অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা চলছে দীর্ঘদিন। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনের দোহাই দিয়ে তাকে বিদেশ পাঠানো হয়নি। তখন তিনি ছিলেন আদালতের রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত, এবং দণ্ডপ্রাপ্তের বিষয়ে আইনি সীমাবদ্ধতা বারবার তুলে ধরতে চেয়েছেন সাবেক সরকারের দায়িত্বশীলতা। তখনকার আলোচনা যতটা ছিল আইনি, তারচেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক। আওয়ামী লীগ আইনের দোহাই দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে—এটাও ছিল যেমন রাজনীতি, তেমনি আইন সামনে এনে তাকে বিদেশ যেতে না দেওয়াও ছিল আওয়ামী লীগের রাজনীতি।
এখন বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে তার সাজা মওকুফ করেছেন। এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক আমলে দায়ের দুই মামলার রায় হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজা পেয়ে কারাগারে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ওই বছরের অক্টোবরে হাইকোর্টে আপিল শুনানি শেষে সাজা বেড়ে হয় ১০ বছর। এরপর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় বিএনপি চেয়ারপারসনের। আদালতের রায়ে সাজা হলেও সবশেষ কয়েক বছর ধরে অবশ্য কারাগারে থাকতে হয়নি তাকে। পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের বাসায় সাজা ভোাগের সুযোগ দিয়েছিলেন। এবং এটাও আইনি প্রক্রিয়া ধরে হয়েছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরদিন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ করেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিভিন্ন দলের বৈঠকে সকল দল রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানালে তিনি এই সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।
আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপি রাজনৈতিক ভাবে ছিল কোণঠাসা এবং গণমামলা ও গণগ্রেফতারে জর্জর। সরকারবিরোধী কোন কর্মসূচিকে সহ্য করা হতো না। বিদেশে নিয়ে খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা বিষয়ক সকল আলোচনা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, এবং প্রতিবারই আইনের দোহাই দেওয়া হয়েছে। ওই সময় বিদেশে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার আবেদন এবং সরকারের প্রত্যাখ্যান দুটোই বিএনপির রাজনীতির জন্যে সহায়ক হয়েছে।
এখন মুক্ত খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা এবং বিদেশে চিকিৎসার জন্যে যাওয়ায় কোন বাধা নেই। চাইলেই তিনি যে কোন দেশে যেতে পারেন। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় বিএনপি যেভাবে তার বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে তৎপর ছিল, এখন সে তৎপরতায় অনেকটাই ভাটা পড়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক মাস পার হয়ে গেলেও খালেদা জিয়া বিদেশ যাচ্ছেনই এমন সুস্পষ্ট বার্তা এখনো আসেনি। এনিয়ে কিছু আলোচনা চলমান যদিও, তবু তিনি যে বিদেশ যাচ্ছেনই এমনটা মনে হচ্ছে না। তার চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, তিনি বিমানে চড়ার মতো ফিট এখনো নন। অথচ আগে যখন জোর আলোচনা চলছিল, তখন তার শারীরিক অবস্থা ছিল এখনকার চাইতেও খারাপ।
তিনি ফিট না থাকলেও তার বিদেশ যাওয়া নিয়ে আলোচনার খবর বার্তা২৪.কম, সমকালসহ একাধিক গণমাধ্যমে এসেছে। এরবাইরে আরও খবর হচ্ছে, ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ ক্যাথরিন কুক গুলশানের বাসায় গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ। খালেদা জিয়ার প্রয়াত ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি গত বৃহস্পতিবার লন্ডন থেকে ঢাকায় এসেছেন। এগুলো খালেদা জিয়ার যুক্তরাজ্যে যাওয়ার ইঙ্গিত বলে মনে করছেন অনেকেই। বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও মেডিকেল বোর্ডের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেছেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কয়েকটি হাসপাতালের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। ওইখানে হাসপাতাল নির্বাচনসহ আরও কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। ম্যাডামের কন্ডিশন এখনও বিমানে ট্রাভেল করার মতো নয়। ইউকেতে নেওয়া হলে আট থেকে ১৩ ঘণ্টা সময় লাগে অথবা ইউএসএ নিতে হলে ১৮ থেকে ২১ ঘণ্টা ফ্লাইং আওয়ার লাগবে। কাজেই এই যাত্রার জন্য শারীরিক সুস্থতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই কিছুটা সময় লাগবে। বেশ কিছু জটিল চিকিৎসা করাতে অনেকটা সময় ম্যাডামকে বিদেশে থাকতে হবে।’ মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. আল-মামুন বলেছেন, ‘বিমানে ভ্রমণের জন্য শারীরিকভাবে তিনি এখনও পর্যন্ত ফিট নন। আরও কিছুটা সময় লাগবে। যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে যেতে হলে স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘ সময় বিমানে থাকতে হবে। এসব নানা বিষয় নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। উনার জন্য দেশের বাইরে থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স আনা হবে।’ অর্থাৎ খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত না হলেও এর প্রক্রিয়া চলমান।
খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। প্রয়োজনে তিনি বিদেশ যেতে পারেন, এখানে এখন কারো আপত্তির কিছু নাই। তবে তিনি আগের মতো শারীরিক অবস্থার মধ্যে নন বলে ধারণা করা যায়। অন্তত আগে যেখানে তাকে সকাল-বিকাল বাসা-হাসপাতাল করতে হতো এখন তার দরকার পড়ছে না। এমন অবস্থায় তার দেশত্যাগে রয়েছে রাজনৈতিক ঝুঁকি।
শেখ হাসিনার সরকারের পতন এবং তার দেশত্যাগের পর অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দমননীতি চালিয়ে যাচ্ছে, গণমামলা ও গণগ্রেফতারকে যেভাবে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে, গণমাধ্যমে দলটিকে নিয়ে যেভাবে প্রচারণা চলছে তাতে সহসা রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের ফিরে আসা কঠিন। এমন অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি রাজনীতির এই শূন্যস্থান পূরণের কথা থাকলেও এখানে তৃতীয় পক্ষের ইঙ্গিত মিলছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সরকারের বিভিন্ন অংশের মধ্যে একাত্তরের ভূমিকার কারণে বিতর্কিত জামায়াতে ইসলামীকে হাজির করা হচ্ছে তাতে তারা কিংস পার্টিরই মর্যাদা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এর পাশাপাশি আছে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল-উপদলের সরব উপস্থিতি। আওয়ামী লীগ-বিএনপি এক দল বাদে আরেক দল দেশ চালিয়েছে, এখন নতুন কেউ দরকার এমন একটা আওয়াজ তোলার চেষ্টাও চলছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি খুশি। আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেওয়ার নানামুখী চেষ্টায় বিএনপি সরাসরি না থাকলেও প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছেন। আওয়ামী লীগ বিহীন রাজনীতির মাঠে বিএনপিই স্বাভাবিকভাবেই একমেবাদ্বিতীয়ম, কিন্তু এর বাইরেও যে অন্য কথা থাকতে পারে, এটা সাম্প্রতিক রাজনীতির গতিচিত্র মনে করিয়ে দিচ্ছে। গণমাধ্যমে এখন বিএনপির চাইতে জামায়াতের কভারেজ বেশি, বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের সাক্ষাতের চিত্রও সামনে আসছে, আন্দোলনের হতাহতদের আর্থিক সহায়তা নিয়ে বাড়িবাড়ি যাচ্ছেও জামায়াত। তাদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিএনপির চাইতে বেশি হচ্ছে।
বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির প্রধান ব্যক্তি। তারেক রহমান খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও তিনি একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন আদালতে দায়ের মামলাগুলো শুক্র-শনিবার নির্বিশেষে প্রত্যাহার হলেও সাজা মওকুফ হয়নি। সাজা মওকুফ করতে বা আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তি পেতে তাকে দেশে আসতে হবে, কিন্তু তার পাসপোর্ট নবায়ন হয়নি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাসেও তারেক রহমানের পাসপোর্ট নিয়ে নতুন কোন খবর নেই। ফলে তার দেশে ফেরা এখনো অনিশ্চিত।
নিম্ন আদালত থেকে একের পর এক মামলা প্রত্যাহার হলেও মূল মামলা ও সাজা মওকুফ হয়নি তারেক রহমানের। রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে তার দণ্ড মওকুফ করতে পারলেও এটা নির্ভর করছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। কিন্তু সরকার এখন যে পথে এগুচ্ছে তাতে বিষয়টি যত সহজে চিন্তা করা যাচ্ছে, বাস্তবায়ন তত সহজ বলে মনে হচ্ছে না। ফলে বেগম খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্যে বিদেশ গেলে এবং তারেক রহমান দেশ ফিরে আসতে না পারলে সুবিধাজনক রাজনৈতিক অবস্থায় বেশ অসুবিধায় পড়ে যেতে পারে বিএনপি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগে রাজনীতিতে ‘মাইনাস-ওয়ান’ হয়ে গেছে; খালেদা জিয়া যদি চিকিৎসার জন্যে বিদেশ যান, সেটা কি তবে ‘মাইনাস-টু’? এক-এগারোর সরকার অনেক চেষ্টা করে ‘মাইনাস-টু’ করতে পারেনি বিশেষ করে খালেদা জিয়া দেশ ত্যাগ না করায়, ওই সময়ও শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেছিলেন। আগের মতো রাজনীতিতে ‘মাইনাস-ওয়ান’ ইতোমধ্যে হয়ে গেছে; এবার খালেদা জিয়া বিদেশ গেলে হয়ে যেতে ‘মাইনাস-টু’ও! আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন দেশ শাসন করলেও বিকল্প নেতৃত্ব গড়তে পারেনি বা আগ্রহ দেখায়নি; বিএনপির মধ্যে তারেক রহমানের মাধ্যমে বিকল্প নেতৃত্ব থাকলেও আইনি বাধায় তিনি দলে থেকেও দেশের বাইরে। ফলে খালেদা জিয়ার বিদেশ গমনের রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে নির্ভার থাকা বুদ্ধির কাজ হবে না।
এখানে তবে মুখোমুখি হয়ে পড়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও রাজনৈতিক ঝুঁকি। স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিরসনে বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানোর পাশাপাশি রাজনৈতিক ঝুঁকি যাতে ভয়াল রূপ পরিগ্রহ না করে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা উচিত বিএনপির।