যৌক্তিক দাবির কর্মসূচিতে বাধা কেন?

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2024-02-28 18:59:46

গণতন্ত্র মঞ্চ নামের নামসর্বস্ব একটা রাজনৈতিক জোটের কর্মসূচিতে বাধা দিয়েছে পুলিশ। কেবল বাধাই নয়, দলটির নেতাকর্মীদের ওপর নির্বিচার লাঠিচার্জ করা হয়েছে। আটক করেছে কয়েকজনকে। হামলায় আহত হয়েছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ আব্দুর রহিম সাকি।

বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাকর্মীরা সচিবালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল করতে গেলে তারা পুলিশ কর্তৃক আক্রান্ত হয়। আক্রান্তের আগে মিছিলে বাধা দিতে পুলিশ ব্যারিকেড দিতে গেলে জোটটির নেতাকর্মীরা সেই ব্যারিকেড ভেঙে এগুতে চাইলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে।

পুলিশের দাবি, গণতন্ত্র মঞ্চ ব্যারিকেড ভেঙে সচিবালয়ে ঢুকতে চেয়েছিল। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা জোনের এডিসি শাহ্ আলম মোহাম্মদ আক্তারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, ওনারা (গণতন্ত্র মঞ্চ) অনুমতি ছাড়াই এখানে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এসেছেন। আমরা তাদেরকে বারবার বলেছি যে তাদের এখানে অনুমতি নেই। কিন্তু ওনারা আমাদের কথা শুনেননি। ওনারা আমাদেরকে কথা দিয়েছিলেন যে সচিবালয়ের সামনে এসে শান্তিপূর্ণ মিছিল করে চলে যাবেন। কিন্তু আমাদের দেওয়া ব্যারিকেড অতিক্রম করে সচিবালয়ে ঢোকার চেষ্টা করেছেন। আমরা বারবার বোঝানোর চেষ্টা করলেও ওনারা ব্যারিকেড ভেঙে ভিতরে ঢুকতে চেয়েছেন। তিনি আরও বলেন, যারা ব্যারিকেডে ধাক্কাধাক্কি করছিল তাদের দেখেই মনে হচ্ছিল এরা ব্যারিকেড ভাঙার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আমাদের মনে হয়েছে ওনারা এই ব্যারিকেড ভাঙার জন্য লোক ভাড়া করে নিয়ে এসেছে।

পুলিশের এই বক্তব্যে হাস্যরসের যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। 'ব্যারিকেড ভাঙার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত' বলে যে শব্দবন্ধ উল্লেখ করেছেন এ পুলিশ কর্মকর্তা, এটা প্রথমবার শোনা আমাদের। দেশের কোন দলের কেউ এমন প্রশিক্ষণ কাউকে দিয়েছে বলে জানা নাই। ব্যারিকেড দিতে পুলিশ প্রশিক্ষণ নেয় জানা, কিন্তু শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো বাহিনীর কেউ ব্যারিকেড ভাঙতে প্রশিক্ষণ নেয় এমনটা নিশ্চয় পাঠকেরও প্রথম শোনা।

গণতন্ত্র মঞ্চের আজকের এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ব্যাংক লোপাট ও অর্থ পাচারের প্রতিবাদ। তাদের সঙ্গে কারো রাজনৈতিক কিংবা আদর্শিক মতভিন্নতা থাকলেও এই দাবিগুলো আদতে গণদাবি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ নাজুক অবস্থায়, ব্যাংকের অর্থ লোপাট আর অর্থ পাচারের বিষয়টিও অসত্য নয়, এমনকি এসব সরকার দলের নানা পর্যায়ের নেতাকর্মী কর্তৃক স্বীকৃতও। দেশের যে কেউ এই দাবিগুলোর সঙ্গে ঐক্যমত প্রকাশ করবে। এখানে রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিক থেকে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে অনেকের মতের অমিল থাকলেও সবাই দ্রব্যমূল্যকে সহনীয় পর্যায়ে দেখতে চান, অর্থ লোপাট ও অর্থ পাচার বন্ধ দেখতে চান।

এটা অস্বীকার করার উপায় নাই, গত দেড় দশকে বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকার সবচেয়ে বেশি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে সবচেয়ে গুরুত্বহীন পর্যায়ে রেখে সিন্ডিকেটকে সুযোগ দিয়েছে। পেশায় ব্যবসায়ীদের খাদ্যমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, এমনকি গত মেয়াদে অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে সরকার এই খাতকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে। যার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে দেশকে। গত মেয়াদের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি কেবল তার দায়িত্ব পালনের পর্যায়েই নয়, বিভিন্ন বক্তব্যে-মন্তব্যে সিন্ডিকেটকে আশকারা দিয়ে গেছেন। 'সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব নয়' বলে অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্য শুনেছি আমরা তার মুখ থেকে। মন্ত্রীর অদক্ষতায় সরকার হয়েছে বিতর্কিত, জনস্বার্থ হয়েছে উপেক্ষিত, সরকার হারিয়েছে জনসমর্থন।

আশার কথা সেই বাণিজ্যমন্ত্রী এখন দায়িত্বে নেই, দায়িত্বে নেই সাবেক অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালও। বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আহসানুল ইসলাম টিটু‌। কাজে-বয়সে নবীন হলেও বর্তমান বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর মুখ থেকে বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা শোনা যাচ্ছে। সিন্ডিকেটকে আশকারা না দেওয়ার প্রত্যয় শোনা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের অন্য মন্ত্রীদের মুখ থেকেও দ্রব্যমূল্যের গুরুত্বের কথা শোনা যাচ্ছে।

বাজার ব্যবস্থাপনা ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যখন সরকারের কাছেও গুরুত্ব পাচ্ছে তখন গণতন্ত্র মঞ্চের এই কর্মসূচিতে শক্তি প্রদর্শনের কোন যুক্তি থাকতে পারে না। সরকার-সংশ্লিষ্ট, সরকার-ঘনিষ্ঠদের কেউ কেউ সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও থাকতে পারেন, কিন্তু এই মেয়াদের সরকারের প্রধান যে চ্যালেঞ্জ দ্রব্যমূল্য সেখানে জনস্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন দাবির আন্দোলন কিংবা কোন কর্মসূচিতে বাধা প্রদান শোভন হয় না। গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম সংগঠক জোনায়েদ সাকির ওপর হামলা তাই যেকোনো বিচারে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অপ্রত্যাশিত।

দেশে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি হলেও বিএনপির কোনো নেতাকেই সরকারের বিরুদ্ধে ততটা সরব থাকতে দেখা যায় না, যতটা দেখা যায় জোনায়েদ সাকিকে। তার বড় রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম নাও থাকতে পারে, কিন্তু তিনি মাঠ ও মাঠের বাইরে সরকারের সবচেয়ে বড় সমালোচক। এই সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি অনেক সময় অযৌক্তিক এবং একপেশে অনেক কিছুই বলেন, বলেন দেশে কথা বলার স্বাধীনতা নাই; কিন্তু তার রাজনৈতিক উপস্থিতি ও কথা বলার জায়গাগুলোও আবার কথা বলার স্বাধীনতা বিষয়ে সরকারকে কিছুটা হলেও মুখ দেখানোর পথ দেখায়।

জোনায়েদ সাকি কথা বললে সরকারের ক্ষতি হয় না, বরং লাভই হয়। তিনি রাজপথে কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হলে সরকার বিএনপিকে পাশ কাটিয়ে নানা জায়গায় দেখাতে পারে—দেখো রাজনীতি ও কথা বলার স্বাধীনতা কীভাবে আছে দেশে! জোনায়েদ সাকি যখন সরকারের জন্যে ক্ষতির নয়, লাভেরই প্রপঞ্চ, তখন তার ওপর পুলিশের চড়াও হওয়া সঠিক হয়নি। এছাড়া তাদের যে কর্মসূচি, যে দাবি সেগুলো সরকারকে উৎখাতের নয়, গণদাবিকেই প্রতিনিধিত্ব করছে।

দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ খুব খারাপ অবস্থায় আছে—এই সত্যকে অস্বীকার করলেও এটা মিথ্যা হয়ে যাবে না। বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের ব্যর্থতাকে অস্বীকার করা যাবে না। দ্রব্যমূল্য এবং বাজারের সঙ্গে যেখানে জনস্বার্থ জড়িত সেখানে লাঠিপেটা করে, আটক করে নিয়ে যাওয়ার যে আদি-কৌশল সেটা পরিহার করা উচিত পুলিশের।

এ সম্পর্কিত আরও খবর