এইতো একদিন আগে আম্মার সাথে তুমুল কথা কাটাকাটি হয়। আমি তো আমার যুক্তিতে অনেক কথাই বললাম। আমাদের দেশের মেয়েরা স্বাধীন ভাবে চলতে ফিরতে পারছে। অর্থনৈতিক ভাবে আমার দেশের মেয়েরা অনেকটাই সাবলম্বী। আম্মা আমাকে একটা কথা বলে ঘায়েল করে ফেলছেন। আমাদের দেশের মেয়েরা কোনখানেই নিরাপদ নন। তিনি ১৯৬৮ সালে ঢাকা থেকে চিটাগাং উইমেন্স কলেজে একাই গিয়ে শিক্ষকতায় যোগদান করেন। সেই নিরাপদ পরিবেশ এখন নেই। আম্মা এটাই বোঝাতে চাইলেন বর্তমান সময়ে একটা মেয়ে কেন একজন সাধারণ মানুষের জন্য কোথাও নিরাপদ পরিবেশ নেই। আমি বড় গলায় বলে আসলাম আমাদের দেশের মেয়েরা এখন অনেক নিরাপদে পথ চলতে পারছে। হয়তো আমার ভেতরের সত্য আম্মার কাছে প্রকাশ করতে চাই নি। আর সেই সত্যটা হলো কোনরকমে সন্ধ্যার আগে আমার বাসায় ফিরে আসা।
আম্মার সাথে তর্ক করে বাসায় ফিরেই খবর পেলাম, আমার এক প্রাক্তন ছাত্রী যে মৌলভীবাজার শহরের অদূরে কালেঙ্গা এলাকায় বসবাস করে, সে তার এলাকার এক মুদি দোকানে হামলার স্বীকার হয়েছে। তাও সেটা দশদিন আগের ঘটনা। মেয়েটি মাথায় আটারোটি সেলাই নিয়ে এতোদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলো। হাসপাতাল থেকে ফিরে ফেসবুকে একটি ছোট পোস্ট দেওয়ায় ঘটনাটি জানতে পারলাম। সাথে সাথে ওকে ফোন করলাম। সে জানালো মাথার সেলাই কেটে দিয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে মনে হচ্ছে পুঁজ বেরুচ্ছে। মেয়েটির কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, তারপরও কি ভাবে কেনো এমন হলো সেটা তার কাছ থেকে জানতে লাগলাম। আমি তার শিক্ষক বলেই কথা বলতে কষ্ট হলেও পুরো বিষয় বর্ণনা করে বুঝালো।
আমার এই ছাত্রীটির নাম ফাহিমা আক্তার তাহমিনা। সে বাংলাদেশের অন্যতম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্বপ্ন রক্তদান সমাজ কল্যাণ ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ও বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মৌলভীবাজার ইউনিটের যুব সদস্য।
তাহমিনা জানালো ‘সে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতারের করোনার টিকা বুথে রেড ক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করছে। ঘটনারদিন (৫ অক্টোবর ২০২১) সে সেখানে তার দায়িত্ব পালন শেষ করে বাড়ি ফিরে। তাদের বাড়ি কমলগঞ্জ উপজেলার ১নং রহিমপুর ইউনিয়নের কালেঙ্গা এলাকার করলি টিলা গ্রামে। টিকা বুথে সারাদিন পরিশ্রম করায় সে পরিশ্রান্ত থাকায় বাড়ি ফিরেই ঘুমিয়ে যায়। সন্ধ্যর পর ঘুম ভাঙলে সে তার ছোট বোন বাবলী আক্তার পান্নাকে পাশের দোকান থেকে একটি ডিম কিনে আনতে পাঠায়। সেখানে মুদি দোকানি পান্নাকে টিটকারী করে। পান্না দোকানিকে এমন না করতে বারণ করলে সে আরো বেশি বেশি করতে থাকে। বিষয়টি পান্নার কাছে বিরক্তকির লাগলে সে দোকান মালিক মামুন মিয়াকে সাবধান করে। তারপরও দোকানি মামুন নামের লোকটি উল্টাপাল্টা কথা বলেই যেতে থাকে। তখন কথাকাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে দোকানি মামুন দোকানে থাকা একটি বোতল দিয়ে পান্নার মাথায় আঘাত করে ও পান্নাকে মাটিতে ফেলে গলা চেপে ধরে। পরে কোনোমতে পান্না সেখান থেকে পালিয়ে বাড়িতে এসে বড় বোন তাহমিনাকে পুরো বিষয় জানায়। তাহমিনা ছোট বোন পান্নাকে সাথে নিয়ে ওই দোকানে গিয়ে এ ঘটনার কারণ জানতে চাইলে দোকানি মামুন তাহমিনার উপরেও চড়াও হয়। দোকানি তাহমিনাকে এলোপাথাড়ি কিল-ঘুষি মারতে থাকে। একপর্যায়ে মামুন এক টুকরো বড় কাঠ দিয়ে তাহমিনার মাথায় আঘাত করে। তার মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। এ সময় তারা দু’বোনের চিৎকার ও কান্না শুনে স্থানীয়রা এগিয়ে এসে উদ্ধার করে। পরে তাদেরে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে যান। পান্নাকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হলেও তাহমিনার মাতায় আটারোটি সেলাই লাগে। তাকে হাসপাতারে ভর্তি করা হয়। সে হাসপাতালে ছয়দিন থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে এখন বাড়িতে ফিরেছে। কিন্তু মাথার সেলাইয়ের স্থান থেকে পুঁজের মতো এখনো বেরুচ্ছে।’
বলা যায় ছোট্ট এই মেয়েটি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ফিরে এসেছে। আমার সাথে কথা বলার সময় সে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলো। আমি কি বলে তাকে সান্ত্বনা দেই সেই ভাষা খোঁজে পাইনি। আমিও অসহাযে মতো কিছুসময় কাঁদলাম। তার সাথে মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে অনেকক্ষণ ঝিম ধরে বসে ছিলাম। মাথা কোনো কাজ করছিলো না।
এই তাহমিনা। যে রেডক্রিসেন্টের সদস্য। নিয়মিত রক্ত দান করে। আমার জানামতে সে এ পর্যন্ত বিশবার রক্ত দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। সে এমন একটি মেয়ে যে কিনা নিজে রক্ত দিতে না পারলেও রক্ত দানের যোগানদাতা হিসাবে কাজ করে যায়। মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে কুণ্ঠা বোধ করে না তাহমিনা।
ভাবছি তাহমিনার নিরাপত্তা কি আমাদের সমাজ দিতে পেরেছে? না দিতে পেরেছে রাষ্ট্র? তাহমিনা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলেছে ‘ম্যাডাম, ওই দোকানদার আমরা দু’বোনেকে কেবল মারেইনি। সে আমাদের স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোতেও হাত দিয়ে আমাদের শীলতাহানী করেছে।’ আমার সন্তান বয়সী এই মেয়েদের আমি কি বলে সান্তনা দেই?
তাহমিনার সাথে কথা বলার পর থেকে আমার কিছুই ভালো লাগছিলো না। মোবাইল টিপতে টিপতে ফেসবুকে তাহমিনার টাইমলাইনে গেলাম। সেখানে গিয়ে আমি কিছু আশার আলো পেলাম। আমরা অথর্বরা মুখ বুজে অনেক কিছু হজম করলেও তাহমিনার বন্ধুরা সেটা হজম করে না। তারা প্রতিবাদে পথে নামে।
তাহমিনা ও তার ছোট বোনের উপর হামলা ও শীলতাহানির প্রতিবাদে মৌলভীবাজার ও সিলেটে ইতোমধ্যে মানববন্ধন হয়েছে।
আমি ঘর করি এক সাংবাদিকের সাথে। আমাদের বাসায় তিনখানা পত্রিকা রাখা হয়। এইসব পত্রিকায় তাহমিনার কোনো সংবাদ তো চোখে পড়লো না। এই যে ছেলেমেয়েরা মানববন্ধন করলো সেই খবরও না। এই বিষয়ে সাংবাদিক সাহেবকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন আজকাল ‘আহত হয়েছে’ এমন নিউজ সংবাদপত্র ছাপে না। তাই আমরা সাংবাদিকরাও লিখি না। আমি বলি ‘সাব্বাস সাংবাদিকতা’! তবে তাহমিনা কিংবা তার বোন মরে গেলে সংবাদ হতো!! আমিও একসময় সাংবাদিকতা করেছি। ধিক জানাই, এখনকার পত্রিকাওয়ালা ও সাংবাদিকতাকে।
সাংবাদিকতার প্রতি এই ধিক্কারের পরে আমার সাংবাদিক সাহেব জানালেন, স্থানীয় অনলাইন পোর্টালে এই বিষয়ে নিউজ হয়েছে। তিনি সেট দেখালেনও। জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিরা যেখানে ‘বেরেন্ডাবাজান’ সেখানে স্থানীয় অনলাইন নিউজ ছেপে সাংবাদিকতার ইজ্জত রক্ষা করে! অনলাইনের সাংবাদিকদের ধন্যবাদ।
তাহমিনার বিষয়টি নিয়ে কমলগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়েছে। এই লেখাটি যখন তৈরি করছি তখন আরেকবার তাহমিনার সাথে কথা বললাম। সে জানালো, মামলার আসামি আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়ে এসে তাদের বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করছে। মামলা উঠিয়ে না আনলে উচিত শিক্ষা দেবে এমন কথা বলে বেড়াচ্ছে। তাহমিনা আমাকে বললো, ‘ম্যাডাম আমি এখন কি করবো’? আবার আমি ভাবি আসলেই তাহমিনা কি করবে?? আমরা তাহমিনারা তো যুগে যুগে নির্যাতিত নিপীড়িত হয়ে গেলাম। এখনও তাহমিনা নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করে চুপ হযে যাবে। এছাড়া তো আর কিছু করার নেই। সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের করার থাকলে তো নির্যাতনকারী জামিন পাবার কথা নয়। কিন্তু সেটাই হয়েছে।
আমার ভাবনাতে কেবল আসছিলো, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা যে চেতনায় দেশ স্বাধীন করেছিলেন, তার কোনো কিছুই বর্তমান বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং অতীতে ক্ষমতাধরেরা যে ভাবে দেশ চালিয়ে ছিলেন, আমি তো উপলব্ধি করি বর্তমানের ক্ষমতাধরেরা ঠিক সে ভাবেই চালাচ্ছেন। কোনো ক্ষেত্রে আরো অবনতির দিকে গিয়েছি। কারণ স্বরূপ আমি বলবো নারীরা এখন বেশি অনিরাপদ। তারা নিপীড়ন ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি। একের পর এক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটলেও অপরাধীরা বিচারের আওতায় আসে খুব কম। সাংবাদিক দম্পতি সাগর রুনির হত্যাকারীর আজও খোঁজ মিলেনি! সেলুকাস!!
লতিফা নিলুফার পাপড়ি : শিক্ষক, কবি, গল্পকার ও কলামলেখক।