রাখাইনে সংঘাত ও সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ পরিস্থিতি



ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.)
ছবি: বার্তা২৪, ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.)

ছবি: বার্তা২৪, ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.)

  • Font increase
  • Font Decrease

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চলমান যুদ্ধের কারণে গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জনপদে অনেকদিন ধরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং এলাকার জনগণ আতঙ্কে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরের সংঘর্ষের কারণে ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের ভেতরে গোলা এসে পড়ে ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। বর্তমানে এই গোলাগুলির ঘটনা স্থলভাগ থেকে জলসীমার দিকে বিস্তৃত হচ্ছে যা অনাকাঙ্ক্ষিত। রাখাইন রাজ্যের এই অশান্ত পরিস্থিতি শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।

আরাকান আর্মি (এএ) বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে রোহিঙ্গা–অধ্যুষিত বুথিডং শহরের দখল নিয়েছে এবং রাখাইনের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে।

১৭ জুন মংডু টাউনশিপের ঘাঁটিগুলো দখলে নিতে সেখানকার বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে আরাকান আর্মি (এএ)। মিয়ানমারের মানবাধিকারবিষয়ক উপমন্ত্রী অং কিয়াও মো জানান যে, রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে। মংডু শহরে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা আটকা পড়েছেন এবং সংঘাতের কারণে তারা শহর ছেড়ে যেতে পারছেন না।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে আরাকান আর্মি (এএ)-কে ঘিরে ধরার চেষ্টা করছে। মংডুর অবস্থান নাফ নদীর কাছে হওয়ায় সেখানে আক্রমণে সহায়তার জন্য নাফ নদীতে যুদ্ধ জাহাজগুলো অবস্থান নিয়েছিল।

মিয়ানমার নৌবাহিনী নাফ নদীতে আরাকান আর্মি (এএ)-র উপস্থিতি এবং বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য প্রবেশ বন্ধে অবস্থান নিয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।

মিয়ানমার নৌবাহিনীর একাধিক যুদ্ধজাহাজ সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপের কাছাকাছি মিয়ানমারের সমুদ্রসীমায় এবং নাফ নদীর মিয়ানমার সীমানায় অবস্থান অপারেশন পরিচালনা করছে এবং মিয়ানমারের দিকে আরাকান আর্মি (এএ)-র অবস্থান লক্ষ করে গোলাবর্ষণ করছে। একইসঙ্গে আরাকান আর্মিও (এএ) মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজ ও বোট লক্ষ করে গোলাবর্ষণ করে।

চলমান পরিস্থিতিতে, ৫ জুন সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপ থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রলারে মিয়ানমারের অভ্যন্তর থেকে গুলি করা হয়। এতে ট্রলারটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কেউ অবশ্য হতাহত হননি।

এরপর পণ্যবাহী ট্রলারেও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। পর পর কয়েকদিন এই ধরনের ঘটনার কারণে সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ ১০ দিন ধরে বিচ্ছিন্ন থাকায় টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপে যাতায়াত, যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে সেখান বসবাসরত প্রায় ১০ হাজার মানুষ নিরাপত্তাহীনতাসহ খাদ্য সংকটে পড়েন।

মিয়ারমার থেকে গোলাগুলির কারণে জেলেদের সাগরে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যায়। দ্বীপে অনেক দিন ধরে নিয়মিত খাদ্যপণ্য সরবরাহ না থাকায় জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যায়। সংকটে থাকা দ্বীপের বাসিন্দাদের জন্য ১৪ জুন কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপে জাহাজে করে মালামাল পৌঁছে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের নৌযানগুলিতে কারা গুলি করেছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে মিয়ানমার সরকার গুলি করার ব্যাপারটি অস্বীকার করেছে। এই ঘটনায় আরাকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী পরস্পরকে দায়ী করে।

টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপে চলাচল করা বাংলাদেশের নৌযানগুলিকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু করে এই গুলির ঘটনা ঘটে যে, আতঙ্ক ছড়ানোর জন্যই এসব করা হচ্ছে, তা বোঝাই যাচ্ছে।

সে সময় নাফ নদীতে মিয়ানমার নৌবাহিনীর একটি জাহাজ অবস্থান করছিল। ১৫ জুন নাফ নদীর মিয়ানমার অংশ থেকে যুদ্ধজাহাজগুলো গভীর সাগরের দিকে সরে যায় এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনী বাংলাদেশ জলসীমায় টহল শুরু করে। মিয়ানমার থেকে গুলি ছোড়ার পর কয়েকদিন সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপে পণ্য সরবরাহে বাধার সৃষ্টি হলেও এখন কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

বাংলাদেশের পর্যটনের আকর্ষণীয় স্থান সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপ

বাংলাদেশের পর্যটনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি হলো সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপ। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে নয় কিলোমিটার দক্ষিণে নাফ নদীর মোহনায় এ দ্বীপটি অবস্থিত।

সেন্টমার্টিন’স দ্বীপটি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার একটি ইউনিয়ন। এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ এবং এর আয়তন ১ হাজার ৯শ ৭৭ একর। সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপে চলাচলের সময় বাংলাদেশের নৌযানে গুলির ঘটনায় মিডিয়া বেশ সরব হয়েছে। চলমান ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এর ফলে আরাকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী উভয়েই গুরুত্ব পেয়েছে। এতে বেশি লাভ হয়েছে আরাকান আর্মির (এএ)। তারা সংবাদমাধ্যমের ফোকাসে আসতে পেরেছে।

সেন্টমার্টিন’স দ্বীপের নিরাপত্তা
এই ঘটনার পর সেন্টমার্টিন’স দ্বীপবাসী খাদ্য সমস্যা ও আতঙ্কে ভুগছেন; পর্যটক আসা বন্ধ হয়ে গেছে। একটি শ্রেণি সেন্টমার্টিন’স দ্বীপের নিরাপত্তা নিয়ে নানান ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে।বাংলাদেশের নৌযান লক্ষ করে মিয়ানমারের দিক থেকে চালানো গুলির ঘটনায় সেন্টমার্টিন’স দ্বীপে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সমস্যা ও ভয় এখনও পুরোপুরি কাটেনি।

মিয়ানমারের দিক থেকে যেকোনো পক্ষের আক্রমণ প্রতিহত এবং এর বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণের কথা বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সীমান্তে চলা সহিংসতার দিকে নজর রাখছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ড। এ বিষয়ে সজাগ রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও। এ ব্যাপারে তারা প্রস্তুত রয়েছে এবং পরিস্থিতি খারাপ হলে যথাযথ ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।

১৬ জুন (২০২৪) আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় যে, মিয়ানমারে চলমান অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি (এএ)-র বিরুদ্ধে যৌথ অপারেশন পরিচালনা করছে।

মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মি (এএ)-র এই সংঘর্ষের কারণে নাফ নদী ও নদীসংলগ্ন মোহনা এলাকায় বাংলাদেশি বোটের ওপর অনাকাঙ্ক্ষিত গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ১২ জুন প্রতিবাদ জানায়। বাংলাদেশ তার ভূমির অখণ্ডতা রক্ষায় সবসময় প্রস্তুত এবং আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ করতে সক্ষম। বাংলাদেশ মিয়ানমারের যেকোনো পক্ষ থেকে বাংলাদেশের নৌযানের দিকে গুলি করলে পাল্টা গুলি ছোড়ার কথা জানানো হয়েছে।

মিয়ানমারের গোলা সেন্টমার্টিন’স দ্বীপে পড়ার বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সংঘাত এড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ আক্রান্ত হলে সেই আক্রমণের জবাব দিতে বাংলাদেশ প্রস্তুত।

বাংলাদেশ সীমান্তে বর্ডার গার্ড ও কোস্ট গার্ড আছে। তারা পুরো সীমান্ত এলাকায় তদারকি করছে ও সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে। শুধু সেনাবাহিনীই নয়, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীও প্রস্তুত রয়েছে। সীমান্ত পরিস্থিতি পুরোপুরি বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে কোস্ট গার্ড ও বিজিবি তাদের দায়িত্ব পালন করছে এবং যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা প্রস্তুত।

সেন্টমার্টিন’স দ্বীপের কাছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটা যুদ্ধ জাহাজ সব সময় স্ট্যান্ডবাই থাকে। বিজিবি, নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ড ও সেখানে নিয়মিত টহল দেয়। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে যাতে সীমান্তে কোনো বাংলাদেশি আক্রান্ত না হন, সেজন্য দেশটির সরকার ও বিদ্রোহীদের সঙ্গে কথা হয়েছে বলেও জানান বিজিবি মহাপরিচালক।

বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মি (এএ)-র মধ্যে সংঘটিত লড়াইয়ের সময় দুই পক্ষের গোলাগুলি সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভেতরে এসে পড়ে এবং সীমান্তবর্তী জনগণের জন্য অনিরাপদ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যা কখনোই কাম্য নয়।

আরাকান আর্মি (এএ)-র আক্রমণে টিকতে না পেরে মিয়ানমারের বেশকিছু সেনা ও সীমান্তরক্ষী সদস্য পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশ আলোচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন মেনে আশ্রয় নেওয়া সব সদস্যকে মিয়ানমার সরকারের কাছে হস্তান্তর করে।

চলমান সংঘাতে মিয়ানমারে সেনাশাসন বহাল থাকলেও সামনের দিনগুলোতে রাখাইন রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আরাকান আর্মি (এএ) তাদের অবস্থান ধরে রাখবে। রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন এখনো চলছে। সম্প্রতি, বুথিডং ও মংডুতে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ কাজের জন্য আরাকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী পরস্পরকে দোষারোপ করলেও এটা যে আরাকান আর্মি (এএ)-ই করেছে বলে অনেকে মনে করেন।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের প্রত্যাশা
মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি হোক, এটা-ই চায়। চলমান পরিস্থিতিতে আরাকান আর্মি (এএ) সংগঠিত এবং রাখাইনে তাদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

চলমান গৃহযুদ্ধ শেষে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ কোনো চুক্তি করলেও আরাকান আর্মি (এএ)-র সহযোগিতা ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব নাও হতে পারে।

এই সংকট সমাধানে সংশ্লিষ্ট সবার অনানুষ্ঠানিকভাবে আরাকান আর্মি (এএ)-র সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। আরাকান আর্মি (এএ) নিজেদেরকে জান্তা সরকারের চাইতে রোহিঙ্গাদের প্রতি নমনীয় বলে প্রচার করে এসেছে, এটা তাদের প্রমাণ করার এখনই সময়। তবে রোহিঙ্গারা চলমান পরিস্থিতিতে তেমন কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না। সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মি (এএ)-র মধ্যকার চলমান সংঘর্ষে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থেমে আছে। রোহিঙ্গারা যেন আরাকান আর্মি (এএ)-র বিপক্ষে কোনো দলে যোগ দিতে না পারে, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

কৌশলগত প্রাধান্যে সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ
বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরকে ঘিরে কৌশলগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দ্বীপ।

সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ বাংলাদেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা দরকার বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।

আরাকান আর্মি (এএ)-কে মোকাবিলায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ ও তার সংলগ্ন এলাকায় মিয়ানমারের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে। আরাকান আর্মিও (এএ) মিয়ানমারের দিক থেকে গুলি করেছে। এই গুলি বিনিময়ের ঘটনা সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ দখল করার জন্য নয় বরং বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তারা এ কাজ করেছে বলে অনেকে মনে করেন।

চলমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমার কিংবা আরাকান আর্মি (এএ)-র জন্য সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ দখলের চেয়ে রাখাইন রাজ্য ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় তাদের দখলকৃত ভূমি সুরক্ষা ও সেখানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই জরুরি। তবে বাংলাদেশকে প্রতিবেশী এই দেশের এ অশান্ত পরিস্থিতির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে!

ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফ ডব্লিউসি, পিএস সি, এম ফিল (অব.), মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক

বাংলাদেশে সামাজিক শ্রেণির পরিবর্তনের চিত্র



মোঃ বজলুর রশিদ
মোঃ বজলুর রশিদ, ছবি: বার্তা২৪.কম

মোঃ বজলুর রশিদ, ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সমাজবিজ্ঞানে সামাজিক শ্রেণি হলো সমাজের একটি স্তরবিন্যাস যা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে তাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান, শিক্ষা, পেশা, আয়, সম্পদ, শক্তি এবং সামাজিক মর্যাদার ভিত্তিতে বিভক্ত করে। বাংলাদেশে, সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারণগুলির দ্বারা প্রভাবিত। জমি, সম্পদ এবং ক্ষমতার অসম বণ্টন সমাজে স্পষ্ট শ্রেণিগত বিভাজন তৈরি করেছে।

মার্কসবাদে, সামাজিক শ্রেণি হলো উৎপাদনের উপায়ের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ভিত্তিতে সমাজের একটি স্তরবিন্যাস। মার্কস এবং এঙ্গেলস এর মতে, শ্রেণি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ভূমিকা এবং উৎপাদিত সম্পদের নিয়ন্ত্রণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়।

বাংলাদেশের সমাজের বহুমাত্রিক চিত্র একটি জটিল এবং পরিবর্তনশীল দৃশ্যপট যা অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে গঠিত। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের সামাজিক শ্রেণি কাঠামোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। একসময়ের কঠোর ঔপনিবেশিক শ্রেণিবিন্যাস একটি আরও তরল সামাজিক কাঠামো দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। সামাজিক শ্রেণির গঠন, যা আয়, শিক্ষা, পেশা, পারিবারিক পটভূমি এবং সম্পদের ওপর নির্ভরশীল, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন রূপ পেয়েছে।

বাংলাদেশের সমাজে একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান। তৈরি পোশাক শিল্পের সাফল্য, পরিষেবা খাতের বিকাশ এবং বিদেশ থেকে রেমিট্যান্সের অবিরাম প্রবাহ মধ্যবিত্ত শ্রেণির সম্প্রসারণকে ত্বরান্বিত করেছে। এই নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির সদস্যরা জীবনের মান উন্নত করতে এবং তাদের সন্তানদের জন্য উন্নত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের ক্রমবর্ধমান ক্রয় ক্ষমতা দেশের অর্থনীতিতে নতুন পণ্য ও সেবার চাহিদা সৃষ্টি করে, যা সমগ্র অর্থনৈতিক পরিবেশকে গতিশীল করে।

অন্যদিকে, শ্রমিক শ্রেণির একটি বড় অংশ এখনও দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে এবং মৌলিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে লড়াই করছে। শহুরে বস্তি এবং অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা লোকেরা অস্থায়ী চাকরি এবং ন্যূনতম মজুরির বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এই দুর্বলতা, দ্রুত নগরায়নের ফলে আরও বাড়িয়ে তোলা, শ্রমিক শ্রেণির মানুষের জীবনে চ্যালেঞ্জের স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে। তারপরও তাদের স্থিতিস্থাপকতা এবং উন্নতির স্বপ্ন হারায়নি। সরকারি উদ্যোগ এবং বাজারের প্রবৃদ্ধির কারণে গ্রামীণ এলাকার পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হলেও ভূমি সংস্কারের অসম্পূর্ণতা এখনো অনেকের জীবনে প্রভাব ফেলে চলেছে।

বাংলাদেশের অভিজাত শ্রেণিও পরিবর্তিত হয়েছে। একসময়ের জমিদারদের পরিবর্তে, এখন এই শ্রেণিতে সফল উদ্যোক্তা, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এবং উচ্চ পদস্থ পেশাদাররা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যারা দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের একটি বিশাল অংশ দখল করে রেখেছে। তাদের প্রভাব ও প্রাচুর্য দেশের অন্যান্য শ্রেণির সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব তৈরি করতে পারে, যা সম্পদের বৈষম্য এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন একটি অভিজাত শ্রেণির উদ্ভব ঘটাতে পারে।

শ্রেণিবিন্যাসের এই পরিবর্তনের পাশাপাশি, শিক্ষার গুরুত্বও বাড়ছে। উচ্চ শিক্ষা ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ হিসাবে কাজ করে। প্রযুক্তি এবং ক্ষুদ্রঋণে প্রবেশ উদ্যোক্তা মনোভাবকে উৎসাহিত করছে, যা ব্যক্তি ও পরিবারের জন্য উন্নতির নতুন পথ তৈরি করছে। ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রথাগত সীমানা ধ্বংস করছে, নতুন ধারণা এবং জীবনধারার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।

এছাড়া, বাংলাদেশি সমাজে পুরুষ এবং মহিলাদের অভিজ্ঞতা উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন। পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম প্রায়শই নারীদের শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানে প্রবেশাধিকার সীমিত করে, যা তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং সামাজিক গতিশীলতা বাধাগ্রস্ত করে। তবুও নারীরা ঐতিহ্যগত ভূমিকা চ্যালেঞ্জ করছে এবং পোশাক ও পরিষেবা খাতে তাদের সাফল্যের পথ তৈরি করছে, যা সমাজে লিঙ্গগত গতিশীলতায় নতুন পরিবর্তন আনছে।

বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক ও বহু-ধর্মীয় দেশ হওয়ায় জাতি এবং ধর্মের প্রভাবও সামাজিক অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করে। প্রভাবশালী বাঙালি জাতিসত্তা বিশেষাধিকারের একটি অবস্থান উপভোগ করে, যখন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা প্রান্তিকতা এবং সম্পদের সীমিত অ্যাক্সেসের সম্মুখীন হতে পারে। ধর্মীয় অনুষঙ্গও সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং সুযোগগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে।

আঞ্চলিক বৈষম্যও বাংলাদেশের সামাজিক শ্রেণি গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। নগর কেন্দ্রগুলোতে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকার তুলনায় বেশি অর্থনৈতিক সুযোগ এবং সামাজিক সেবা রয়েছে। এই বৈষম্য সামাজিক বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে এবং শহুরে ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশে সামাজিক শ্রেণির জটিলতা বোঝার জন্য এর বহুমুখী প্রকৃতিকে স্বীকার করা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক কারণগুলি প্রধান ভূমিকা পালন করলেও, লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম, অঞ্চল এবং শহর ও গ্রামীণ অভিজ্ঞতার মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া ব্যক্তির পরিচয় এবং জীবনের গতিপথকে গঠন করে। বৈষম্যের সমস্যা মোকাবেলা করা, সামাজিক গতিশীলতাকে উন্নীত করা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিকে উত্সাহিত করা এমন একটি সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ হবে যেখানে প্রত্যেকে উন্নতি করতে পারে।

বাংলাদেশ যখন তার উন্নয়নের যাত্রা চালিয়ে যাচ্ছে, তখন জাতির সামাজিক চিত্রের জটিলতায় সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি ধারণ করে, যেখানে অগ্রগতি ভাগ করা যাবে এবং তার সমস্ত নাগরিকের আকাঙ্ক্ষাগুলি বাস্তবায়িত হতে পারে।

লেখক: মোঃ বজলুর রশিদ, সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

;

‘প্রত্যয় পেনশন স্কিম’ প্রত্যাহারের দাবি কেন যৌক্তিক?



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

পেনশন একটি নির্দিষ্ট কর্ম বা পেশাজীবীদের জন্য প্রচলিত একটি ধারাবাহিক বিষয়। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বলবৎ করার একটি অন্যতম বড় উপায় হলো বয়স্কদের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করা। সাধারণতঃ সমাজ স্বীকৃত উপায়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে বৃদ্ধকালীন নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সকল মানুষের কল্যাণের নিমিত্তে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। গত বছরের ১৭ আগস্ট এর উদ্বোধন করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ বলতে গেলে এখনও কিছুই জানেন না বা বোঝেন না। যারা এই সর্বজনীন পেনশন সম্পর্কে কিছুটা জেনেছেন, তাদের নিকট এটা এখনও কৌতূহলের বিষয় এবং সমাজের বিজ্ঞজনদের নিকট এটা এখনও একটি বড় পর্যবেক্ষণের বিষয়।

কিন্তু তাড়াহুড়ো করে দায়সারা গোছের কোনো কিছু করতে গিয়ে আমাদের দেশে যেটা ইতোমধ্যে জটিলতা তৈরি করে ফেলেছে। উদ্বোধনের একবছর না পেরুতেই এটা নিয়ে মহা জটিলতা শুরু হয়েছে। তার প্রমাণ দেশের ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদেরকে অনির্দিষ্ট ধর্মঘটের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে।

সর্বজনীন পেনশন স্কীমের চারটি বড় শাখা রয়েছে। এই স্কিম অনুযায়ী ব্যক্তির বয়স ৬০ বছর হলেই তিনি সরকার থেকে পেনশন পেতে শুরু করবেন, তাকে আর চাঁদা দিতে হবে না। কিন্তু কেউ যদি ৫৫ বছর বয়সে এসে স্কিমে অংশ নেন তাহলে ৬৫ বয়স বয়স থেকে তিনি পেনশন পেতে শুরু করবেন।

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সরকার মোট ৬টি স্কিমের কথা ঘোষণা করেছে। তবে আপাতত চালু হয়েছে চারটি স্কিম। এগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা। আমাদের দেশের বাস্তবতায় এখনও সমতা ও সুরক্ষা স্কীমে তেমন আবেদনকারী নেই। অথচ বিশাল আয়বৈষম্য প্রপীড়িত জনসংখ্যার নিরীখে শুধু ‘সমতা’ বা ‘সুরক্ষা’ স্কীম দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে আগামী ক’বছর পর্যবেক্ষণ করার
প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটার জন্য অপেক্ষা না করেই- সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় নতুন যুক্ত হওয়া প্রত্যয় স্কিমের রূপরেখা ঘোষণা করা
হয়েছে।

‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে। দেশের চার শতাধিক স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কর্মীদের বাধ্যতামূলকভাবে এ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’ তবে শুরু থেকে নানা বৈষম্যমূলক বিষয় আঁচ করে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা এ কর্মসূচির বিরোধিতা করে আসছেন।

বলা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মচারীরা বর্তমানে সাধারণ ভবিষ্যৎ তহবিল (জিপিএফ) এবং স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো প্রদেয় ভবিষ্যৎ তহবিলে (সিপিএফ) টাকা জমা রাখে, যার বিনিময়ে সরকার ১১ থেকে ১৩ শতাংশ হারে সুদ দেয়। যেসব সরকারি কর্মচারী রাজস্ব খাত থেকে বেতন পান, তারা টাকা রাখেন জিপিএফে। আর যারা রাজস্ব খাতের বাইরে থেকে বেতন পান, তারা টাকা রাখেন সিপিএফে। পেনশনে যাওয়ার পর তারা এই টাকা পেয়ে থাকেন। কিন্তু নতুন ঘোষণায় এখানে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে বলে এটা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, ‘প্রত্যয় স্কিমে মূল বেতন থেকে ১০ শতাংশ অর্থ কেটে নেওয়া হবে। যেটা আগে কাটা হতো না। এ স্কিমে আনুতোষিক শূন্য। বর্তমানে পেনশনার ও নমিনি আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হন; কিন্তু নতুন এ স্কিমে পেনশনাররা ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশন পাবেন। বিদ্যমান পেনশনব্যবস্থায় ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাওয়া যায়, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সেটা সুস্পষ্ট করা হয়নি। সব থেকে বড় বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদকাল ৬৫ থেকে ৬০ বছর করা হয়েছে। মাসিক চিকিৎসাভাতা, উৎসবভাতা, বৈশাখী ভাতা নতুন প্রত্যয় স্কিমে প্রদান করা হবে না।’

বিভিন্ন প্রতিবাদ সভায় তারা আরও বলছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য যে প্রত্যয় স্কিম আরোপ করা হয়েছে, তা তাদের পারিবারিক সুরক্ষা নষ্ট করছে। এ প্রত্যয় স্কিমের ফলে মেধাবীরা আর শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হবে না। ..তারা ‘প্রত্যয় স্কিম’ থেকে শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন ও প্রতিশ্রুত সুপারগ্রেডে অন্তর্ভুক্তির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন।’

এর পেছনে যুক্তি অনেক। যেগুলো প্রতিদিন বিভিন্ন প্রতিবাদী সভায় আরও বেশি করে যুক্ত হয়ে আন্দোলনকে বেগবান করে চলেছে। সেখানে বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যয় স্কিম এর পার্থক্য খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

প্রথমত: বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণ ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত কর্মরত থাকেন, প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সে অবসরে যেতে হবে। তাদের চাকরিকালই ৫ বছর কমে যাবে। এই চাতুরী খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দেখিয়েছেন, কীভাবে নতুন পেনশনব্যবস্থা আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং শিক্ষকদের সুবিধা কমিয়ে দেবে। বলা হয়েছে- ‘এটি শুধু আর্থিক দিক থেকে বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য নয়, এটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দিক থেকেও বৈষম্যমূলক। কারণ, একই স্কেলে একই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন তুলে একেকজন একেক রকম পেনশন পেতে পারেন না। বরং শিক্ষকদের বেতন হওয়া উচিত অন্যদের চেয়ে বেশি এবং আলাদা। যোগ্যতা চাইবেন বিশ্বমানের আর সুযোগ-সুবিধা দেবেন বিশ্বের সবচেয়ে কম, এটি তো অন্যায্য চাওয়া।’

অনেকেই প্রশ্ন করছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কেন নতুন পেনশন স্কিমের বিরুদ্ধে? ..ঘোষণা অনুযায়ী, সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা তাঁদের জন্য প্রযোজ্য, যাঁরা বর্তমানে কোনো পেনশন পলিসিতে নেই।’ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের তো পেনশন স্কীম বিদ্যমান রয়েছে। তবে কেন তারা আবার নতুন পলিসিতে আসবেন? অথচ আমাদের নীতি নির্ধারকদের সেদিকে খেয়াল নেই। যাদের চাকুরী নেই, বেতন নেই, সামাজিক অবস্থান খুবই নড়বড়ে তাদের কল্যাণের জন্য না ভেবে পেনশনধারী চাকুরীজীবিদের বিদ্যমান চাকুরীর বয়সসীমা, আর্থিক সুবিধা কমিয়ে নিয়েকেন অযথা টানাহেঁচড়া করা হচ্ছে তা মোটেই বোধগম্য নয়।

একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ‘এটা খুব বড় উদ্যোগ তবে এখনও এর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো চোখে পড়েনি।’

আরেকজন বলেছেন, ‘এজন্য কোনো নীতিমালা তৈরি হয়নি, জনগণ অবগত নয় জনআস্থাও সৃষ্টি হয়নি। এতবড় প্রকল্পের আইডিয়াটাই দু:সাহসের ব্যাপার।’ আঠারো বছরের বেশি সবাই এর আওতাভূক্ত হবে। দেশের শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৪০ ভাগের বেশি। যাদের স্থায়ী আয় নেই তারা সদস্য হতে চাইবে না। আর বেকার কেউ সদস্য হলেও সে কিস্তি বা মাসিক চাঁদা পরিশোধ করবে কীভাবে? কিন্তু তবুও খুঁড়িয়ে চালানো হচ্ছে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া।

উন্নত দেশে প্রায় সকল কর্মক্ষম মানুষ পেশাদারী কাজ করে বেতনভূক্ত হয়ে থাকেন এবং নির্দিষ্ট নিয়মে সময়মতো পেনশন পান। তবুত হঠাৎ কেউ বেকার হয়ে পড়লে অথবা প্রাকৃতিক বা দৈবদুর্ঘটনা ঘটলে সেসব মোকাবেলায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনে সববয়সী মানুষ সরকারী সহায়তা লাভ করেন। সেজন্য সেসব দেশে সর্বজনীন পেনশনের প্রয়োজন হয় না।

যে সকল সমাজে নানাবিধ বৈষম্যের কারণে অধিকাংশ মানুষ সরকারি-বেসরকারি চাকুরী লাভ করতে না পেরে বেকারত্ব, অসুস্থতা ইত্যাদিতে উপার্জনহারা হয়ে বৃদ্ধকালীণ পর্যায়ে অতি মানবতের জীবন যাপন করেন অথবা কোনো সময় নিজ পরিবার ও সমাজের নিকট বোঝা হিসেবে চিহ্নিত হন, তখন সেটা চরম অমানবিক। তাদের কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে।

এদিকে শিক্ষকদের দাবি উপেক্ষা করে জুলাই ০১ থেকে প্রত্যয় স্কিম চালু করা হয়েছে। প্রতিবাদে দেশের ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সেদিন থেকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস-পরীক্ষার পাশাপাশি প্রশাসনিক ও দাফতরিক কাজ, সভা, লাইব্রেরি সেমিনার, সিম্পোজিয়ামসহ সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।

সার্বিক অচলাবস্থায় চরম ভোগান্তির শিক্ষার শিক্ষার্থীরা সেশনজটের আশঙ্কা করছেন। তবে কোনো কোনো শিক্ষক নেতা বলেছেন, করোনাকালের মতো তারা পরবর্তীতে বিশেষ ব্যবস্থায় ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সেশনজট পুষিয়ে দেবেন। এদিকে আন্দোলনের তিনদিনেও সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ের কেউই এই চলমান ধর্মঘট নিরসনে কোনো ধরনের উদ্যোগ দেখা যায়নি ।

আমাদের নীতি নির্ধারকদের বিশেষ করে জানা থাকা দরকার- বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্পর্শকাতর জায়গা যেগুলো সব সময় আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে দেশকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে থাকে। সেখানে এমন বৈষম্যমূলক প্রকল্প নিয়ে শিক্ষকদেরকে খোঁচা দেয়ার দরকার কি? বেশ কবছর ধরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো শান্ত থাকায় কোনো সেশনজট চোখে পড়েনি। সেখানে এমন বৈষম্যমূলক প্রকল্প চাপিয়ে দিয়ে ক্যাম্পাস অশান্ত করার কথা কার উর্বর মস্তিষ্কের ফসল?

কোনো কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কাজ ফেলে রেখে অনির্দিষ্টকালে ধর্মঘটে যেতে শিক্ষকদেরকে বাধ্য করা হলো? এই আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে আরও সময়ক্ষেপণ বা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হলে কে তার দায়ভার বহন করতে আসবে?

তাই সরকার আর দেরি না করে এই বৈষম্যমূলক প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করা উচিত। ভবিষ্যতের মেধাবীদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা অক্ষুন্ন রাখা এবং পেনশন সংক্রান্ত যাবতীয় বৈষম্য নিরসণকল্পে ‘প্রত্যয় প্রকল্প’ প্রত্যাহার করে কর্তৃপক্ষ সবাইকে এককটি সেশনজটমুক্ত ক্যাম্পাসের শান্ত পরিবেশে অচিরেই ফিরে আসার সুযোগ দান করুক- এই প্রত্যাশা করছি।

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।

;

ভারতে সত্তরোর্ধ্বদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা : বাংলাদেশ কি ভাবছে?



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সত্তরোর্ধ্ব বয়স্ক নাগরিকদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে ভারত। গত বৃহস্পতিবার দেশটির রাজধানী নয়াদিল্লিতে পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এই ঘোষণা দেন। আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পের অধীনে বিনামূল্যে এই চিকিৎসা সেবা দেওয়া হবে বলে জানান দেশটির রাষ্ট্রপতি।

পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মুর্মু আরও বলেন, আয়ুষ্মান ভারত-প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা প্রকল্পের অধীনে ৫৫ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে দেশে ২৫০০০টি জন ঔষুধী কেন্দ্র খোলার কাজও দ্রুত গতিতে চলছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাবলিক অর্থায়িত স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পটির অধীনে দরিদ্র পরিবারগুলো ৫ লাখ পর্যন্ত রুপি বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য দেয়া হচ্ছে।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের জন্যও খবরটি বিশেষ তাৎপর্য ও গুরুত্ব বহন করে। আমরা জানি যে, কোন দেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনের একটি অন্যতম মানদণ্ড হচ্ছে সেই দেশের জনগণের সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। সুনির্দিষ্ট কিছু রোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সাফল্য এসেছে, মিলেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। কিন্তু সার্বজনীন স্বাস্থসেবা নিশ্চিতে বাংলাদেশ এখনো মাইলকফলক স্পর্শ করতে পারেনি, এটিও বিবেচনায় নিতে হবে। যদিও ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

সাম্প্রতিক একটি পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের নাগরিকরা ৬৯ শতাংশ চিকিৎসা ব্যয় নিজেরাই নির্বাহ করেন। গবেষণা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন বলছে, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি অংশ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে প্রায় সর্বশান্ত হয়ে পড়ছেন। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে দরিদ্র পরিবারগুলো অনেক সময় তাদের শেষ সহায়-সম্বল ভিটেমাটি পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু অনেক সময়- সব বেঁচেও তারা তাদের স্বজনদের সুস্থ করে তুলতে পারেন না। উল্টো ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে শহরের অলি-গলি বা বস্তিতে ঠাই নেন। খোঁজ নিলে এমন দৃষ্টান্ত অজস্র দেয়া যাবে। গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস এর তথ্য বলছে, নিতান্তই অপারগ হয়ে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে ধারদেনা, ফসলি জমি বা ভিটেমাটি বিক্রি বা বন্ধক রাখেন শতকরা ৫৮ ভাগ মানুষ। এই সংখ্যাকে উদ্বেগজনক বললেও অত্যুক্তি হবে।

প্রায় দেড়শ’ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতে স্বাস্থ্যসেবায় নাগরিকদের ব্যক্তিগত ব্যয় ৬৩ শতাংশ। সেক্ষেত্রে ভারতে ৭০ বছরের বেশি বয়স্ক নাগরিকদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদানের সিদ্ধান্তকে যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলা যেতে পারে। পূর্ণ উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের দ্বারপ্রান্তে থাকা বাংলাদেশের জন্যও এটি অনুসরণযোগ্য বার্তা হতে পারে।

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবা নেওয়া নাগরিকদের একটি বড় অংশই সত্তরোর্ধ্ব। এই সংখ্যার একটি বড় অংশ আবার দরিদ্র জনগোষ্ঠী। সেই বিচারে প্রবীণদের চিকিৎসাসেবায় আনুকূল্য প্রদান যেমন রাষ্ট্রের মানবিক চরিত্রের প্রকাশ ঘটাবে তেমনি সার্বজননীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের যে লক্ষ্য রয়েছে বাংলাদেশের তা অর্জনেও অগ্রগতি আসবে।

সার্বজনীন চিকিৎসাসেবা প্রদানে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে অঙ্গীকার রয়েছে তার জনগণের কাছে তা অর্জনে শাসকদের আন্তরিকতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা বিশ্বজুড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আলোচিত স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার বিল নিয়ে নানা মহলে সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি সে বিষয়ে অনড় ছিলেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন অবশ্য প্রেসিডেন্ট বারাব ওবামার স্বাস্থ্যসংস্কার প্রস্তাবের সমালোচনার জবাবে বলেছিলেন, ‘এ নিয়ে বিদ্রুপের কিছু নেই। এ প্রস্তাবনায় মমতা আছে।’

আমরা লক্ষ্য করছি যে, সাম্প্রতিক দশক বা বছরগুলোতে জাতীয় বাজেটে অকাঠামো বা যোগাযোগ উন্নয়নে যে বিপুল বরাদ্দ রাখা হয়, অপরদিকে স্বাস্থ্যসেবা কিংবা শিক্ষার মত খাতগুলো সেখানে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব পায়। তবে বৈশ্বিক উন্নয়ন মানদণ্ডের নিরিখে স্বাস্থ্যখাতকে উপেক্ষার সুযোগ নেই, এ কথা জোর দিয়েই বলা যাবে।

জনগণের চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির যে অধিকার তা স্বীকার করে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে অন্য সকল উন্নয়ন প্রাধিকারের সঙ্গে সমান গুরুত্বে স্বাস্থ্যখাতকে বিবেচনার কোন বিকল্প নেই। সরকারকে ধাপে ধাপে সেই লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি নিতে হবে। সেক্ষেত্রে ৭০ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের বিনামূল্যে সব ধরণের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে ভারতের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারে বাংলাদেশও।

;

রাষ্ট্র ও সরকারে একই ভূত বিরাজমান



মযহারুল ইসলাম বাবলা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমাদের আমলাতন্ত্র নির্ভর ও শাসিত সরকারের শাসনামলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা এবং বেসরমারিক আমলাদের আরব্য রজনীর মতো অর্থবিত্ত, সম্পদের সংবাদগুলো আমাদের ক্রমাগত হতবাক করে দিচ্ছে। দু’চারজনের সংবাদেই আমাদের বুঝে নিতে কষ্ট হচ্ছে না, পুরো আমলাতন্ত্র এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের লাগামহীন দুর্নীতির এবং অর্থ লুণ্ঠনের বিষয়াদি। সাবেক আইজি’র বিষয়ে একটি দৈনিকে তার অর্থ সম্পদের তালিকা প্রকাশের ফলে তথাকথিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন বাধ্য হয় তদন্ত করে মামলা দায়ের করতে। অথচ যার বিরুদ্ধে অর্থবিত্তের, সম্পদের পর্বত সমেত অভিযোগ তিনি নির্বিঘ্নে অর্থকড়ি গুছিয়ে দেশ থেকে ভিন দেশে পাড়ি দিয়েছেন। তাকে কোনোরূপ বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। তার অবর্তমানে কিছুদিন লেখালেখির পর বিষয়টি অন্যান্য বিষয়ের মতো আমাদের স্মৃতি থেকে লোপাট হয়ে যাবে। যেমনটি এ যাবৎ কালের রোমহর্ষক ঘটনাগুলো হারিয়ে গেছে। অপরাধীরা নিরাপদ এবং নির্বিঘ্ন জীবন-যাপন করছেন। আইজি সাহেবের পলায়নের ঘটনার পর ক্রমশ গণমাধ্যমে সেটা প্রায় চাপা পড়েছে।

গত কুরবানি ঈদে ১৫ লক্ষ টাকায় খাসি কেনার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এবং কুরবানিতে কোটি কোটি টাকার পশু কুরবানি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ঝড় ওঠে। ইফাত নামক ছেলেটির ১৫ লক্ষ টাকার ছাগল কেনার ঘটনার পর একে একে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মতিউর রহমানের পুত্র ইফাতের ছাগল কেনার সূত্র ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট এবং রাষ্ট্রায়াত্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালক মতিউর রহমানের অবৈধ পন্থায় অর্থবিত্ত, সম্পদের বিবরণের খতিয়ান সম্প্রতি দেশজুড়ে তোলপাড় করছে। দুই স্ত্রী’র নরসিংদী ও ফেনিতে সম্পদের পরিমাণ এবং অবকাঠামোগুলোও নজিরবিহীন। করোনায় আক্রান্ত মতিউর দ্বিতীয় স্ত্রীকে খালি চেক স্বাক্ষর করে দেয়। ওই চেকের মাধ্যমে তিনশত কোটি টাকা দ্বিতীয় স্ত্রী’র হাতিয়ে নেবার সংবাদও গণমাধ্যমে এসেছে। কোটি কোটি টাকা মূল্যের গাড়ির বহর। রাজকীয় জীবনাচার। প্রথম স্ত্রীকে কলেজের অধ্যাপনা থেকে ছাড়িয়ে অর্থের জোরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বসানো ইত্যাদি ঘটনাগুলো রূপকথাকেও হার মানায়। দেশের অর্থ বিদেশে পাচার এবং কানাডায় আমলাদের স্ত্রীদের নামে বাড়ি কেনার হিড়িকে কানাডায় বাংলাদেশি নারীদের মালিকানার বাড়িগুলোকে ‘বেগম পাড়া’ হিসেবে গত ক’বছর ধরে প্রচারণা চলছে। মতিউরের ক্ষেত্রেও কানাডায় সম্পদ ক্রয়ের এবং সন্তানদের সেখানে পাঠিয়ে দেবার ঘটনাও প্রকাশ পেয়েছে। এখনও মতিউর অধরা। তবে তার অবৈধ সম্পদের খোঁজে তিন সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে দুদক। এখনো স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছেন, আগের মতোই। নিজেকে রক্ষা করতে ইফাতকে ছেলে হিসেবে অস্বীকার করার ন্যায় ঘৃণিত মিথ্যাচার করতেও দ্বিধা করেনি।

প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অবাধ লুণ্ঠন অনাচারের যে চিত্র জনসমক্ষে ক্রমাগত প্রকাশ পাচ্ছে। তাদের বিষয়ে সরকারের উপেক্ষার কারণ কী! কারণ আমরা জানি এই সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনায় এনেছে এবং রেখেছে আমাদের দুই আমলাতন্ত্র এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এটা জলের ন্যায় পরিষ্কার। তাই সরকার আমলাদের বিরুদ্ধে তাদের অপরাধের বিষয়ে নিশ্চুপ থেকে পক্ষান্তরে ওই অনাচার-দুর্নীতিকেই পক্ষান্তরে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সরকার সংশ্লিষ্টরাও ধোয়া তুলসি পাতা নয়। তাদের অবাধ লুণ্ঠন, দুর্নীতিও আকাশ ছোঁয়া। অর্থাৎ আমাদের শাসকশ্রেণি সম্পূর্ণ রূপে দুর্নীতিতে, লুণ্ঠনে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। কে কাকে আটকাবে! রাষ্ট্র এবং সরকার দুটি আলাদা সত্তা। রাষ্ট্র স্থায়ী কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকার ৫ বছর মেয়াদি। জনগণ নির্ধারণ করে কোন দল রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। সেটা নির্বাচনে নির্ধারিত হয়। এটাই বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিধি ব্যবস্থা। বাস্তবে আমাদের দেশে ওই ব্যবস্থা কার্যকর নেই বরং উপেক্ষিত। তাই রাষ্ট্রযন্ত্রে এবং সরকারে অর্থাৎ পুরো শাসকশ্রেণির অভ্যন্তরে নেই স্বচ্ছতা, নেই জবাবদিহিতা, নেই নিয়ন্ত্রণ। আর কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সবাই তো অভিন্ন পথযাত্রী। সর্ষে ভূত থাকলে তো সর্ষে দিয়ে ভূত ছাড়ানো যায় না। আমাদের শাসকশ্রেণির দশা ঠিক তেমনই। একের পর এক আমলা, পুলিশ, সরকারি দলের রাজনীতিকদের রোমহর্ষক দুর্নীতি, অর্থ লুণ্ঠনের ঘটনা ফাঁস হবে। গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হৈ চৈ হবে। আরেকটি ঘটনা আগের ঘটনাকে চাপা দিয়ে দেবে। একের পর এক ঘটতে থাকা ঘটনায় আর কত প্রতিক্রিয়ামুখর থাকবে মানুষ এবং গণমাধ্যম! আগে নৈতিক পথে উপার্জন এবং অনৈতিক পথে উপার্জন নিয়ে সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যেত। এখন সেটা দেখা যায় না। কে কিভাবে, কোন উপায়ে হঠাৎ সম্পদশালী, বিত্তবান হয়ে উঠলো এ নিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বান্দ্বিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। বরং বলা হয় তিনি ভাগ্যবান আল্লাহর ইচ্ছায় এবং আশীর্বাদে তার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে।

কাগজের মুদ্রা-টাকার যে রঙ রয়েছে, সেটা আমাদের সকলেরই জানা। পরিমাণ ভেদে টাকার রঙও ভিন্ন ভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। এই রঙ বৈচিত্র্যপূর্ণ তো বটেই এবং বহু রঙের সমাহারে। টাকাকে দুই পৃথক রঙে বিভক্তিকরণের সামাজিক আচার ছিল এবং আছেও। বর্ণিল রঙের এই টাকাকে আমাদের সমাজে সচরাচর সাদা-কালো দুই পৃথক রঙে চিহ্নিত করার অলিখিত নিয়ম প্রচলিত ছিল এবং রয়েছে। সেটা বহুকাল-যুগ পূর্ব থেকেই। অতীতে সামাজিক মান-মর্যাদার প্রশ্নটিও প্রচলিত টাকার রঙের ওপর নির্ভর করতো। অর্থাৎ ব্যক্তির অর্থ বৈধ না অবৈধ সেটা নির্ধারিত হতো ব্যক্তির অর্থ বা টাকা সাদা না কালো নির্ধারণের ভিত্তিতে। হঠাৎ বিত্তবান ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কিংবা আয়ের সঙ্গে সম্পদ ও ব্যয়ের অসঙ্গতিতে সামাজিক জীবনে ওই ব্যক্তিকে নিয়ে মানুষের কৌতূহল সৃষ্টি হতো। জন্ম দিত নানা জল্পনা-কল্পনার।

আমার কৈশোরের একটি ঘটনা স্মরণ করছি। সরকারি উদ্যোগে পাকিস্তান সরকার কয়লা আমদানি করতো, কয়লা নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তর নামের সরকারি প্রতিষ্ঠান ছিল। আমদানিকৃত সে কয়লা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বার্জ যোগে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে পরিবহনে বেসরকারি ঠিকাদার নিয়োগ করা হতো। বার্জে করে কয়লা পরিবহনের জনৈক ঠিকাদার আমাদের এলাকায় বসবাস করতেন। হঠাৎ ব্যক্তিটির অস্বাভাবিক আর্থিক উন্নতিতে কৌতূহলী স্থানীয়দের মধ্যে এক প্রকার সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রমাণ যোগ্য তথ্যের অভাবে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলেনি। সেজন্য অবশ্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। অচিরেই ঠিকাদারের বাড়িতে পুলিশ এসে ঠিকাদারকে ধরে নিয়ে যায়। ঠিক দুইদিন পর কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে ঠিকাদার বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু প্রকৃত রহস্য আর চাপা থাকেনি। দ্রুত সেটা পুরো এলাকায় চাউর হয়ে গিয়েছিল। ঠিকাদার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় কয়লা পরিবহনের জন্য ১৪টি বার্জে কয়লা ভর্তি করে ঢাকার পরিবর্তে অন্যত্রে কয়লা নামিয়ে পাচার করে এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে জানায় কয়লাসহ পরিবহনকৃত ১৪টি বার্জ নদীতে ডুবে গেছে। সরকারি পণ্য তসরুপের অভিযোগে ঠিকাদারকে আটক করে পুলিশ। তবে তার দ্রুত অব্যাহতিতে মজার কথাও প্রচার পেয়েছিল। তার এই অপকীর্তির সঙ্গে সরকারি দফতরের লোকজনও জড়িত ছিল। এমন কি বার্জ ডুবেছে কিনা সেটা তদন্তে সরকারি দফতর যাদের নিয়োগ করেছিল; ঠিকাদার ও সরকারি কয়লা নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা দ্রুত তাদের বখরা দিয়ে সমঝোতা করে ফেলে। পরিশেষে তদন্ত নাটকের যাবনিকা এবং ঠিকাদার বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। তবে ঠিকাদারের প্রতিষ্ঠানকে কয়লা পরিবহনের কাজ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়। শাস্তি কেবল এটুকুই তিনি পেয়েছিলেন।

সামাজিক ভাবে এলাকায় তিনি ‘কয়লা চোর’ খ্যাতি কিন্তু লাভ করেন। এমন কি তার সন্তানেরা পর্যন্ত কয়লা চোরের খ্যাতি মাথায় নিয়ে নত মুখে এলাকায় চলাচলে বাধ্য হয়। তাদের একতলা বাড়ি দ্রুত চারতলায় রূপান্তরিত হয়। এবং এলাকায় বাড়ি, জমি-সম্পত্তি কেনায় যেন ঠিকাদারের হিড়িক পড়েছিল। স্থানীয় কাউকে বাড়ি-সম্পত্তি বিক্রি করতে আর দালালের শরণাপন্ন হতে হতো না। বিক্রেতা স্বয়ং ঠিকাদারের নিকট হাজির হলেই ন্যায্যমূল্যে বাড়ি-সম্পত্তি বিক্রি করতে পারতো। এতে এলাকায় ঠিকাদারের সম্পত্তির পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। সেই পাকিস্তানি আমলে রিক্শাযাত্রী ঠিকাদার-পরিবার রিক্শার পরিবর্তে মাজদা গাড়ি হাঁকায়। অর্থ-বিত্ত, সম্পত্তি বৃদ্ধিতেও কিন্তু সামাজিক মর্যাদা তাদের বৃদ্ধি পায়নি। বরং কয়লা চোরের নামকরণে তাদের কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সামাজিক মর্যাদা পুনরুদ্ধারে মসজিদ-মাদ্রাসায় অঢেল অর্থ প্রদান করে সমাজে নিজেকে মর্যাদাবান রূপে প্রতিষ্ঠার কৌশলী উদ্যোগ ঠিকাদার গ্রহণ করেছিল। এই কৌশলটি তার অপবাদ ঘুচাতে সহায়তা করেছিল বটে, তবে প্রকাশ্যে না হলেও নেপথ্যে ঠিকাদারের কুখ্যাতির গুঞ্জন কিন্তু একেবারে বিলুপ্তি ঘটেনি। সেটা বহুকাল টিকে ছিল।

টাকার রঙ নিয়ে সমাজে এখন আর উচ্চ-বাচ্য কেউ করে না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে করা হয় মাত্র। শর্তাধীনে সে ক্ষেত্রে পরিত্রাণের সুযোগও করে দেয় স্বয়ং রাষ্ট্রই। আয় বহির্ভূত অর্থকে আয়ভুক্ত বা বৈধতা প্রদান করার সুযোগ দেয়া হয়, রাষ্ট্রকে অর্থদণ্ড প্রদানে। অর্থাৎ কালো টাকাকে সাদায় রূপান্তরিত করার রাষ্ট্রীয় স্বাভাবিক (!) ব্যবস্থাধীনে। তাই এখন টাকার পরিমাণগত রঙই টাকার পার্থক্য নির্ধারণ করে, সাদা-কালোর বিভাজনে নয়। টাকা এখন টাকাই, সে যে উপায়ে অর্জিত হোক না কেন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভে বাধাপ্রাপ্ত হয় না। ঘৃণা-ধিক্কারের যোগ্যও থাকে না, বিপরীতে পায় নিষ্কণ্টক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্বীকৃতি। এতে করেই সমাজে ও রাষ্ট্রে অবৈধ পন্থা অবলম্বনকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও হয় কে কত বেশি অনৈতিক পন্থা গ্রহণে অর্থশালী হতে পেরেছে। আমাদের রাষ্ট্রের তথাকথিত সেবকগণ এবং রাজনীতিকরা ওই একই পথের যাত্রী হিসেবে জনগণের উপার্জিত অর্থ হাতিয়ে বিত্তশালী হচ্ছে, বিদেশে অর্থ পাচার করে চলেছে। যতদিন জনগণের সরকার দেশে প্রতিষ্ঠা না পাবে; ততোদিন এই লুণ্ঠন প্রক্রিয়া থামবে বলে অনুমান করা যাচ্ছে না।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

;