গরীবি চেহারার গাড়িগুলোর গর্বিত মালিক কারা?

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2024-05-21 03:26:51

আমাদের রাজধানী ও সারাদেশে একই রাস্তায় চলন্ত গাড়ির ধরণ বিভিন্ন তবে এদের মালিক মূলত: দুই শ্রেণির। ধনী আর গরিব মালিক। গরিব মালিকরা কখনো কখনো মাত্র একটি পুরনো গাড়ির মালিক। তাদের গড়িগুলো হতে পারে একটি বাস বা মাইক্রোবাস, একটি সিএনজি, একটি বা কয়েকটি অটোরিক্সা। তারা সেটাকে ভাড়ায় খাটান অথবা নিজেরাই সেটা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। গত বছর রাজপথ থেকে পুরনো গাড়ি সরানো হবে খবর প্রচারিত হলে তাদের অনেকেই ভেবেছেন উপার্জনের একমাত্র সম্বল একটিমাত্র গাড়ি। সেটাকে পথে চালাতে না দিলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে মারা যাবেন।

এসব পুরনো গাড়ির ব্যক্তিমালিকরা কখনো কোন নীতিনির্ধারণী সভায় আমন্ত্রিত হন না, তাদের কোন প্রতিষ্ঠান নেই। অন্যদিকে পুরনো গাড়ির ধনী মালিকদের এককজনের বহু গাড়ি, নিজস্ব পরিবহন প্রতিষ্ঠান, লোকবল, সমিতি, নেটওয়ার্ক সবকিছুই আছে। তারা নতুন গাড়ি কিনে দূরপাল্লায় দেন ও অতিপুরনোগুলো ঢাকা-চট্টগ্রামে চালান। তারা সরকারের নীতিনির্ধারণী সভায় আমন্ত্রিত হন, মতামত প্রদান করেন।

এসব বাস মালিকদের উদ্দেশ্য করে এক সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, ‘রাজধানী ঢাকায় অনেক উন্নয়ন হলেও লক্করঝক্কর বাস চলাচল বন্ধ হয়নি। এ জন্য ১২ বছর মন্ত্রী পদে থেকে কথা শুনতে হয়। আপনাদের কি লজ্জা করে না?... আমাকে জিজ্ঞেস করল, এত বছর মন্ত্রী আছেন, গাড়িগুলোর এই অবস্থা? এই গাড়িগুলো চলে চোখের সামনে। কেন এই বাস বন্ধ করা যায়নি? এটি সত্যিই লজ্জার বিষয়। আপনাদের কি লজ্জা করে না?’ প্রশ্ন হলো- গরীব গরীব চেহারা কি শুধু রাজপথে চলাচলকারী গাড়িগুলোর? জড় পদার্থ ছাড়া গরীব চেহারার জীবগুলোর কথা আগে ভাবা উচিত। জীবগুলোর গরীবি চেহারা দেখানো বন্ধ হলে তাদের বাহনগুলোর গরীবি চেহারা হয়তো আর দেখা যাবে না।

রাজপথে ক্ষুধার তাড়নায় রাজকীয় গাড়ির বন্ধ জানালায় টোকা দিয়ে এক টাকা দাবী করা ভিক্ষুক, ভবঘুরে, অভাবী মানুষ তাদের চেহারাও বেশ মলিণ ও গরীবি। তাদের মোট সংখ্যা কত? তারা নিশ্চয়ই মাফিয়াদের কালো কাঁচ লাগানো গোপন পরিবহন দ্বারা পরিবাহিত হন অথবা রিক্সাভ্যান, অথবা গরীবি চেহারার বাসে চলাচল করেন। এসব তথ্য নীতিনির্ধারকের কাছে মোটেও অজানা নয়।

তিলোত্তমা ঢাকার রাস্তায় হাল ফ্যাশনের গাড়ির পাশে রঙ চটা, কালো ধোঁয়া ছড়ানো, লক্কর-ঝক্কর মার্কা গাড়ি, বাস চলাচল করা নিতান্ত বেমানান। এসব গাড়ির কোনটির বয়স তেতাল্লিশ বছর পার হয়েছে। এরে চেয়ে আরো কত বৃদ্ধ গাড়ি রাজপথে ও দেশের আনাচে কানাচে চলাচল করছে তার কোন পরিসংখ্যান কেউ দিতে পারবে বলে মনে হয় না। এসব গাড়ির গর্বিত মালিক কারা?

গত বছর পুরনো গাড়ি ডাম্পিং করার কথা উঠলে এক শ্রেণির মালিকরা না খেয়ে মারা যাচ্ছেন বলে সংবাদ হয়েছিল। এখন তো অতি বৃদ্ধ গাড়ি ধরে ধরে স্ক্রাপিং করার কথা ভাবা হচ্ছে। তাহলে তাদের এবার কি হবে? অতি বৃদ্ধ গাড়ি স্ক্রাপিং করার পদ্ধতি সব উন্নত দেশে প্রচলিত। সেখানে অতি বৃদ্ধ গাড়ি ধরে ধরে আনতে হয় না। কোন
গাড়ি সরকার নির্দেশিত বয়সসীমা পার হয়ে গেলে তার লাইসেন্স নবায়ন করা হয় না। উন্নত দেশে লাইসেন্স নবায়ন করা হয় স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে। এতে কোন নতুন গাড়িও যদি ফেল করে তাহলে সেটা রাস্তায় চলাচলের অনুমতি পায় না। তিনি বাধ্য হন সেই গাড়িকে ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসতে। মজার ব্যাপার হলো, উন্নত বিশ্বে ফিটনেস পেতে ব্যর্থ গাড়িকে ডাম্পিং ও স্ক্রাপিং করতে হলে নির্দিষ্ট ফি জমা দিয়ে সরকারী ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসতে হয়। সেসব ভাগাড় ভর্তি হলে সরকারী লোকেরা নষ্ট গাড়িগুলোকে স্ক্রাপিং করে মন্ড বানিয়ে লৌহজাত দ্রব্য তৈরীর কারখানায় পাঠিয়ে দেয়। স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে ফিটনেস পেতে ব্যার্থ গাড়িকে রিসাইকেল করার নিয়ম নেই। পরিবেশ সচেতনতা আইনের কঠোরতা থাকায় তারা নিজেদের দেশে সেসব পুরনো গাড়ি চালাতে পারে না। জাপান ও কিছু দেশ পাঁচ বছরের পুরনো কিন্তু সচল গাড়িকে বিদেশে রপ্তানী করে থাকে।

আমাদের দেশে অবৈধভাবে আমদানী, বেনামী, ফিটনেসবিহীন, দুর্ঘটনা কবলিত ইত্যাদি গাড়িকে মামলা দিয়ে ধরে এনে থানার পাশে ডাম্পিং করা হয়। বহু থানায় জায়গা না থাকায় রাস্তায় সারিবদ্ধ করে ফেলে রাখা হয়। অনেক সময় ঘুষের ভয়ে মালিকরা গাড়ি ফেরত নিতে আসে না। সেখান থেকে বছরের পর বছর জং ধরে এসব গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে ধোলাই খালে বিক্রি হয়।

কারণ, এসব গাড়ির মালিক ও এর তদারকিতে অফিসে ও রাস্তায় দায়িত্বরত কোন কোন মানুষের মন খুব গরীব। তাদের জৌলুষ ও চেহারা কিন্তু গরীব নয়। তাই কে শোনে কার কথা? ফিটনেসবিহীন, দুর্ঘটনা কবলিত গাড়িগুলো স্ক্রাপ না হয়ে গোপনে পুনরায় রাজপথে ফিরে আসার অনুমতি পায়। রাজধানীর একই রাস্তায় রোলসরয়েস, মার্সিডিজ, পাগানি, বিএমডব্লিউ, টেসলা, টয়োটা, ফেরারী ইত্যাদি বিলাসবহুল কারের সাথে ৪৩ বছরের পুরনো লক্কর-ঝক্কর বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, মুড়ির টিন, রিক্সা, ভ্যান, ঘোড়ার গাড়ি চলতে দেখা যায়। দানব মোটর বাইক ফাঁক-ফোকর দিয়ে পিড় পিড় করে হর্ণ বাজিয়ে পথচারীর গা ঘেঁষে চলে যাবার জন্য তাড়াহুড়ো
করে। এটাই তো আমাদের পথ চলাচলের চিরায়ত কৃষ্টি!

এর জন্য কোন মোটিভেশন আজ পর্যন্ত কাজে লাগানো যায়নি। দেশের গ্রামাঞ্চলে এমনকি হাইওয়েতে চলে নসিমন, করিমন, পঙ্খীরাজ নামক অটোরিক্সা, ভুটভুটি, চান্দের গাড়ি আরো কত কি ! নতুন রাস্তায় আধুনিক মোটর বাইক অন্যান্য গড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে চলার কৃষ্টি চালু করেছে সাড়ম্বরে। এসবের গতি নিবারণের জন্য সিসি ক্যামেরা বসালেও অদ্যাবধি দক্ষ ও সৎ জনবল তৈরী করা যায়নি। মুখের কথা ও দেশের বাস্তব অবস্থার মধ্যে এখানেও দুস্তর ব্যবধান তৈরী হয়ে আছে। গরীবি চেহারার এসব গাড়ি ছাড়াও একইসংগে অনেক বিলাসবহুল গাড়ির মালিক অনেক আমলা ও রাজনৈতিক নেতারাও। এজন্য নেপথ্যে থাকা মালিকদেরকে চিহ্নিত করতে হবে।

এতদিন পরে ‘সাবওয়ে আমাদের করতেই হবে’ আমাদের যোগাযোগমন্ত্রীর এমন বোধদয় হওয়ায় তাঁকে অনেক ধন্যবাদ। তবে পুঙ্খানুভাবে পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণ না করে বন্যাপ্রবণ ঢাকায় সাবওয়ে মতো বড় কোন প্রকল্প তৈরীর আগাম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে সাবওয়ে থেকে তেমন কোন উপকার পাওয়া কঠিন। কল্পিত পাতাল পথের সাথে উপরের প্রচলিত পথের কানেক্টটিভিটির বিষয়টি বেশী গুরুত্ব দেয়া উচিত। এতে মানুষ নিকটস্থ জেলাশহরগুলো থেকে প্রতিদিন ৩০-৪০মিনিটে ঢাকায় এসে অফিস করে বাড়িতে ফিরতে পারবে। তাহলে জাপানের টোকিওর সাথে সাইতামা, চিবা, তোচিগি ইত্যাদি নিকটস্থ জেলার মতো আমাদের জনগণ ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সিপঞ্জ থেকে ডেইলী প্যাসেঞ্জারী করে ঢাকায় চাকুরী করতে পারলে ঢাকার উপর মানুষ ও বসতির চাপ কমবে এবং গরীবি চেহারার পুরনো যানবাহনগুলো এমনিতেই বিলীন হতে পারে।

*লেখকঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন

এ সম্পর্কিত আরও খবর