আচমকা নেমে আসা বন্যায় গত মাসের শেষ সপ্তাহটা বেশ দুর্বিষহই গেছে বাংলাদেশের। ভারী বৃষ্টিপাত এবং ভারত থেকে উজানের পানি প্রবাহের ফলে সৃষ্ট বন্যায় পূর্বাঞ্চলের ১১ টি জেলার প্রায় ৫৭ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এছাড়াও অঞ্চলটিতে গবাদি পশু এবং কৃষিতেও হয়েছে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, যা দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বন্যায় একটি বিশেষ অংশ যেমন কৃষক, জেলে এবং নিম্ন-আয়ের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বিশেষ করে পোল্ট্রি এবং মাছের খামার একেবারেই ভেসে যায় বন্যার পানিতে। দীর্ঘমেয়াদি এই প্রভাবকে মোকাবিলা করার জন্য কিছু পদক্ষেপ যথাযথভাবে নেওয়া প্রয়োজন।
প্রথমেই নজর দেওয়া যাক কৃষিতে। বন্যার পানিতে জমা সমৃদ্ধ ও উর্বর পলিমাটি সার হিসেবে কাজ করে কৃষি এলাকায়। বন্যার পানি অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং জৈব উপাদানগুলোকে আশপাশের জমিতে পরিবহণ করে থাকে, যা কৃত্রিম সার ব্যবহার হ্রাস করে থাকে। এছাড়াও বন্যা এবং নিষ্কাশন ব্যবস্থা উদ্ভিদের শেকড়গুলোতে চমৎকার পুষ্টি সরবরাহ করে থাকে এবং ক্রমবর্ধমানভাবে উদ্ভিদের সমস্ত অংশে সুষম সরবরাহ ঘটে। সুতরাং বলাই যায়, গাছপালার স্বাস্থ্য এবং নতুন উদ্ভিদের অঙ্কুরোদগমের জন্য এটি ট্রিগার হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশে ১৯৭৮ থেকে ২০০০ সাল নাগাদ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় বন্যা-পরবর্তী মাসগুলোতে জমিতে অধিক উৎপাদনশীলতা রয়েছে। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে যদি মাটি বা জমি হতে ফসল উৎপাদনে বাধা ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করে মাইক্রোবাইরাল এক্টিভিটিকে উদ্দীপিত করা হয়, মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে সয়েল ক্রাস্টিংকে সীমিত করা যায়, মাটিকে উৎপাদনশীলতায় পরিণত করা যায় এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের নির্দেশনা অনুযায়ী ধান রোপণের কাজগুলো যথাযথভাবে করা যায়। তবে সংকট মোকাবিলায় কিছুটা স্বস্তিদায়ক হবে বলে আশা করা যায়। এছাড়াও কিছু অঞ্চলভিত্তিক শস্য রয়েছে যেমন সয়াবিন এবং বাদাম এদের বন্যা পরবর্তী উৎপাদন অনুমান করে কাজ করতে হবে। বাড়ির উঠানে বিভিন্ন ফল, সবজির চারা রোপণে উৎসাহিত করা যেতে পারে, মাঠ পর্যায়ে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে যারা সপ্তাহে অন্তত একদিন এই কাজে অংশগ্রহণ করবেন।
বন্যা হলো জলবিদ্যাগত প্রক্রিয়া, যা মিঠা পানি সরবরাহ করে, ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জে একটি উপায়, যা কৃষির জন্য অপরিহার্য। ভূগর্ভস্থ পানি সবচেয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বিশ্ব কৃষি অর্থনীতিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে। অনাবৃষ্টি, জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধি ,নগরায়ণ ভূগর্ভস্থ পানির লেভেল কমিয়ে দিয়েছে। যদিও বন্যা জীবন, সম্পদ বিনাশ করে, কিন্তু জলজ আধার বা ভূগর্ভ পানি পূরণ করার ক্ষেত্রে এটি ভূমিকা পালন করে। এই পানি যদি ধরে রাখার মত ব্যবস্থা করা যায় তবে খরা, অনাবৃষ্টি এমনকি সারা বছর কাজে লাগানো যেতে পারে এবং কৃষিকাজকে ত্বরান্বিত করা যেতে পারে। এছাড়া বন্যা কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির জন্ম ও স্থানান্তর উভয়ের জন্য পরিবেশগত ট্রিগার হিসেবে কাজ করে। APFM -এর মতে কিছু প্রজাতি বন্যার সমভূমিতে নিজেই জন্মায় যেখানে অন্যান্য নদীনালায় স্পন করার জন্য উজানে স্থানান্তরিত হয়, যা প্রচুর পরিমাণে মাছ এবং বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করে।
১৯৭৯ থেকে ২০০০ সাল নাগাদ তথ্য বিশ্লেষণ এ দেখা যায়, কৃষি মজুরিতে বন্যার ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে, যদিও বন্যার মাসে শ্রমের চাহিদা কম থাকে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে শ্রম বাজারে চাহিদা এবং সরবরাহ অবস্থা উন্নতি হয় (বর্ধিত উৎপাদনশীলতা এবং বাণিজ্যের অনুকূল শর্তাবলির কারণে) এবং কৃষি শ্রম বাজারে দুর্যোগের নেতিবাচক প্রভাব প্রশমিত করে। ভারতের ১৫টি প্রধান রাজ্যে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, বন্যা পরবর্তী স্বল্পমেয়াদে বাৎসরিক কৃষি মজুরি কিছুটা হ্রাস পেলেও দীর্ঘমেয়াদের ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আর্থিক সাহায্য দিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষজনকে পোল্ট্রি ফার্মের জন্য উৎসাহিত করা যেতে পারে। আধুনিক কৃষির জন্য একটি অতি জরুরি উপাদান হলো পোল্ট্রি ডিম, মাংস উৎপাদন। এটি খাদ্য নিরাপত্তার একটি হাতিয়ার ও বলা যায়, কারণ এর দ্বারা প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হয়। এছাড়া এতে রয়েছে মিনারেল, কার্বোহাইড্রেট এবং ভিটামিন। এটির প্রসার ঘটালে নিম্ন ও মধ্যম শ্রেণির উন্নয়ন ঘটবে, বেকারত্ব দূরীকরণ হবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা বাড়বে। তবে বন্যা পরবর্তী পোল্ট্রি খামারগুলোতে থাকা প্রাণিগুলোর স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি, অন্যথায় হিতে বিপরীত হতে পারে। এছাড়াও স্বাস্থ্যসম্মত ডিম, যন্ত্রপাতি এবং নিরাপদ পানি সরবরাহ এই ক্ষেত্রকে করে তুলবে টেকসই।
এই বন্যা ছিল একেবারেই অস্বাভাবিক এবং কোনো প্রকার পূর্বাভাস ছাড়াই। এর কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেশি। তারপর ও মানুষ তার জীবনযাপনের জন্য ঘুরে দাঁড়াতে পারে। বন্যায় যে পরিমাণ দেশি-বিদেশি সাহায্য সহযোগিতার নজির দেখা গেছে তা হয়ত এই দেশে বিরল উদাহরণ। এই আর্থিক সাহায্যগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সরকার এক্ষেত্রে বন্যা পরবর্তী কাজগুলো সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও সরকার প্রতিনিধির মাধ্যমে মনিটরিং সেল গঠন করতে পারে। সেলের কাজ হবে কৃষিকে কার্যকরী ভূমিকায় নিয়ে আসার জন্য যাবতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করা এবং আর্থিক সহায়তাগুলোকে সঠিক পরিচালনার মাধ্যমে আগামী দিনগুলোতেও আর্থিক কোনো সহায়তা প্রয়োজন হলে তা খুঁজে বের করা। পরিশেষে বলা যায়- সর্বপ্রথম রাস্তাঘাট মেরামত ও পুনর্বাসন করে এবং আর্থিক সাহায্যগুলো সঠিক পরিচালনার মাধ্যমে এই প্লাবন ঘটিত সমস্যা কাটিয়ে উঠা সম্ভব।
লেখক: ফারহানা ইয়াসমিন, শিক্ষক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়