ইব্রাহিম রাইসি’র মৃত্যু-পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়া

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2024-05-21 14:36:18

সৈয়দ ইব্রাহিম রাইসি আল সাদাতি (জন্ম ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৬০) সাধারণ মানুষের কাছে ইব্রাহিম রাইসি নামেই পরিচিত একজন রাজনীতিবিদ, বিচারক।

নির্বাচনে জয়ী হয়ে ৩ আগস্ট (২০২১) থেকে ১৯ মে (২০২৪) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ইরানে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার মৃত্যু ‘নিছকই দুর্ঘটনা’ না কি ‘সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড’, তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী চলছে তুমুল আলোচনা। কারণ, তিনি ছিলেন শক্ত মেজাজের নেতা। মধ্যপ্রাচ্যে তথা আরব বিশ্বে মার্কিন-ইসরায়েল আধিপত্যের বিরুদ্ধে খুবই সোচ্চার। পশ্চিমা আগ্রাসনবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও গ্রুপের সহযোগী।

মার্কিন-ইসরায়েল তাকে প্রধান শত্রু মনে করতো। ফলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তার মৃত্যু শুধুই ‘এক্সিডেন্ট’ নাকি ‘পলিটিক্যাল কিলিং’!

মার্কিন যুক্তরাষ্টের কাছে রাইসি ছিলেন ‘বিতর্কিত ও কট্টর মৌলবাদী’। তার শাসনকালকে ‘নারী অধিকার ও মানবাধিকারের পরিপন্থী‘মনে করতো ওয়াশিংটন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল অফিস তাকে নিষিদ্ধ করেছিল এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদকেরা তাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। তার রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি (JCPOA) নিয়ে আলোচনা আটকে যায়।

তারপরেও রাইসিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি পশ্চিমা শক্তি। তার শাসনামলে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিদর্শনে বাধা দিয়েছে এবং রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণে সমর্থন দিয়েছে। ইরান গাজার সংঘাতে ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় এবং হিজবুল্লাহ ও হুথি আন্দোলনের মতো গোষ্ঠীগুলিকে অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে।

অতএব, কপ্টার দুর্ঘটনায় রাইসির আকস্মিক মৃত্যুর পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো সমবেদনার পথে না হেঁটে সরাসরিই বলেছে, ‘এই মানুষটির হাতে যে অনেক রক্ত লেগে রয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ কোনো নেই’।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের প্রতিবাদে রাইসির সমর্থকেরা প্রশ্ন করেছেন, ‘গাজ়ার মানুষের রক্ত তা হলে কার হাতে লেগে আছে! ইসরায়েল, না তাদের অস্ত্র জোগানো অন্ধ সাপোর্টার যুক্তরাষ্ট্রের! রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, দু’জনেই রাইসির মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে তাকে ‘প্রকৃত বন্ধু’ বলেছেন।

প্রথাগত রাজনীতির পথে ইব্রাহিম রাইসি ইরানের ক্ষমতার শীর্ষে আসীন হননি। তিনি ছিলেন ইরানের বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত উপপ্রধান বিচারপতি। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি ছিলেন।

১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে তিনি তেহরানের প্রসিকিউটর এবং উপ-প্রসিকিউটর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি আস্থান কুদস রাযভী নামক একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক এবং চেয়ারম্যান ছিলেন। রাইসি ২০০৬ সালে দক্ষিণ খোরাসান প্রদেশ থেকে প্রথমবারের মতো বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি মাশহাদের জুমা নামাজের ইমাম এবং ইমাম রেজা মাজারের প্রধান ইমাম আহমদ আলা মোলহোদার জামাতা।

রাইসি ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, কিন্তু মধ্যপন্থী রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানির কাছে পরাজিত হন। তিনি ২০২১ সালে ফের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে ৬২.৯ শতাংশ ভোট পেয়ে হাসান রুহানিকে পরাজিত করেন।

অনেকেই মনে করেন, এই নির্বাচন রাইসির পক্ষে প্রভাবিত করা হয়েছিল। কারণ, তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ মিত্র। রাইসিকে খামেনির পরবর্তী উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

সন্দেহ নেই, ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার পর ইরাসের ইতিহাসে রাইসির শাসনকাল ছিল অত্যন্ত সংকটময়। ভেতরের নানা আন্দোলন থামানোর পাশাপাশি ইরানকে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় সদা নিয়োজিত থাকতে হয়েছে তাকে।

অন্যান্য মুসলিম দেশ যেখানে মার্কিন-ইসরায়েল আধিপত্য ও গণহত্যা মেনে নিয়েছে, ইরান তা করেনি। ইরানি রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব সর্বদা সচেষ্ট থেকেছে, মার্কিন-ইসরায়েল আগ্রাসন মোকাবিলায়। সে কারণে ইরানি জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রাইসিকেও হত্যা করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। কেননা, রাইসির কপ্টার নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছিল, তারা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকেও সব জানানো হয়েছে।

হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মুখপাত্র জন কার্বি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলিকে মদত দিচ্ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। গোটা অঞ্চলকে অস্থির করে রাখার অভিযোগ ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতেও তুলবে।’

রাইসির শাসনকালে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মারাত্মক কিছু ঘটনা ঘটেছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘হামাস’কে সাহায্য করেছে। হিজ়বুল্লাহ গোষ্ঠীকে শক্তিশালী করেছে। সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে বোমা ফেলায় ইসরায়েলকে নিশানা করে ইরান পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। যদিও এরপর ইস্পাহানের কাছে ইরানের এয়ারবেসে বোমা ফেলে আসে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান।

হরমুজ় প্রণালীতে ইসরায়েলি মালিকের একটি জাহাজকে পণবন্দিও করে ইরানের বাহিনী। মোটের ওপর, মার্কিন-ইসরায়েলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়ে যাচ্ছিল রাইসির ইরান। এমনকী, মার্কিন নিষেধাজ্ঞাতে পরোয়া না করে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে মৈত্রী গঠন করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিকল্প পরিসর তৈরি করে নেয় রাইসির নেতৃত্বাধীন ইরান।

১৯ মে (২০২৪) রোববার ইব্রাহিম রাইসি পূর্ব আজারবাইজানের প্রদেশে জলপাই এলাকায় প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলীর সঙ্গে জলাধার প্রকল্প উদ্বোধন শেষে ফেরার পথে রাইসিকে বহনকারী একটি হেলিকপ্টার ইরানের উত্তর-পশ্চিমে ভারজাকান এলাকার একটি দুর্গম পাহাড়ে বিধ্বস্ত হয়।

ওই দুর্ঘটনায় ইব্রাহিম রাইসি, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির-আব্দুল্লাহিয়ানসহ হেলিকপ্টারে থাকা সবাই অর্থাৎ ৯ জন নিহত হন। কপ্টার ভেঙে রাইসির মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলা হলেও নানা ঘটনাপ্রবাহ সন্দেহের আঙুল তুলছে ইরানের প্রতিপক্ষের দিকে।

কৌশলী ইরান হয়ত গোটা পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কায় সমঝে চলছে। তার সামনে নেতৃত্বের শূন্যতা পূর্ণ করা এবং রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখাই আপাতত বড় চ্যালেঞ্জ।

রাইসির মৃত্যুশোক পালনের মধ্যেই ইরান আগামী ২৮ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছে। ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর পর অন্তর্বর্তীকালীনভাবে ওই ভূমিকায় থাকার কথা ভাইস প্রেসিডেন্টের। ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মোখবর সাময়িকভাবে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব সামলাবেন। তাকে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া মেনে কাজ করতে হবে। ইরানের সংবিধানে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্টের আচমকা মৃত্যু হলে ভাইস প্রেসিডেন্ট সাময়িকভাবে ওই দায়িত্ব সামলাবেন। তিনি সরকারের তিন সদস্যের কাউন্সিলের একজন সদস্য হিসেবেই ওই দায়িত্ব পাবেন। কাউন্সিলে ভাইস প্রেসিডেন্ট ছাড়াও রয়েছেন ইরানের পার্লামেন্টের স্পিকার এবং বিচার বিভাগের প্রধান।

প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর ৫০ দিনের মধ্যে এই কাউন্সিল দেশে নতুন করে নির্বাচনের আয়োজন করবে। তার মাধ্যমেই স্থির হবে ইরানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন।

২৮ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নতুন প্রেসিডেন্ট যিনিই হবেন, তাকে রাইসির মৃত্যুতে পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে সৃষ্টি হওয়া একরাশ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবতে হবে। মার্কিন-ইসরায়েলি প্ররোচনায় যাতে পশ্চিম এশিয়ায় উত্তেজনা না বাড়ে এবং ইরানের স্বার্থ রক্ষিত হয়, সেসব বিষয় নিয়েও সতর্ক থাকতে হবে নতুন নেতাকে।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে কড়া দর-কষাকষিরই পক্ষপাতী ছিলেন রাইসি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিলেন মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্রের ‘বন্ধু’ যে পাকিস্তানের সঙ্গে গত জানুয়ারিতে ইরানের যুদ্ধ বাধার উপক্রম হয়েছিল, শেহবাজ় শরিফের সরকার গঠনের পরে তিনদিন ধরে সে দেশেই সস্ত্রীক সফর করে দ্বিপাক্ষিক, একাধিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার অঙ্গীকার করে এসেছিলেন রাইসি। স্পষ্টতই, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে শত্রুতা ভুলে বন্ধুতার প্রয়োজন বুঝেছিলেন বৈদেশিক রাজনীতিতে পটু ও কৌশলী রাইসি। নতুন ইরানি নেতা রাইসির পথে চলেন না কি নতুন রাস্তা বের করেন, সেটাই দেখার বিষয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য রাইসির পিছু ছাড়েনি। ইরানের সঙ্গে সখ্যতার ‘অপরাধে’ পাকিস্তানকে নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছিল। সেই হুঁশিয়ারির সুর আবার শোনা গিয়েছিল চাবাহার বন্দর নিয়ে ভারতের সঙ্গে ইরানের চুক্তির পরে।

মনে করা হয়, ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গেও চুক্তির পথে হাঁটছিলেন রাইসি। মার্কিন অবরোধ, নিষেধাজ্ঞা ও নানা প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে দেশের ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কমিউনিস্ট রাশিয়া, চীন ও অপরাপর দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা বুঝেছিলেন রাইসি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের নীতি একা প্রেসিডেন্ট তৈরি করেন না। স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনেকগুলো সংস্থা ও ফোরাম মিলিতভাবে দেশের জন্য নানান রকমের নীতি প্রণয়ন করে। প্রেসিডেন্ট তার মন্ত্রীদের নিয়ে সেসব বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন। ফলে, রাইসির মৃত্যুতেও ইরানের জাতীয় নীতির খুব একটা বদল হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে, এটাও ঠিক যে, রাইসির মৃত্যুর প্রভাব পড়তে চলেছে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় ভূ-রাজনীতিতে ও আঞ্চলিক ক্ষমতার মেরুকরণে। সংঘাত, যুদ্ধ, আগ্রাসন, গণহত্যায় জর্জরিত ওই অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান শক্তির লড়াইয়ে রাইসির ইরান যেভাবে নেতৃত্বের আসনে চলে এসেছিল এবং সমমনাদের নিয়ে বড় মাপের মেরুকরণ করে মার্কিন-ইসরায়েল জোটের বিরুদ্ধে লড়ে চলছিল, তার প্রভাব সহজে মুছে যাবে না।

ড. মাহফুজ পারভেজ: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর