ্জিত চেতনা বাস্তবায়নে কতটুকু তাগিদ অনুভব করবে, সেটাও এখনই বলা সম্ভব নয়। ফলে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই এইসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।
তবে এক্ষেত্রে একটি সংশয় রয়েছে। তাহলো, বর্তমান সরকারের পক্ষে শ্বেতপত্রের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা কতটুকু সম্ভব হবে? নাকি মতলববাজ মহল এসব বাস্তবায়নে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে? এই সংশয় অমূলক নয়। কারণ, বাংলাদেশের মতো দুর্নীতি ও অনিয়মের দেশে সমস্যা চিহ্নিত করার পর সমস্যার প্রতিরোধ বা সমাধান করতে গেলে পদে পদে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা হয়। এদেশে ভালো ভালো কথা ও ভালো পরিকল্পনা করা যত সহজ, সেগুলো বাস্তবায়ন করা ততই কঠিন। অতীতে বহু ভালো ও মহৎ উদ্যোগ নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানেও এমনটি হয় কিনা, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে ভীতি, সন্দেহ ও সংশয় রয়েছে।
কারণ, বাংলাদেশ বছরের পর বছর অনিয়ম, বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতকে পুষ্টি জুগিয়েছে। সমাজ ও রাজনীতিতে স্বার্থ গোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছে। এইসব স্বার্থবাদী গোষ্ঠী দু্র্নীতি ও বৈষম্য প্রতিরোধের পথে কালাপাহাড়ের মতো অবরোধ সৃষ্টি করবেই। বাস্তবায়নের কাজগুলো সম্পন্ন হলে এইসব অপশক্তির স্বার্থ নষ্ট হবে। বিধায় তারা রাজনৈতিক দিক থেকে, প্রশাসনিক দিক থেকে, সামাজিক দিক থেকে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে শ্বেতপত্রের সুপারিশ বাস্তবায়ন হতে দেবে না। তারা চাইবে দুর্নীতি ও অনিয়ম থাকুক। এতে জনগণকে ঠকিয়ে তাদের পক্ষে ফায়দা হাসিল করা সহজ হবে।
কিন্তু বর্তমান সরকারকে স্বার্থগোষ্ঠীর বিরোধিতা, প্রতিবন্ধকতা ও চাপের কাছে নতি স্বীকার করলে মারাত্মক ভুল হবে। সকল বিঘ্ন ঠেলে সংস্কার বিষয়ক প্রস্তাব ও সুপারিশ তাদেরকেই বাস্তবায়ন করে যেতে হবে কিংবা বাস্তবায়নের ধারার সূচনা করে যেতে হবে। এতে দুর্নীতি ও বৈষম্যের অতীত মুছে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে। কিংবা তাদেরকে এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করতে হবে, যাতে শ্বেতপত্র, সংস্কার প্রতিবেদন, সুপারিশ প্রকাশই শেষ কথা না হয়, সেগুলোর বাস্তবায়নও নিশ্চিত হয়। সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশের শাসন কাঠামোতে এমন একটি পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া থাকা দরকার, যেখানে ছিদ্র-রূপী দুর্নীতি চিরতরে বন্ধ হয় এবং দেশ ও জনগণের সম্পদ বেহাত ও লুটপাট হতে না পারে।
প্রসঙ্গত, শ্বেতপত্র নিশ্চয় কোনও ঐশ্বরিক দলিল নয়। এর ভুলভ্রান্তি থাকলে সেগুলোকে সংশোধনের এবং সময় সময় আপটুডেট করার রাস্তাও খোলা রাখতে হবে। একটি চলমান পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও সুশাসনের পক্ষে শাসন ব্যবস্থার অব্যাহত গতিই হওয়া উচিত যেকোনও সংস্কার ও পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি, এই সত্যটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সরকার পরিচালনায় সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই মনে রাখতে ও পালন করতে হবে। আর এটা বর্তমান সরকারের মতো ভবিষ্যতের সরকারগুলোকেও বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হবে দুর্নীতিমুক্ত সুশাসনের প্রয়োজনেই।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।