ঘটনাটি উপনিবেশিক বাংলার প্রথম আমলের। কন্ডাকটর অতিরিক্ত যাত্রী তোলায় কলকাতার বিডন স্ট্রিট থেকে ট্রামে উঠে পুলিশ কোর্ট পর্যন্ত পুরো রাস্তা বাবু আহুরলাল সেনকে দাঁড়িয়ে যেতে হয়েছে। নামার সময় তাই তিনি ভাড়া দিতে অস্বীকার করলেন।
সেই নিয়ে বাগবিতণ্ডা। গ্রেফতার করে তাকে আদালতে চালান করা হল। মামলা উঠল প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে। চললো পক্ষে-বিপক্ষে সওয়ালজবাব, জেরা।
সব শুনে অবশেষে বিচারপতি রায় দিলেন, ভাড়া না দিয়ে যাত্রী কোনও অন্যায় করেননি! যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যের খেয়াল রাখা ট্রাম কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। মামলা ডিসমিস।
১৮৮০ সালের এই বিবরণ আজ পড়ে আশ্চর্য লাগলেও এ কথা সত্যি, কলকাতার গড়ে ওঠা ও প্রসারের সঙ্গে গত দেড়শো বছর ধরে জড়িয়ে আছে ট্রামের প্রসার ও গণপরিবহনের ইতিহাস।
আশ্চর্যজনক বিষয় হলো এই যে, শতাধিক বছর পেরিয়ে গেলেও পরিবহনকর্মীদের বেপরোয়া আচরণ ও নিষ্ঠুরতা থামছে না। বিষয়টি উদ্বেগজনক । কারণ, বর্তমান বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর সবচেয়ে বেশি ঘটনাগুলো হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার ফলে। যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে জড়িয়ে আছে গণপরিবহন ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
বেপরোয়া গাড়ি চালনায় সৃষ্ট দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর তালিকা বেশ দীর্ঘ। প্রতিদিনই শীর্ষ সংবাদের স্থান দখল করে এইসব দুর্ঘটনার মর্মান্তিক বিবরণ। এছাড়াও রয়েছে চলন্ত বাস থেকে লাথি মেরে বা ধাক্কা দিয়ে যাত্রীদের ফেলে হত্যা করার মতো পৈশাচিক ঘটনা।
ঘটনাগুলো পরিবহন খাতে বিদ্যমান অরাজকতারই প্রমাণ দেয়। গণপরিবহনে চলাচল করতে গিয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব ধরনের যাত্রীরাই নানাভাবে নিগৃহীত হন। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সংঘটিত ঘটনাগুলো আরো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় ঈদ ও বিভিন্ন ছুটির সময়ে। ভাড়া বৃদ্ধি ও অমানবিক আচরণে সেই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে জিম্মি হতে হয়।
কোনো কোনো পরিবহনকর্মীর আচরণ কতটা নিষ্ঠুর ও অমানবিক হতে পারে, যা বলার মতো নয়। অনেকগুলো দৃষ্টান্তের মধ্যে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পায়েলের হত্যাকারীরা শাস্তি পেয়েছে আদালতে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এরপরও খুব কমসংখ্যক পরিবহনকর্মীর আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন ও পেশাদারিত্বের লক্ষণ দেখা গেছে। তাদের বেপরোয়া আচরণ স্তিমিত হলেও মোটেও বদলে যায় নি।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ২৩৭ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। ২০২২ সালের দিকেও শতাধিক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার শিকারের বড় একটা অংশ পথচারী। রাতে ও ভোর রাতে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটেছে। শীতের মাসে কুয়াশা থাকায় এসব ঘটনা আরও বেশি ঘটলেও ঈদ বা বিভিন্ন উৎসবে তা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।
বেশির ভাগ দুর্ঘটনা হয় গাড়িচাপায় বা গাড়ির ধাক্কায়। যার জন্য দায়ী করা হয় চালক ও হেলপারের অবহেলা, অসতর্কতা ও অমনোযোগকে। তাদের কারণে একজন মানুষ আহত বা নিহত হচ্ছে বা আস্ত একটি পরিবার বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক যে ক্ষতি হচ্ছে, তার হিসাব তৈরি করেছে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব বলছে- ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা। আর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে মানবসম্পদের যে ক্ষতি হচ্ছে, তার আর্থিক মূল্য ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।
সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে গত এক যুগে জাতীয় বাজেটে ধারাবাহিকভাবে বরাদ্দ বেড়েছে। এ সময়ে নতুন সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি পুরোনো সড়কও চওড়া হয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সড়ক আইন পাশ করেছে সরকার; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সড়কে কোনোভাবেই মৃত্যু কমছে না। গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন ও বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী দেশে সড়ক দুর্ঘটনার পিছনে মোটা দাগে কয়েকটি কারণ পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে, চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অতিরিক্ত গতি, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও সড়ক।
তবে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যু নিয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে এমন এক তথ্য বলেছে যে, সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাওয়া, যত্রতত্র রাস্তা পারাপার, মোবাইল ফোনে চোখ রেখে চলাচল এবং যানবাহনে সংখ্যা বেড়ে যাওয়া অন্যতম কারণ। এর বাইরে রয়েছে চালকের বেতন, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকায় মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর প্রবণতা, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, জনসাধারণের ওভারব্রিজ, ফুটপাত না মানা এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
এই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে, একটা সুশৃঙ্খল নিয়মনীতি তৈরি করতে হবে যাতে চালক ও সাধারণ মানুষ সেই আইন মানতে বাধ্য হয়। যথাযথ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা যেন কমানো যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
সড়কে মৃত্যুর মিছিল কমাতে সারা বছর যে তৎপরতা, তা ঈদের আগে ও পরে আরও বাড়াতে হবে। সে সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণের টানে বড় শহর থেকে দেশগ্রামের বাড়িতে যায়। শেষ পর্যায়ে ছুটি পাওয়ায় পরিকল্পনা করে ট্রেন বা বাসের টিকেট করা নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। তারা চলাচল করেন চরম ঝুঁকি নিয়ে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার শিকার হন।
গণপরিবহনের সমস্যা ও বিপদগুলো বিবেচনায় নিয়ে ঈদযাত্রা প্রাক্কালে সড়ক নিরাপত্তার অগ্রাধিকারকে নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের বিশেষভাবে তৎপর হওয়া বাঞ্ছনীয়। নচেৎ সড়কে মৃত্যুর মিছিল কমবে না এবং ঈদের আগে ও পরে যেমন দেখা যায় প্রতিবছর, তেমনই ভয়াবহ চিত্র এবারও দেখা যাওয়ায় আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অতএব, আগেভাগের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপই কেবল সড়কের প্রাণঘাতী বিপদ হ্রাস করতে পারে।