সামাজিক মাধ্যমের যুগে প্রচলিত সংবাদ মাধ্যম আরও অপরিহার্য

, যুক্তিতর্ক

ড. এস এম রিজওয়ানুল আলম | 2024-04-07 13:00:18

ডিজিটাল যুগে এসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অপ্রতিরোধ্য একটি শক্তিই হয়ে উঠেছে। এই মিডিয়া সমাজটাকে বদলে দিচ্ছে আর যোগাযোগে ঘটিয়েছে বিপ্লব। কিন্তু ব্যাপক বিস্তৃত এই মিডিয়া আমাদের তথ্যচাহিদার সমগ্রপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। এবং পারবেও না। মিডিয়ার যে দীর্ঘ প্রচলিত ধারা তার স্থান দখল করে নেওয়া কখনোই সম্ভব হবে না সামাজিক মাধ্যমের পক্ষে। আর সেটা হয়তো সামাজিক মাধ্যম করবেও না। প্রচলিত গণমাধ্যম আমাদের তথ্য ব্যবস্থার মূলভিত্তি হিসেবেই থেকে যাবে। আর তা বহুবিধ কারণেই থাকবে।

দীর্ঘ প্রচলনে এই মিডিয়া ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে প্রিন্ট, রেডিও ও টেলিভিশন। যেগুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েই সমাজকে সেবা দিয়ে আসছে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে। সাংবাদিকতার মূল প্রপঞ্চ সততা, সঠিকতা ও নিরপেক্ষতাকে উচ্চে তুলে ধরেই এই মাধ্যমগুলো সামনে এগিয়েছে। এটা বলছি না যে, এসব মাধ্যম ব্যর্থ হতেই পারেনা। তবে এ কথা অবশ্যই বলা যায়, এই মিডিয়াগুলো জনগণের কাছে তাদের জবাবদিহিতা বজায় যেমন রাখতে পারে, তেমনি একটা চেক অ্যান্ড ব্যালান্সও তারা নিশ্চিত করতে পারে।

পক্ষান্তরে সামাজিক মাধ্যম এক ভিন্ন প্যারাডাইম নিয়েই হাজির হয়েছে, এবং পরিচালিত হচ্ছে। সঠিক তথ্য সরবরাহ এর প্রাথমিক লক্ষ্যই নয়। বরং ব্যবহারকারীকে কিভাবে সম্পৃক্ত করা যায়, ব্যস্ত রাখা যায় সোশ্যাল মিডিয়ার পেজে যেখানে তারা কনটেন্ট তৈরি করে ভাইরাল করবে, এটাই লক্ষ্য। আর এই 'ভাইরাল' মানসিকতাই সামাজিক মাধ্যমকে ভুলতথ্য ও অপতথ্য ছড়ানোর দিকে ধাবিত করছে। যার মারাত্মক পরিণতিও ঘটা সম্ভব, বিশেষ করে সঙ্কটময় সময়গুলোতে।

প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের প্রধান শক্তিগুলোর একটি হচ্ছে এর সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণ। তাদের নিয়োজিত সম্পাদকরা রয়েছেন, ফ্যাক্টচেকার রয়েছেন, যারা কোনো কনটেন্ট প্রকাশের আগে যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করে নেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তাদের প্রকাশিত তথ্য নির্ভরযোগ্য যেমন হয়ে ওঠে তেমনি তা বিশ্বাসযোগ্যও হয়। সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোর এমন সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা নেই বললেই চলে। একটি পোস্ট কোনো ধরনের ফ্যাক্টচেকিং ছাড়াই ভাইরাল হয়ে যেতে পারে, আর তার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে কোনো অপতথ্য।

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ অতিমারির সময় প্রচলিত সংবাদমাধ্যমগুলোয় সঠিক তথ্য প্রবাহের প্রচেষ্টা আমরা দেখেছি। সংবাদমাধ্যমগুলোর কারণেই তখন আমরা ভাইরাসটির বিস্তার, ভ্যাকসিন ও অন্যান্য প্রতিরোধক ব্যবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য পেয়েছি। ফলে এই সময়ে অপতথ্য ছড়ানোর প্রচেষ্টাগুলোকে ভন্ডুল করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

তবে, এটা নয় যে সামাজিক মাধ্যমের কোনো মেরিট নেই। এটি প্রত্যেকের মনের কথা বলার, মতামত প্রকাশের একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে কমিউনিটিকে এনগেজ করে রাখা সম্ভব। তাৎক্ষণিক যোগাযোগ ও মিথষ্ক্রিয়ার সুবিধার কারণে এটি জনমত গঠন ও সামাজিক পরিবর্তন প্রক্রিয়ায়ও একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা।

উপরন্তু, প্রচলিত গণমাধ্যমের জন্য এই মিডিয়া সহযোগী হয়ে উঠতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের কনটেন্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে বিস্তৃতি পেতে পারে, পৌঁছে যেতে পারে আরও বিস্তৃত পাঠক, শ্রোতা, দর্শকের কাছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত তথ্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা হতে পারে, কনটেন্টের সাথে পাঠক, দর্শক হয়ে উঠতে পারে আরও বেশি সম্পৃক্ত। তাতে বিষয়ভিত্তিক গভীরতর বোধগম্যতার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

আরেকটি বিষয়, সামাজিক মাধ্যমের এই উত্থান কিছু নতুন নতুন চ্যালেঞ্জও ডেকে এনেছে। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষার ক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করার মতো। ভাইরালের সংস্কৃতি আর দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে, বিভেদ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে এমন তথ্য ও বিশ্লেষণ এই মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে যা সমাজকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে যতগুলো সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঘটেছে তার সবগুলোর পেছনেই সামাজিক মাধ্যমের কোনো না কোনো ভূমিকা থেকে গেছে।

এহেন পরিস্থিতিতে সমাজে মিডিয়া লিটারেসি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। বিভিন্ন মিডিয়ার ভূমিকা ও সীমাবদ্ধতাগুলোর ব্যাপারে সঠিক বোধ থাকলেই নাগরিক সমাজ তথ্যের যথার্থ গ্রাহক হয়ে উঠতে পারবে। আর তাতেই রোধ করা সম্ভব হবে ভুল তথ্য ও অপতথ্যের বিস্তার।

তথ্যের বাতাবরণকে যদি আমরা আরও শক্তিশালী করে তুলতে চাই, তাহলে সরকার, প্রচলিত সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের মধ্যে একটি পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক সৃষ্টি করতে হবে। সংলাপের সংস্কৃতি ও পারষ্পরিক সম্মানবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমেই আমরা এই সম্পর্ককে ত্রিধাবিভক্তি এড়িয়ে যুথবদ্ধতার দিকে এগিয়ে নিতে পারি।

স্বাস্থ্যকর তথ্য বাতাবরণ নিশ্চিত করতে হলে প্রচলিত সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের মধ্যে সম্পর্ককে দ্বান্দ্বিক নয় বরং একটি সহযোগিতার সম্পর্কে রূপ দিতে হবে। সমন্বিত সম্ভাবনাগুলোর বাস্তবায়নে পারস্পরিক নির্ভরতার দিকগুলো স্বীকার করে নিয়েই এগুতে হবে। ডিজিটাল যুগে আমরা যত এগিয়ে যাবো, ততই আমাদের নতুন নতুন বিষয়ের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। তবে সাথে সাথে নিশ্চিত করতে হবে, আমাদের মিডিয়া ল্যান্ডস্কেপ যেনো থাকে ভাইব্র্যান্ট, বহুমুখী ও গণতান্ত্রিক।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মিডিয়া, কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম, নর্থ সাউথ ইউনির্ভাসিটি (এনএসইউ)

দ্য ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত নিবন্ধটির ভাবানুবাদ করেছেন মাহমুদ মেনন, এডিটর এট্ লার্জ; বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর