রাষ্ট্র ও সরকারে একই ভূত বিরাজমান

, যুক্তিতর্ক

মযহারুল ইসলাম বাবলা | 2024-06-30 21:01:24

আমাদের আমলাতন্ত্র নির্ভর ও শাসিত সরকারের শাসনামলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা এবং বেসরমারিক আমলাদের আরব্য রজনীর মতো অর্থবিত্ত, সম্পদের সংবাদগুলো আমাদের ক্রমাগত হতবাক করে দিচ্ছে। দু’চারজনের সংবাদেই আমাদের বুঝে নিতে কষ্ট হচ্ছে না, পুরো আমলাতন্ত্র এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের লাগামহীন দুর্নীতির এবং অর্থ লুণ্ঠনের বিষয়াদি। সাবেক আইজি’র বিষয়ে একটি দৈনিকে তার অর্থ সম্পদের তালিকা প্রকাশের ফলে তথাকথিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন বাধ্য হয় তদন্ত করে মামলা দায়ের করতে। অথচ যার বিরুদ্ধে অর্থবিত্তের, সম্পদের পর্বত সমেত অভিযোগ তিনি নির্বিঘ্নে অর্থকড়ি গুছিয়ে দেশ থেকে ভিন দেশে পাড়ি দিয়েছেন। তাকে কোনোরূপ বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। তার অবর্তমানে কিছুদিন লেখালেখির পর বিষয়টি অন্যান্য বিষয়ের মতো আমাদের স্মৃতি থেকে লোপাট হয়ে যাবে। যেমনটি এ যাবৎ কালের রোমহর্ষক ঘটনাগুলো হারিয়ে গেছে। অপরাধীরা নিরাপদ এবং নির্বিঘ্ন জীবন-যাপন করছেন। আইজি সাহেবের পলায়নের ঘটনার পর ক্রমশ গণমাধ্যমে সেটা প্রায় চাপা পড়েছে।

গত কুরবানি ঈদে ১৫ লক্ষ টাকায় খাসি কেনার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এবং কুরবানিতে কোটি কোটি টাকার পশু কুরবানি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ঝড় ওঠে। ইফাত নামক ছেলেটির ১৫ লক্ষ টাকার ছাগল কেনার ঘটনার পর একে একে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মতিউর রহমানের পুত্র ইফাতের ছাগল কেনার সূত্র ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট এবং রাষ্ট্রায়াত্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালক মতিউর রহমানের অবৈধ পন্থায় অর্থবিত্ত, সম্পদের বিবরণের খতিয়ান সম্প্রতি দেশজুড়ে তোলপাড় করছে। দুই স্ত্রী’র নরসিংদী ও ফেনিতে সম্পদের পরিমাণ এবং অবকাঠামোগুলোও নজিরবিহীন। করোনায় আক্রান্ত মতিউর দ্বিতীয় স্ত্রীকে খালি চেক স্বাক্ষর করে দেয়। ওই চেকের মাধ্যমে তিনশত কোটি টাকা দ্বিতীয় স্ত্রী’র হাতিয়ে নেবার সংবাদও গণমাধ্যমে এসেছে। কোটি কোটি টাকা মূল্যের গাড়ির বহর। রাজকীয় জীবনাচার। প্রথম স্ত্রীকে কলেজের অধ্যাপনা থেকে ছাড়িয়ে অর্থের জোরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বসানো ইত্যাদি ঘটনাগুলো রূপকথাকেও হার মানায়। দেশের অর্থ বিদেশে পাচার এবং কানাডায় আমলাদের স্ত্রীদের নামে বাড়ি কেনার হিড়িকে কানাডায় বাংলাদেশি নারীদের মালিকানার বাড়িগুলোকে ‘বেগম পাড়া’ হিসেবে গত ক’বছর ধরে প্রচারণা চলছে। মতিউরের ক্ষেত্রেও কানাডায় সম্পদ ক্রয়ের এবং সন্তানদের সেখানে পাঠিয়ে দেবার ঘটনাও প্রকাশ পেয়েছে। এখনও মতিউর অধরা। তবে তার অবৈধ সম্পদের খোঁজে তিন সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে দুদক। এখনো স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছেন, আগের মতোই। নিজেকে রক্ষা করতে ইফাতকে ছেলে হিসেবে অস্বীকার করার ন্যায় ঘৃণিত মিথ্যাচার করতেও দ্বিধা করেনি।

প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অবাধ লুণ্ঠন অনাচারের যে চিত্র জনসমক্ষে ক্রমাগত প্রকাশ পাচ্ছে। তাদের বিষয়ে সরকারের উপেক্ষার কারণ কী! কারণ আমরা জানি এই সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনায় এনেছে এবং রেখেছে আমাদের দুই আমলাতন্ত্র এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এটা জলের ন্যায় পরিষ্কার। তাই সরকার আমলাদের বিরুদ্ধে তাদের অপরাধের বিষয়ে নিশ্চুপ থেকে পক্ষান্তরে ওই অনাচার-দুর্নীতিকেই পক্ষান্তরে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সরকার সংশ্লিষ্টরাও ধোয়া তুলসি পাতা নয়। তাদের অবাধ লুণ্ঠন, দুর্নীতিও আকাশ ছোঁয়া। অর্থাৎ আমাদের শাসকশ্রেণি সম্পূর্ণ রূপে দুর্নীতিতে, লুণ্ঠনে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। কে কাকে আটকাবে! রাষ্ট্র এবং সরকার দুটি আলাদা সত্তা। রাষ্ট্র স্থায়ী কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকার ৫ বছর মেয়াদি। জনগণ নির্ধারণ করে কোন দল রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। সেটা নির্বাচনে নির্ধারিত হয়। এটাই বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিধি ব্যবস্থা। বাস্তবে আমাদের দেশে ওই ব্যবস্থা কার্যকর নেই বরং উপেক্ষিত। তাই রাষ্ট্রযন্ত্রে এবং সরকারে অর্থাৎ পুরো শাসকশ্রেণির অভ্যন্তরে নেই স্বচ্ছতা, নেই জবাবদিহিতা, নেই নিয়ন্ত্রণ। আর কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সবাই তো অভিন্ন পথযাত্রী। সর্ষে ভূত থাকলে তো সর্ষে দিয়ে ভূত ছাড়ানো যায় না। আমাদের শাসকশ্রেণির দশা ঠিক তেমনই। একের পর এক আমলা, পুলিশ, সরকারি দলের রাজনীতিকদের রোমহর্ষক দুর্নীতি, অর্থ লুণ্ঠনের ঘটনা ফাঁস হবে। গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হৈ চৈ হবে। আরেকটি ঘটনা আগের ঘটনাকে চাপা দিয়ে দেবে। একের পর এক ঘটতে থাকা ঘটনায় আর কত প্রতিক্রিয়ামুখর থাকবে মানুষ এবং গণমাধ্যম! আগে নৈতিক পথে উপার্জন এবং অনৈতিক পথে উপার্জন নিয়ে সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যেত। এখন সেটা দেখা যায় না। কে কিভাবে, কোন উপায়ে হঠাৎ সম্পদশালী, বিত্তবান হয়ে উঠলো এ নিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বান্দ্বিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। বরং বলা হয় তিনি ভাগ্যবান আল্লাহর ইচ্ছায় এবং আশীর্বাদে তার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে।

কাগজের মুদ্রা-টাকার যে রঙ রয়েছে, সেটা আমাদের সকলেরই জানা। পরিমাণ ভেদে টাকার রঙও ভিন্ন ভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। এই রঙ বৈচিত্র্যপূর্ণ তো বটেই এবং বহু রঙের সমাহারে। টাকাকে দুই পৃথক রঙে বিভক্তিকরণের সামাজিক আচার ছিল এবং আছেও। বর্ণিল রঙের এই টাকাকে আমাদের সমাজে সচরাচর সাদা-কালো দুই পৃথক রঙে চিহ্নিত করার অলিখিত নিয়ম প্রচলিত ছিল এবং রয়েছে। সেটা বহুকাল-যুগ পূর্ব থেকেই। অতীতে সামাজিক মান-মর্যাদার প্রশ্নটিও প্রচলিত টাকার রঙের ওপর নির্ভর করতো। অর্থাৎ ব্যক্তির অর্থ বৈধ না অবৈধ সেটা নির্ধারিত হতো ব্যক্তির অর্থ বা টাকা সাদা না কালো নির্ধারণের ভিত্তিতে। হঠাৎ বিত্তবান ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কিংবা আয়ের সঙ্গে সম্পদ ও ব্যয়ের অসঙ্গতিতে সামাজিক জীবনে ওই ব্যক্তিকে নিয়ে মানুষের কৌতূহল সৃষ্টি হতো। জন্ম দিত নানা জল্পনা-কল্পনার।

আমার কৈশোরের একটি ঘটনা স্মরণ করছি। সরকারি উদ্যোগে পাকিস্তান সরকার কয়লা আমদানি করতো, কয়লা নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তর নামের সরকারি প্রতিষ্ঠান ছিল। আমদানিকৃত সে কয়লা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বার্জ যোগে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে পরিবহনে বেসরকারি ঠিকাদার নিয়োগ করা হতো। বার্জে করে কয়লা পরিবহনের জনৈক ঠিকাদার আমাদের এলাকায় বসবাস করতেন। হঠাৎ ব্যক্তিটির অস্বাভাবিক আর্থিক উন্নতিতে কৌতূহলী স্থানীয়দের মধ্যে এক প্রকার সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রমাণ যোগ্য তথ্যের অভাবে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলেনি। সেজন্য অবশ্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। অচিরেই ঠিকাদারের বাড়িতে পুলিশ এসে ঠিকাদারকে ধরে নিয়ে যায়। ঠিক দুইদিন পর কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে ঠিকাদার বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু প্রকৃত রহস্য আর চাপা থাকেনি। দ্রুত সেটা পুরো এলাকায় চাউর হয়ে গিয়েছিল। ঠিকাদার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় কয়লা পরিবহনের জন্য ১৪টি বার্জে কয়লা ভর্তি করে ঢাকার পরিবর্তে অন্যত্রে কয়লা নামিয়ে পাচার করে এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে জানায় কয়লাসহ পরিবহনকৃত ১৪টি বার্জ নদীতে ডুবে গেছে। সরকারি পণ্য তসরুপের অভিযোগে ঠিকাদারকে আটক করে পুলিশ। তবে তার দ্রুত অব্যাহতিতে মজার কথাও প্রচার পেয়েছিল। তার এই অপকীর্তির সঙ্গে সরকারি দফতরের লোকজনও জড়িত ছিল। এমন কি বার্জ ডুবেছে কিনা সেটা তদন্তে সরকারি দফতর যাদের নিয়োগ করেছিল; ঠিকাদার ও সরকারি কয়লা নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা দ্রুত তাদের বখরা দিয়ে সমঝোতা করে ফেলে। পরিশেষে তদন্ত নাটকের যাবনিকা এবং ঠিকাদার বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। তবে ঠিকাদারের প্রতিষ্ঠানকে কয়লা পরিবহনের কাজ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়। শাস্তি কেবল এটুকুই তিনি পেয়েছিলেন।

সামাজিক ভাবে এলাকায় তিনি ‘কয়লা চোর’ খ্যাতি কিন্তু লাভ করেন। এমন কি তার সন্তানেরা পর্যন্ত কয়লা চোরের খ্যাতি মাথায় নিয়ে নত মুখে এলাকায় চলাচলে বাধ্য হয়। তাদের একতলা বাড়ি দ্রুত চারতলায় রূপান্তরিত হয়। এবং এলাকায় বাড়ি, জমি-সম্পত্তি কেনায় যেন ঠিকাদারের হিড়িক পড়েছিল। স্থানীয় কাউকে বাড়ি-সম্পত্তি বিক্রি করতে আর দালালের শরণাপন্ন হতে হতো না। বিক্রেতা স্বয়ং ঠিকাদারের নিকট হাজির হলেই ন্যায্যমূল্যে বাড়ি-সম্পত্তি বিক্রি করতে পারতো। এতে এলাকায় ঠিকাদারের সম্পত্তির পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। সেই পাকিস্তানি আমলে রিক্শাযাত্রী ঠিকাদার-পরিবার রিক্শার পরিবর্তে মাজদা গাড়ি হাঁকায়। অর্থ-বিত্ত, সম্পত্তি বৃদ্ধিতেও কিন্তু সামাজিক মর্যাদা তাদের বৃদ্ধি পায়নি। বরং কয়লা চোরের নামকরণে তাদের কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সামাজিক মর্যাদা পুনরুদ্ধারে মসজিদ-মাদ্রাসায় অঢেল অর্থ প্রদান করে সমাজে নিজেকে মর্যাদাবান রূপে প্রতিষ্ঠার কৌশলী উদ্যোগ ঠিকাদার গ্রহণ করেছিল। এই কৌশলটি তার অপবাদ ঘুচাতে সহায়তা করেছিল বটে, তবে প্রকাশ্যে না হলেও নেপথ্যে ঠিকাদারের কুখ্যাতির গুঞ্জন কিন্তু একেবারে বিলুপ্তি ঘটেনি। সেটা বহুকাল টিকে ছিল।

টাকার রঙ নিয়ে সমাজে এখন আর উচ্চ-বাচ্য কেউ করে না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে করা হয় মাত্র। শর্তাধীনে সে ক্ষেত্রে পরিত্রাণের সুযোগও করে দেয় স্বয়ং রাষ্ট্রই। আয় বহির্ভূত অর্থকে আয়ভুক্ত বা বৈধতা প্রদান করার সুযোগ দেয়া হয়, রাষ্ট্রকে অর্থদণ্ড প্রদানে। অর্থাৎ কালো টাকাকে সাদায় রূপান্তরিত করার রাষ্ট্রীয় স্বাভাবিক (!) ব্যবস্থাধীনে। তাই এখন টাকার পরিমাণগত রঙই টাকার পার্থক্য নির্ধারণ করে, সাদা-কালোর বিভাজনে নয়। টাকা এখন টাকাই, সে যে উপায়ে অর্জিত হোক না কেন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভে বাধাপ্রাপ্ত হয় না। ঘৃণা-ধিক্কারের যোগ্যও থাকে না, বিপরীতে পায় নিষ্কণ্টক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্বীকৃতি। এতে করেই সমাজে ও রাষ্ট্রে অবৈধ পন্থা অবলম্বনকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও হয় কে কত বেশি অনৈতিক পন্থা গ্রহণে অর্থশালী হতে পেরেছে। আমাদের রাষ্ট্রের তথাকথিত সেবকগণ এবং রাজনীতিকরা ওই একই পথের যাত্রী হিসেবে জনগণের উপার্জিত অর্থ হাতিয়ে বিত্তশালী হচ্ছে, বিদেশে অর্থ পাচার করে চলেছে। যতদিন জনগণের সরকার দেশে প্রতিষ্ঠা না পাবে; ততোদিন এই লুণ্ঠন প্রক্রিয়া থামবে বলে অনুমান করা যাচ্ছে না।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

এ সম্পর্কিত আরও খবর