বিপ্লবী সরকার, নাকি সংবিধানের নিরাপত্তার সরকার

  • কবির য়াহমদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কোটা সংস্কার আন্দোলনে, ফাইল ছবি: নূর এ আলম

কোটা সংস্কার আন্দোলনে, ফাইল ছবি: নূর এ আলম

কোটা সংস্কারের দাবি দিয়ে শুরু, এরপর আওয়ামী লীগের সরকার পতন দিয়ে জুলাই-আগস্টের ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছে। ৫ আগস্টে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর এবং তার দেশ ত্যাগের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দেড় দশকের শাসনামলের অবসান হয়। এরপর তিনদিন সরকারবিহীন দেশ থাকার পর ৮ আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের রাজত্বকাল। মুহাম্মদ ইউনূস বিশাল কলেবরের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিশাল কলেবর বলছি কারণ এর আগে অনির্বাচিত সরকারের পরিসর এত বিস্তৃত ছিল না। নব্বই দশক থেকে দেশে যত অনির্বাচিত সরকারই ক্ষমতায় এসেছে তাদের সদস্য সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ এগারো। এবারই প্রথম দেশ দেখেছে একুশ সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকার।

নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ হচ্ছে ‘সংস্কার’। এই শব্দের শক্তিতে দেশের প্রশাসন ও বিচার বিভাগের খোলনলচেই পালটে গেছে। আওয়ামী লীগের আমলের বেশিরভাগই এখন আগের জায়গায় নেই। কারো স্থান হয়েছে কারাগারে, কেউ হয়েছেন বদলি, কেউবা চাকরিচ্যুত, এবং অনেকেই গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে। রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ ও দলটির মিত্র ১৪-দলীয় জোটের নেতারা নেই, দেশে-বিদেশে পলাতক। আওয়ামী লীগের শাসনামল ছিল ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর, এই প্রচারণা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আওয়ামী লীগের সেই ফ্যাসিজম দূর করতে সব জায়গায় চলছে নানা ধরনের শুদ্ধি অভিযান। এই অভিযানগুলোর কিছুটা প্রশাসনিক নিয়ম মেনে, আর বেশিরভাগই হচ্ছে জোরপূর্বক।

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আন্দোলন হয়েছিল যে সংগঠনের ডাকে, তারা অপরিচিত। ভাবা হচ্ছিল তারা অরাজনৈতিক সংগঠন, স্রেফ শিক্ষার্থীদের। সরকারের পতনের পর দেখা যাচ্ছে অন্য সকল রাজনৈতিক দল এখানে হাজির ক্রেডিট ছিনতাইয়ে। আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত এবং কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর কে কত লোকের সমাবেশ ঘটিয়েছিল, কে কীভাবে শক্তির যোগান দিয়েছিল, সে আলোচনা কিংবা বাহাসেরও দেখা মিলেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীদের যে অংশ প্রথমে ছিল আলোচনার কেন্দ্রে তাদের প্রভাব ক্রমশ কমছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে তাদের দুজন প্রতিনিধি, প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ সহকারী হিসেবে আরও একজন সমন্বয়কের অন্তর্ভুক্তিতে শুরুতে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষমতায়নের দেখা মিলেছিল, তা আস্তে আস্তে কমে আসছে বলে মনে হচ্ছে।

এই সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার মাস দিনও হয়নি, তবে এরই মধ্যে সংবিধান সংশোধন-বাতিল-পুনর্লিখনের জোর প্রচারণা শুরু হয়েছে। বাহাত্তরের সংবিধানে জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি, এমনও কথা বলা শুরু হয়েছে। সংবিধান রচনায় মানুষের ম্যান্ডেট নেওয়া হয়নি, এমন অদ্ভুত দাবিও শুনছি। বাহাত্তরের সংবিধান নাকি দলীয় সংবিধান, এই ধরনের কথা যারা বলছে, তারা প্রকারান্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে গৌণ করে পাঁচ সপ্তাহের সরকার পরিবর্তনের একটা আন্দোলনকে মুখ্য হিসেবে হাজিরে মরিয়া। এ লক্ষ্যে যারা তাদের বেশিরভাগই অনতিতরুণ, তবে আশঙ্কার কথা হচ্ছে তাদের সমর্থনে রয়েছেন চেনাজানা অনেকেই।

বিজ্ঞাপন

সংবিধান পুনর্লিখন নিয়ে অদ্য যারা জায়গায়-জায়গায় বক্তৃতা দিচ্ছেন তাদের মধ্যে রাজনীতিবিদদের সংখ্যা অল্পই। পুনর্লিখনে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ। আলী রীয়াজকে জানতাম আমরা বিদেশে বসে বাংলাদেশের একটি জাতীয় পত্রিকার নিয়মিত কলাম লেখক হিসেবে। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি দেশে নানা অনুষ্ঠানে একই মত ব্যক্ত করে যাচ্ছেন, এবং তার সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন আরও অনেকে। সম্প্রতি রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে তিনি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিক করতে কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি বা গণপরিষদ করে হলেও সংবিধান পুনর্লিখন জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন। এখানেই তিনি থেমে থাকেননি, এরপর একই কথা একাধিক জায়গায় বলে এর স্বপক্ষে আরও লোক জড়োর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অথচ সকলেরই জানা, প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্যের পর সাংবিধানিক সংকটের সময়ে অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত, এবং এই সরকার যতই সংস্কার-সংস্কার জপ করুক না কেন, তাদের মেয়াদ এবং ক্ষমতা নির্বাচিত সরকারের মতো নয়। এই সরকার এমনই এক সরকার যে সরকারকে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদকেই বৈধতা দিতে হবে। যে সরকারের বৈধতা পরের নির্বাচিত সরকারের হাতে, তারা কীভাবে তবে সংবিধান সংশোধন-বাতিল-পুনর্লিখন করতে পারে? স্বাভাবিকভাবে এমন হওয়ার কথা না।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দেশের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত বদলের দাবিও করছেন কেউ কেউ। এই দলে নাম লিখিয়েছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী। তার আরেক পরিচয় আছে। তিনি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাভোগ করে মারা যাওয়া গোলাম আযমের পুত্র। তিনি গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের অডিটোরিয়ামে এক সংবাদ সম্মেলনে ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান, পাশাপাশি নতুন জাতীয় সংগীত রচনারও আহ্বান জানিয়েছেন। বাহাত্তরের সংবিধানকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়ে তার দাবি, ‘আওয়ামী লীগ জনগণের কাছ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কোনো ম্যান্ডেট নেয়নি। সুতরাং এই সংবিধান বৈধ নয়। নতুন করে একটা কমিটি করে নতুন সংবিধান তৈরি করা হোক, এটা বাতিল করা হোক।’ এটাই শেষ নয়, তিনি একাত্তরে ত্রিশ লক্ষ শহিদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যায় পুনর্বার বলেছেন, ‘শেখ মুজিব ৩ লাখ বলতে গিয়ে ৩ মিলিয়ন বলেছেন এবং এটাই ৩০ লাখ হয়ে গেছে। কোনো জরিপ ছাড়া ৩০ লাখ শহিদ বলে বলে তারা (আওয়ামী লীগ) মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।’ তিনি অন্তর্বর্তী সরকারকে নতুন জরিপ করে মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা নির্ধারণেরও পরামর্শ দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক, জাতীয় সংগীত নিয়ে বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা কারা বলে এটা দেশবাসী জানে। তার পারিবারিক পরিচিতিও নিশ্চয় বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার মতো নয়।

আওয়ামী লীগের পতন ও শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগ নিয়ে অনাগত দিনে নানা আলোচনা চলতেই থাকবে। বিভাজনের রাজনীতি টিকে থাকার দেশে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া মুশকিল। এই আন্দোলন এবং সরকারের পতনকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলছেন যারা, তারা আদতে প্রবল আবেগী। আবেগে তাল দিয়ে যারা দ্বিতীয় স্বাধীনতা উপভোগ করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘বিপ্লবী সরকার’ আখ্যা দিয়ে বিপ্লবোত্তর দেশে সংবিধানের উপযোগিতা এবং অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। এটা তাদের ভুল। যে অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমানে ক্রিয়াশীল, তার নাম ‘বিপ্লবী সরকার’ নয়। এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূস যে শপথ নিয়েছেন সেখানে বিপ্লবী সরকারের ধারণা ছিল অনুপস্থিত। তিনি শপথ নিয়েছেন, ‘সংবিধানের রক্ষণ ও সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান’ করার।

প্রাসঙ্গিকভাবে প্রধান উপদেষ্টার নেওয়া শপথবাক্য উল্লেখ করছি। শপথে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন—“আমি মুহাম্মদ ইউনূস, সশ্রদ্ধ চিত্তে শপথ গ্রহণ করিতেছি যে, আমি আইন অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব। আমি, বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব। আমি সংবিধানের রক্ষণ ও সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।” গোপনীয়তার শপথে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন—“আমি মুহাম্মদ ইউনূস, সশ্রদ্ধ চিত্তে শপথ গ্রহণ করিতেছি যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রূপে যে সকল বিষয় আমার বিবেচনার জন্য আনিত হইবে, বা যে সকল বিষয় আমি অবগত হইব, তাহা প্রধান উপদেষ্টা রূপে যথাযথ ভাবে আমার কর্তব্য পালনের প্রয়োজন ব্যতীত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন ব্যক্তিকে জ্ঞাপন করিব না, বা কোন ব্যক্তির নিকট প্রকাশ করিব না।” তিনি শপথ নিয়েছেন সংবিধান রক্ষার, সংবিধানকে সমর্থন করার এবং সংবিধানের নিরাপত্তা বিধান করার। এখানে তাই সংবিধান সংশোধন-বাতিল-পুনর্লিখনের সুযোগ তার সরকারের থাকছে না। এমনটা করা হলে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে এতে সমর্থন দিলে, তিনি নিজেই সংবিধান অগ্রাহ্য ও অবমাননা করবেন, যা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এবং প্রচলিত আইনের সর্বোচ্চ দণ্ড থাকবে এমন অপরাধের জন্যেও।

জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকাসহ সংবিধানের মূল নীতিসহ সংবিধানে হাত দেওয়ার সুযোগ অন্তর্বর্তী সরকারের নাই। জুলাই-আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ বিপ্লব নয়, এটা একটা পর্যায়ে হয়ে পড়ে স্রেফ সরকার পতনের একটা আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা সফল হয়েছে। তাদের সাফল্যে তারা ক্ষমতাবানদের সরিয়ে নিজেরা ক্ষমতাবান হয়েছে। আদর্শিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচির পরিবর্তনে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে তারা চেষ্টা করতে পারে, করুক; কিন্তু কোনভাবেই জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত ও সংবিধানে হাত দেওয়ার ক্ষমতা তারা রাখে না। এই ক্ষমতা বা ম্যান্ডেট জনগণ তাদের দেয়নি।

অন্তর্বর্তী সরকার বিপ্লবী সরকার নয়, তারা সংবিধানের নিরাপত্তা বিধানের শপথে ক্ষমতা গ্রহণ করা সরকার।