এ যেন পথভ্রষ্ট কোকাকোলা বাংলাদেশ!

, যুক্তিতর্ক

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, সাউথ-ইস্ট এশিয়া | 2024-06-11 14:36:07

বিশ্বজুড়ে সমাদৃত কোমল বা কার্বনেট পানীয় কোকাকোলা কোন দেশের প্রতিষ্ঠান, এ লেখার আলোচ্য এটা নয়। বরং গত কয়েক মাসে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোকাকোলা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ আলোচনা।

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের হামলার পর থেকে কোকাকোলা, পেপসি, ইউনিলিভার, ম্যাকডোনাল্ড, স্টারবাকসের মতো বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং গণহত্যাবিরোধী মানুষেরা। এর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে কোকাকোলা নিয়ে, অন্তত গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-চিত্র সেটাই বলে।

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের হামলার বিরুদ্ধে যে কটি দেশ শক্ত অবস্থান নেয়, তার মধ্যে নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থায় রয়েছে মালয়েশিয়া। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইসরায়েলের গণহত্যাবিরোধী র‍্যালির নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাই দেশটিতে স্টারবাকস এবং ম্যাকডোনাল্ডের মতো আউটলেট বন্ধ হওয়াতে খুব অবাক হয়নি কেউ।

চলতি বছরের শুরুতে মালয়েশিয়ায় স্টারবাকস ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। তবে বিভিন্ন সময় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি এবং সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ ছাড়া এই বয়কট স্রোতে নিজেদের শান্ত রাখে তারা। এমনকি মার্চের মাঝামাঝি সময় এসে স্টারবাকস জানায়, বছর শেষে এই অঞ্চলে তাদের ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবে।

বহুজাতিক এত পণ্য থাকতে বাংলাদেশে কোকাকোলার কেন সবচেয়ে বেশি ব্যবসায়িক ক্ষতি বা কোকাকোলাই কেন খাদে পড়ল—সেটা তারাই কেবল বলতে পারেন। তবে একজন সাবেক কমিউনিকেশন প্রফেশনাল এবং সাংবাদিক হিসেবে বলতে পারি, কোকাকোলার কমিউনিকেশন এবং ব্র্যান্ডিং বিভাগের দুর্বলতা স্পষ্ট।

সম্প্রতি প্রচারিত কোকাকোলার তিনটি ক্যাম্পেইন বা বিজ্ঞাপন এবং কন্টেন্ট এখানে বিশ্লেষণের চেষ্টা করব।

মে মাসের ৩ তারিখে নিজেদের দেশীয় ইমেজ প্রতিষ্ঠায় দেশের প্রথম সারির পত্রিকায় মলাট বেধে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে কোকাকোলা বাংলাদেশ। তবে বয়কট আন্দোলনের শ্রেণিবৈচিত্র্য নিয়ে তাদের কোন ধারণা আছে বা স্টাডি করেছে কিনা সেটা বোঝার উপায় ছিল না। 'আমরা মানুষে মানুষে সৌহার্দ্যের পক্ষে' বা ‘৬ দশকের বিশ্বাসে ভালবাসায় আছি পাশে,’ এ ধরনের বাক্য যে সকল বাঙালির কাছে এক দেখাতেই বোধগম্য হয় না, সেটা কোকাকোলা বাংলাদেশের মতো একটি কোম্পানির কমিউনিকেশনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের চোখ এড়াল কীভাবে! বোধগম্য নয়। এরকম বাক্য দিয়ে যে মানুষের কাছে যাওয়া যায় না, এটাই হয়তো তাদের অজানা!

মে মাসের মাঝামাঝি সময় আবারো কিছু দুর্বল বাক্য নিয়ে বিজ্ঞাপনে আসলো কোকাকোলা। বিশেষ করে নিজেদের বাঙালি প্রমাণের জন্য যে উঠেপড়ে লাগল, সেটা কোম্পানির জন্য উদ্বেগজনক। কোকের সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয়তার তো কোন দ্বন্দ্ব নেই।

এই বিজ্ঞাপনগুলোতে স্পষ্ট হয়েছে, কন্টেন্ট তৈরি করা ব্যক্তিদের গবেষণার অভাব এবং সংস্কৃতির সঙ্গে দূরত্ব। একটা ৫ লাইনের কন্টেন্টে ২ বার 'ই' প্রত্যয়ের ব্যবহার যে আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব ফুটিয়ে তোলে সেটা কোকাকোলার কন্টেন্ট বা ব্র্যান্ড নিয়ে কাজ করা কারো মাথায় আসেনি! বাক্যে ‘আমরা’ এর বদলে ‘আমরাই’, ‘কর্মী’র বদলে ‘কর্মীই’ বলাটা দৃষ্টিকটু ছিল।

আর বাক্য গঠন যেন ফেসবুকের রিলস বা টিকটকের জন্য তৈরি! 'এইতো আমার কোক', বাক্যে 'এইতো' বলায় মনে হচ্ছিল, কারো বোতলটা হারিয়ে গিয়েছিল, আবার খুঁজে পেয়েছে!

সবশেষে সম্প্রতি যে টিভিসি’ বানানো হলো তাতো মনে হচ্ছে বাংলাদেশে কোকাকোলার কফিনের শেষ পেরেক!

বাংলাদেশিরা ক্রিকেট পাগল। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বুঁদ হয়ে আছে এখন। বাংলাদেশে কোকাকোলার বয়কটের চেয়ে গ্রাম-গঞ্জের হাটে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এখন আলোচনা সৌম্য সরকার এবং নাজমুল হোসেন শান্ত। সেখানে কেমন জানি নিজেদের জোর করে মনে করিয়ে দিলো কোকাকোলা বাংলাদেশ। দুর্বল স্ক্রিপ্ট এবং সমালোচিত অভিনেতাদের দিয়ে যে বিজ্ঞাপন তৈরি করা হলো, সেটি শুধু কোকাকোলা বয়কটকেই আবারো উসকে দেয়নি, কোকাকোলা বিক্রির দোকানকেও বয়কট করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

ভবিষ্যতে ব্র্যান্ডিং বা কমিউনিকেশনের বাজে উদাহরণ হিসেবে হয়তো কোকাকোলা বাংলাদেশের এই পদক্ষেপগুলো নিয়ে কাঁটাছেড়া করা হবে।

উপরে দেওয়া তিনটি উদাহরণে একটিতেও স্পষ্ট হয়নি আসলে কোকাকোলা বাংলাদেশ কী বলতে চায়, কেন বলতে চায়, গ্রাহকের কাছ থেকে কী চায় তারা?

এ সম্পর্কিত আরও খবর