রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র থেকে গাজীপুরের নিভৃতগ্রাম শিমুলতলার দুরত্ব ৭০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। সড়কপথে একসময় টঙ্গীর শিল্পাঞ্চল পেরুনোর পরই মনে হতো যেন ঘন সবুজের কোন অরণ্য। সময়ের স্রোতে শিল্পায়নের ব্যাপকতায় সবুজের সেই অরণ্য ক্রমেই ইট-পাথরের নগরীতে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরে সড়ক যোগাযোগের যে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে তাতে ঢাকার পাশের জেলা গাজীপুরেও বদলে গেছে যাতায়াতের চালচিত্র। অনেকগুলো উড়াল সড়ক পেরিয়ে গাজীপুর চৌরস্তা থেকে চার লেনের মহাসড়ক এগিয়ে গেছে ময়মনসিংহের দিকে। তীব্র যানজটের পথ হিসেবে এই সড়কের যে কুখ্যাতি ছিল বর্তমানে তা অনেকটাই ভুলতে বসেছে মানুষ। গত রমজানের ঈদের মতো এবারও বেশ নির্ঝঞ্জাট ঈদযাত্রার খবর দিয়েছে গণমাধ্যমগুলো। তার প্রমাণ মেলে রাজধানীর বাংলামটর থেকে শিমুলতলার পথে যাত্রা করে এক ঘন্টার কম সময়ে গাজীপুর চৌরাস্তা পৌছে যাওয়ায়। সব মিলে মাত্র দেড় ঘন্টায় শিমুলতলায় পৈত্রিক ভিটায় যখন আমাদের গাড়ি পৌছায় ততোক্ষণে সন্ধ্যায় নেমেছে।
ক’দিন আগেই ফোনে মা বলেছিলেন, গ্রামে শিয়ালের বংশবৃদ্ধি ও উৎপাত দুই-ই বেড়েছে। গাড়ি থেকে নেমেই হুক্কাহুয়া ডাকে তার প্রমাণও পাওয়া গেল। শিয়ালের প্রসঙ্গ উঠতেই জানা গেল আরও অনেক তথ্য। বছর খানেক পূর্বে নাকি শিয়ালের উৎপাতে অতিষ্ট হয়ে স্থানীয়রা পোল্ট্রির মৃত মুরগিতে সিরিঞ্জ দিয়ে বিষ প্রবেশ করিয়ে শেখ ভিটার জঙ্গলে ফেলে রাখে। উৎসুক গ্রামবাসী পরদিন গিয়ে ওই জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মরে পড়ে থাকা গোটা দশেক শিয়াল দেখে উৎফুল্ল হয়েছিল। এককালে ভাওয়াল পরগণার গহীন গজারি বনে স্থানীয় শাসক ভাওয়াল রাজা মধ্যম কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায়ের বাঘ শিকারের ঐতিহাসিক ছবি স্মরণ করিয়ে দেয় এই জনপদের মানুষদের শিকারি চরিত্রের কথা। কিন্তু অধুনা ভাওয়ালে (বর্তমান গাজীপুর জেলা) এই সময়ের ঘনবসতিপূর্ণ লোকালয়ে বিলীয়মান বনের অবশিষ্ট ঝোপঝাড়ে ঠাঁই নেওয়া শিয়ালের মতো কিছু প্রাণীদের হত্যার আয়োজন যে নিতান্তই পৈশাচিকতা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঠিক জানার সুযোগ হয়নি, শেখভিটার অদূরে কাওরাইদ বনবিটের বলদীঘাট বাজারস্থ অফিস শিয়াল হত্যার ওই ঘটনায় কোন ব্যবস্থা নিয়েছিল কিনা। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে নিশ্চিতভাবেই তা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসাবে আমলে আসা উচিত ছিল। বন্যপ্রাণীদের আবাস বনাঞ্চল ধ্বংসের মাধ্যমে জনবসতি স্থাপন করে আমরাই যে প্রাণীদের অধিকার খর্ব করেছি-বেমালুম সেকথা ভুলে যাওয়া এই সমাজের কাছে শিয়াল হত্যা নিতান্তই মামুলি ব্যাপার।
শিশুপুত্রকে গাড়ি থেকে নামিয়ে যখন ঘরে নিয়ে যাচ্ছিলাম, শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাকে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে সে ঝাপটে ধরে রেখেছিল। মনে পড়ে সাড়ে তিন দশক আগে কেমন ছিল ভাওয়ালের এই জনপদের চিত্র। মা’য়ের কোলে বসে আমরাও সেদিন বাঘের গল্প শুনেছি। শুনেছি দলবেধে বানরের দল কিভাবে আমার বাবাকে ঘিরে ফেলেছিল। এবং কিভাবে জনৈক প্রতিবেশি লাঠি হাতে তাকে উদ্ধার করেছিলেন সেই গল্প। কিশোর বয়সে গরু-মহিষের পাল নিয়ে মাঠে চড়াতে যাওয়া আমার বাবা দুষ্টামি বশতঃ এক বানরকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে বসেছিলেন, মুহুর্তেই কয়েকশ’ বানর তাকে ঘিরে ধরেছিল। সেদিন তিনি দলবদ্ধ বানরের আক্রমণ থেকে বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বানরের দল কয়েক দশকে দলছুট হতে হতে ক্রমেই নিঃসঙ্গ হয়েছে। এখন কোথাও হয়ত এক-দু’টি নিঃসঙ্গ বানরকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাবে-একটু খাবারের আশায় লোকালয়ের আশেপাশে। দলবেধে আমার কিশোর বাবাকে আক্রমণ করা সেই বানরেরা এখন তটস্থ থাকে মানুষের ভয়ে।
শৈশব-কৈশোরে আমার একাকী ঘুরে বেড়ানোর প্রিয় জায়গা ছিল বাড়ির দক্ষিণে ঘন-গভীর গজারী বন। কখনো পায়ে হেটে বা সাইকেলে চেপে। যদ্দূর মনে পড়ে, সাইকেলের সিটে বসে চালানোর সক্ষমতা তখনও হয়নি। মাঝে প্যাডেলের কাছে মাথা ঢুকিয়ে সাইকেল চালনার এক কৌশল রপ্ত করেছিলাম। সেভাবেই চালিয়ে বনে ছুটে যেতাম। বনের মাটি খুঁড়ে আলু পাওয়া যায়, সেই আশায় কত মাটি খুঁড়েছি-তার অন্তঃ নেই। মানুষের নির্দয় আগ্রাসনে ততোদিনে বাঘেরা ভাওয়ালের বন থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু শৈশবে বাবা-মা’র কাছে কিছু স্থান-নামের নেপথ্য কাহিনী শুনে কল্পনায় বাঘেদের বিচরণ কেমন ছিল তা ঠাওর করা চেষ্টা করেছি। আমার গ্রামের পাশেই ‘বাঘেধরা’ নামক জায়গাটি এখনও ওই অঞ্চলে এককালে বাঘের অস্তিত্বকে নীরবে জানান দেয়। শিশুপুত্রকে প্রাণীদের লুপ্ত হওয়ার গল্প শুনিয়ে অভয় দিয়ে সেই রাতের মতো শান্ত করা গিয়েছিল।
দুই দশক আগেও বিদ্যুত ছিল যে জনপদের মানুষদের জন্য স্বপ্নের মতো সেই শিমুলতলা গ্রামের মানুষেরা এখন বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত। বাড়িতে বাড়িতে এলইডি টেলিভিশন, ফ্রিজ, ব্লেন্ডারসহ বিচিত্র সব ইলেকট্রনিক সামগ্রী। যে গ্রাম থেকে ১০ মাইল পথ হেটে ঢাকায় যাওয়ার ট্রেন বা বাস ধরতে যেতে হতো সেই গ্রামে এখন ঘরের উঠোনে পিচঢালাই কিংবা ইটের কার্পেটিং রাস্তা! গ্রামের নারীরা দলবেঁধে কাওরাইদ, জৈনাবাজার কিংবা মাওনা সুপারমার্কেটে ছুটছেন ঈদ কেনাকাটা সারতে। এ এক অভাবনীয় পরিবর্তনই বটে।
কিন্তু শ্যামল গ্রামের ‘শ্যামলিমা ছায়াছবি’ ছাপিয়ে এবার ঈদে শিমুলতলার আরও বহু পরিবর্তন চোখে পড়ল। যাকে অধঃপতন বললেও বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্কর’-শৈশবে শুনলেও এই সময়ে এসে এর প্রকৃত মর্মার্থ বোঝা গেল। এক সময় এই গ্রামকে সহমর্মিতা ও ঐক্যের এক প্রতিমূর্তি বললেও ভুল বলা হতো না। কিন্তু সময়ের স্রোতে পিচ ঢালাইয়ের রাস্তা, ঘরে ঘরে বৈদ্যতিক বাতি আর কাঁচা টাকার প্রাচুর্য- এই সব থাকলেও গ্রামের প্রাণটাই যে হারিয়ে যেতে বসেছে!
কারোর সঙ্গে কারোর যোগাযোগ নেই। এক সময় যে গ্রাম বৃহত্তর পরিবারের অংশ হয়ে উঠেছিল সেই গ্রামের এক পাড়া বা মহল্লাতেই দেখা গেল ১০ গ্রুপ। মোড়ের চায়ের দোকানে বড় পর্দায় ওয়াজের রেকর্ড চলছে, অথচ পাশে বসেই চলছে যত অধর্মের কাজ! গীবত আর দলাদলিতে নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ কেউ কারোর চেয়ে পিছিয়ে নেই।
এক দশক আগেও যে গ্রামে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঈদগাহ মাঠে ছুটে আসতেন ধর্মপ্রাণ মুসুল্লীরা, প্রবীণরা যেতেন অগ্রভাগে, কনিষ্টরা পেছনে। গোরস্তানগুলোতে দেখা যেত জিয়ারতের হিড়িক। কয়েক বছরের মতো এবারও গ্রামে গিয়ে দেখা গেল না এসবের কিছুই। শিমুলতলা কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে জড়ো হতেন পুরো গ্রামের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। এবার দেখা গেল পাড়ায় পাড়ায় ১৫-২০ জনে ঈদ জামাত! কেবল যে শিমুলতলায় এ প্রবণতা তাও নয়, ফেইসবুকের কল্যাণে পাশের গ্রাম গলদাপাড়ায় একটি ছবি প্রকাশ্যে এসেছে, যাতে দেখা গেল জনাকয়েক মুসুল্লী বসে আছেন ঈদের নামাজ আদায় করতে। ফেইসবুকের সেই পোস্টের নীচে অনেকের কমেন্টের যা সারমর্ম তা হচ্ছে-গ্রাম হারিয়েছে তার ঐতিহ্যিক পরম্পরা।
এবার গ্রামে গিয়ে দ্বিধা-বিভক্ত এই উৎসবের গ্লানির মাঝেই ঈদের দিন রাত থেকে পরবর্তী দুই দিন অবস্থান করে যে অভিজ্ঞতা হল তাকে এক রকম নরকবাস বলাই সঙ্গত। সন্ধ্যা রাত থেকে ডিজের তালে তালে এত বিকট সাউন্ডবক্সের আওয়াজ ভেসে আসতে থাকল চারদিক থেকে যে সবকিছু যেন কেঁপে উঠছিল। নগরের যান্ত্রিক জীবনের ভয়ানক শব্দদূষণের নাকাল থেকে কিছু সময়ের জন্য রক্ষা পেতে উৎসবের সময়টাতে গ্রামে যায় শহরের মানুষেরা। সেখানে শান্তিতে কাটানোর বদলে এই নরকযন্ত্রণা দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হয়ে থাকল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পর পর দুই রাত সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত চলা এই উন্মত্ততায় বাহারি মাদকের অবাধ বেচাকেনাও চলেছে। ইয়াবা থেকে চোলাই মদ কিংবা স্বাস্থ্যহানিকর এনার্জি ড্রিংকসের মোড়কে যৌন উত্তেজক পানীয়-সবই ছিল সেই ডিজে পার্টির অনুষঙ্গ।
লক্ষণীয় হল, গ্রামের তরুণদের নেতৃত্বে এই অসুস্থ উন্মত্ততা ঠেকাতে খোদ অভিবাবকদের ছিল না কোন হেল-দোল! স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা পুলিশের পক্ষ থেকেও কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। ঈদ পরবর্তী ওই দুই রাত্রিতে অসুস্থ, শিশু কিংবা পাখি বা বন্যপ্রাণিদের কি অবস্থা হয়েছে তা ভেবে রীতিমতো শিউরে উঠেছি। জীবদ্দশায় পূর্বে কখনোই এমন নিয়ন্ত্রণহীন সমাজ দেখিনি। মনে প্রশ্ন জেগেছে, তবে কি সমাজের স্থিতিশীলতা ও মূল্যবোধ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে?
নগর সভ্যতাকেন্দ্রিক সময়ের মাঝেও গ্রামকে ঘিরে আবেগের এতটুকু খামতি নেই কারোর মধ্যে। ব্যক্তিজীবনে কি সাহিত্যে সবখানেই গ্রামের উপস্থিতি সগৌরবে উজ্জ্বল। এই গ্রাম নিয়ে রাজনীতির ময়দানেও কম চর্চা হয় না। ‘আটষট্টি হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’-দেশের একটি রাজনৈতিক দলের এমন স্লোগানও অনেক পুরনো। ইট-পাথরের শহুরে জীবনে হাঁপিয়ে উঠা মানুষেরা শ্যামল গ্রামের নির্মল বায়ুতে অবগাহনে ব্যাকুল হয়ে উঠেন। নগরের কর্মব্যস্ত মানুষদের জন্য গ্রামে যাওয়ার একটা বড় উপলক্ষ্য তৈরি হয় উৎসবের সময়গুলোকে ঘিরে।
বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময় উৎসবে যোগ দিতে যাঁরা গ্রামে ছুটেন তাদের কাছে যাত্রাপথের যেকোনো বাধাই যেন তুচ্ছ নয়। পথের যানজট-দুর্ঘটনা সঙ্গী করে গ্রামে পৈত্রিক ভিটের এক টুকরো মাটি স্পর্শ করার মাঝেই যেন সবটুকু তৃপ্তি মিশে থাকে। বাবা-মা, দাদা-দাদী, আত্মীয়-স্বজন আর গ্রামে পরিচিতজনদের সঙ্গে বছরের নির্দিষ্ট সময়ের ওই সাক্ষাৎ ঘিরে চলতে থাকে কত পরিকল্পনা। কারোর হয়ত বাবা-মা বেঁচে নেই, কিন্তু নির্জন গোরস্তানে তাদের কবর জিয়ারত করে অশ্রুতে চোখ ভেজানোর মাঝেও যে এক পরম শান্তির সন্ধান করা, তা আমাদের জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।
কিন্তু বর্তমানে এসে উৎসবের চিরকালীন এই আনন্দ ও পরিচিতজনদের আবেগের ঐকতান ফিকে হয়ে যাওয়া এক বিরাট অশনি সঙ্কেত। আমরা জানি না, পরিবর্তনের স্রোতে গ্রামের এই অধঃপতন কিভাবে রোধ করা যাবে? কিভাবে গ্রাম তার হৃতগৌরব ফিরে পাবে? প্রবল বর্ষণ মাথায় নিয়ে যখন ঢাকায় ফিরে আসছিলাম, তখনও অবচেতনে কানে ডিজে পার্টির বিকট শব্দ যেন দংশন করছিল। কেবলই ভাবছিলাম, সুস্থ গ্রামীণ সংস্কৃতিকে অবহেলায় ঠেলে দিয়ে আমদানি করা এই ‘নরক যন্ত্রণা’ কিভাবে প্রসার লাভ করলো? এর দায় কি আমরা এড়াতে পারি? রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে আশ্রয় করে বলতেই হবে, ‘কার নিন্দা করো তুমি এ আমার এ তোমার পাপ’।