‘প্রত্যয় পেনশন স্কিম’ প্রত্যাহারের দাবি কেন যৌক্তিক?



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

পেনশন একটি নির্দিষ্ট কর্ম বা পেশাজীবীদের জন্য প্রচলিত একটি ধারাবাহিক বিষয়। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বলবৎ করার একটি অন্যতম বড় উপায় হলো বয়স্কদের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করা। সাধারণতঃ সমাজ স্বীকৃত উপায়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে বৃদ্ধকালীন নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সকল মানুষের কল্যাণের নিমিত্তে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। গত বছরের ১৭ আগস্ট এর উদ্বোধন করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ বলতে গেলে এখনও কিছুই জানেন না বা বোঝেন না। যারা এই সর্বজনীন পেনশন সম্পর্কে কিছুটা জেনেছেন, তাদের নিকট এটা এখনও কৌতূহলের বিষয় এবং সমাজের বিজ্ঞজনদের নিকট এটা এখনও একটি বড় পর্যবেক্ষণের বিষয়।

কিন্তু তাড়াহুড়ো করে দায়সারা গোছের কোনো কিছু করতে গিয়ে আমাদের দেশে যেটা ইতোমধ্যে জটিলতা তৈরি করে ফেলেছে। উদ্বোধনের একবছর না পেরুতেই এটা নিয়ে মহা জটিলতা শুরু হয়েছে। তার প্রমাণ দেশের ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদেরকে অনির্দিষ্ট ধর্মঘটের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে।

সর্বজনীন পেনশন স্কীমের চারটি বড় শাখা রয়েছে। এই স্কিম অনুযায়ী ব্যক্তির বয়স ৬০ বছর হলেই তিনি সরকার থেকে পেনশন পেতে শুরু করবেন, তাকে আর চাঁদা দিতে হবে না। কিন্তু কেউ যদি ৫৫ বছর বয়সে এসে স্কিমে অংশ নেন তাহলে ৬৫ বয়স বয়স থেকে তিনি পেনশন পেতে শুরু করবেন।

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সরকার মোট ৬টি স্কিমের কথা ঘোষণা করেছে। তবে আপাতত চালু হয়েছে চারটি স্কিম। এগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা। আমাদের দেশের বাস্তবতায় এখনও সমতা ও সুরক্ষা স্কীমে তেমন আবেদনকারী নেই। অথচ বিশাল আয়বৈষম্য প্রপীড়িত জনসংখ্যার নিরীখে শুধু ‘সমতা’ বা ‘সুরক্ষা’ স্কীম দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে আগামী ক’বছর পর্যবেক্ষণ করার
প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটার জন্য অপেক্ষা না করেই- সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় নতুন যুক্ত হওয়া প্রত্যয় স্কিমের রূপরেখা ঘোষণা করা
হয়েছে।

‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে। দেশের চার শতাধিক স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কর্মীদের বাধ্যতামূলকভাবে এ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’ তবে শুরু থেকে নানা বৈষম্যমূলক বিষয় আঁচ করে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা এ কর্মসূচির বিরোধিতা করে আসছেন।

বলা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মচারীরা বর্তমানে সাধারণ ভবিষ্যৎ তহবিল (জিপিএফ) এবং স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো প্রদেয় ভবিষ্যৎ তহবিলে (সিপিএফ) টাকা জমা রাখে, যার বিনিময়ে সরকার ১১ থেকে ১৩ শতাংশ হারে সুদ দেয়। যেসব সরকারি কর্মচারী রাজস্ব খাত থেকে বেতন পান, তারা টাকা রাখেন জিপিএফে। আর যারা রাজস্ব খাতের বাইরে থেকে বেতন পান, তারা টাকা রাখেন সিপিএফে। পেনশনে যাওয়ার পর তারা এই টাকা পেয়ে থাকেন। কিন্তু নতুন ঘোষণায় এখানে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে বলে এটা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, ‘প্রত্যয় স্কিমে মূল বেতন থেকে ১০ শতাংশ অর্থ কেটে নেওয়া হবে। যেটা আগে কাটা হতো না। এ স্কিমে আনুতোষিক শূন্য। বর্তমানে পেনশনার ও নমিনি আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হন; কিন্তু নতুন এ স্কিমে পেনশনাররা ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশন পাবেন। বিদ্যমান পেনশনব্যবস্থায় ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাওয়া যায়, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সেটা সুস্পষ্ট করা হয়নি। সব থেকে বড় বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদকাল ৬৫ থেকে ৬০ বছর করা হয়েছে। মাসিক চিকিৎসাভাতা, উৎসবভাতা, বৈশাখী ভাতা নতুন প্রত্যয় স্কিমে প্রদান করা হবে না।’

বিভিন্ন প্রতিবাদ সভায় তারা আরও বলছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য যে প্রত্যয় স্কিম আরোপ করা হয়েছে, তা তাদের পারিবারিক সুরক্ষা নষ্ট করছে। এ প্রত্যয় স্কিমের ফলে মেধাবীরা আর শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হবে না। ..তারা ‘প্রত্যয় স্কিম’ থেকে শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন ও প্রতিশ্রুত সুপারগ্রেডে অন্তর্ভুক্তির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন।’

এর পেছনে যুক্তি অনেক। যেগুলো প্রতিদিন বিভিন্ন প্রতিবাদী সভায় আরও বেশি করে যুক্ত হয়ে আন্দোলনকে বেগবান করে চলেছে। সেখানে বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যয় স্কিম এর পার্থক্য খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

প্রথমত: বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণ ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত কর্মরত থাকেন, প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সে অবসরে যেতে হবে। তাদের চাকরিকালই ৫ বছর কমে যাবে। এই চাতুরী খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দেখিয়েছেন, কীভাবে নতুন পেনশনব্যবস্থা আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং শিক্ষকদের সুবিধা কমিয়ে দেবে। বলা হয়েছে- ‘এটি শুধু আর্থিক দিক থেকে বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য নয়, এটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দিক থেকেও বৈষম্যমূলক। কারণ, একই স্কেলে একই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন তুলে একেকজন একেক রকম পেনশন পেতে পারেন না। বরং শিক্ষকদের বেতন হওয়া উচিত অন্যদের চেয়ে বেশি এবং আলাদা। যোগ্যতা চাইবেন বিশ্বমানের আর সুযোগ-সুবিধা দেবেন বিশ্বের সবচেয়ে কম, এটি তো অন্যায্য চাওয়া।’

অনেকেই প্রশ্ন করছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কেন নতুন পেনশন স্কিমের বিরুদ্ধে? ..ঘোষণা অনুযায়ী, সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা তাঁদের জন্য প্রযোজ্য, যাঁরা বর্তমানে কোনো পেনশন পলিসিতে নেই।’ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের তো পেনশন স্কীম বিদ্যমান রয়েছে। তবে কেন তারা আবার নতুন পলিসিতে আসবেন? অথচ আমাদের নীতি নির্ধারকদের সেদিকে খেয়াল নেই। যাদের চাকুরী নেই, বেতন নেই, সামাজিক অবস্থান খুবই নড়বড়ে তাদের কল্যাণের জন্য না ভেবে পেনশনধারী চাকুরীজীবিদের বিদ্যমান চাকুরীর বয়সসীমা, আর্থিক সুবিধা কমিয়ে নিয়েকেন অযথা টানাহেঁচড়া করা হচ্ছে তা মোটেই বোধগম্য নয়।

একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ‘এটা খুব বড় উদ্যোগ তবে এখনও এর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো চোখে পড়েনি।’

আরেকজন বলেছেন, ‘এজন্য কোনো নীতিমালা তৈরি হয়নি, জনগণ অবগত নয় জনআস্থাও সৃষ্টি হয়নি। এতবড় প্রকল্পের আইডিয়াটাই দু:সাহসের ব্যাপার।’ আঠারো বছরের বেশি সবাই এর আওতাভূক্ত হবে। দেশের শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৪০ ভাগের বেশি। যাদের স্থায়ী আয় নেই তারা সদস্য হতে চাইবে না। আর বেকার কেউ সদস্য হলেও সে কিস্তি বা মাসিক চাঁদা পরিশোধ করবে কীভাবে? কিন্তু তবুও খুঁড়িয়ে চালানো হচ্ছে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া।

উন্নত দেশে প্রায় সকল কর্মক্ষম মানুষ পেশাদারী কাজ করে বেতনভূক্ত হয়ে থাকেন এবং নির্দিষ্ট নিয়মে সময়মতো পেনশন পান। তবুত হঠাৎ কেউ বেকার হয়ে পড়লে অথবা প্রাকৃতিক বা দৈবদুর্ঘটনা ঘটলে সেসব মোকাবেলায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনে সববয়সী মানুষ সরকারী সহায়তা লাভ করেন। সেজন্য সেসব দেশে সর্বজনীন পেনশনের প্রয়োজন হয় না।

যে সকল সমাজে নানাবিধ বৈষম্যের কারণে অধিকাংশ মানুষ সরকারি-বেসরকারি চাকুরী লাভ করতে না পেরে বেকারত্ব, অসুস্থতা ইত্যাদিতে উপার্জনহারা হয়ে বৃদ্ধকালীণ পর্যায়ে অতি মানবতের জীবন যাপন করেন অথবা কোনো সময় নিজ পরিবার ও সমাজের নিকট বোঝা হিসেবে চিহ্নিত হন, তখন সেটা চরম অমানবিক। তাদের কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে।

এদিকে শিক্ষকদের দাবি উপেক্ষা করে জুলাই ০১ থেকে প্রত্যয় স্কিম চালু করা হয়েছে। প্রতিবাদে দেশের ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সেদিন থেকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস-পরীক্ষার পাশাপাশি প্রশাসনিক ও দাফতরিক কাজ, সভা, লাইব্রেরি সেমিনার, সিম্পোজিয়ামসহ সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।

সার্বিক অচলাবস্থায় চরম ভোগান্তির শিক্ষার শিক্ষার্থীরা সেশনজটের আশঙ্কা করছেন। তবে কোনো কোনো শিক্ষক নেতা বলেছেন, করোনাকালের মতো তারা পরবর্তীতে বিশেষ ব্যবস্থায় ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সেশনজট পুষিয়ে দেবেন। এদিকে আন্দোলনের তিনদিনেও সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ের কেউই এই চলমান ধর্মঘট নিরসনে কোনো ধরনের উদ্যোগ দেখা যায়নি ।

আমাদের নীতি নির্ধারকদের বিশেষ করে জানা থাকা দরকার- বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্পর্শকাতর জায়গা যেগুলো সব সময় আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে দেশকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে থাকে। সেখানে এমন বৈষম্যমূলক প্রকল্প নিয়ে শিক্ষকদেরকে খোঁচা দেয়ার দরকার কি? বেশ কবছর ধরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো শান্ত থাকায় কোনো সেশনজট চোখে পড়েনি। সেখানে এমন বৈষম্যমূলক প্রকল্প চাপিয়ে দিয়ে ক্যাম্পাস অশান্ত করার কথা কার উর্বর মস্তিষ্কের ফসল?

কোনো কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কাজ ফেলে রেখে অনির্দিষ্টকালে ধর্মঘটে যেতে শিক্ষকদেরকে বাধ্য করা হলো? এই আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে আরও সময়ক্ষেপণ বা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হলে কে তার দায়ভার বহন করতে আসবে?

তাই সরকার আর দেরি না করে এই বৈষম্যমূলক প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করা উচিত। ভবিষ্যতের মেধাবীদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা অক্ষুন্ন রাখা এবং পেনশন সংক্রান্ত যাবতীয় বৈষম্য নিরসণকল্পে ‘প্রত্যয় প্রকল্প’ প্রত্যাহার করে কর্তৃপক্ষ সবাইকে এককটি সেশনজটমুক্ত ক্যাম্পাসের শান্ত পরিবেশে অচিরেই ফিরে আসার সুযোগ দান করুক- এই প্রত্যাশা করছি।

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।

ব্রিটেন: কিয়ার স্টারমার ইন, ঋষি আউট, অতঃপর?



ড. মাহফুজ পারভেজ
ব্রিটেন: কিয়ার স্টারমার ইন, ঋষি আউট, অতঃপর?

ব্রিটেন: কিয়ার স্টারমার ইন, ঋষি আউট, অতঃপর?

  • Font increase
  • Font Decrease

ব্রিটেনের নির্বাচনে যে অভাবনীয় জনমত প্রতিফলিত হয়েছে, তা মোটেও আকস্মিক বা আশ্চর্যজনক নয়। ভোট সমীক্ষা ও পর্যবেক্ষণদের বিশ্লেষণে আগেই এমন আভাস পাওয়া গিয়েছিল যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটতে চলেছে। সর্বমহল থেকে বলা হচ্ছিল, দেশে ও বিদেশে সরকারের কাজে ক্ষুব্ধ জনতা। সবাই একটা পরিবর্তনের প্রত্যাশায় আছেন। ভোটের বাক্সে তার প্রকাশ ঘটে। ক্ষমতাসীন দলও সেটা নত মস্তকে মেনে নিয়েছে। তবে ফলাফল যে এমন বিপুল পার্থক্য নিয়ে আসবে এবং ব্রিটেনের রাজনীতিতে লেবার পার্টির বিরাট উত্থান ঘটাবে, তা কেউ ভাবেন নি।

সংসদীয় গণতন্ত্রে তীর্থভূমি ব্রিটেনের সংসদ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট: হাউস অফ লর্ডস (উচ্চকক্ষ) ও হাউস অফ কমন্স (নিম্নকক্ষ)। উচ্চকক্ষের ক্ষমতা কেবল আইন প্রণয়নকে কিছুটা বিলম্ব করার মধ্যে সীমিত। সুতরাং নিম্নকক্ষের কাছে সংসদের প্রকৃত ক্ষমতা রয়েছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ বা ‘হাউস অব কমন্স’-এ মোট আসন ৬৫০। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার জন্য নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ‘জাদু সংখ্যা’ ৩২৬। লেবার পার্টি এ বার ৪১০-এর বেশি আসন পেয়ে ইতি টানল ১৪ বছরের কনজ়ারভেটিভ শাসনে।

ক্ষমতাসীন কনজ়ারভেটিভরা নির্বাচনে কেন এতোটাই খারাপ করলো? এই প্রশ্ন বিশ্লেষকদের ভাবিয়ে তুলেছে। ব্রিটেনের প্রায়-সম-ক্ষমতার দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় কনজ়ারভেটিভ পার্টি ও লেবার পার্টির মধ্যে সমানে সমানে লড়াই চলে। কিন্তু এবারের নির্বাচনে কনজ়ারভেটিভরা কোনো ক্রমে দখলে রাখতে পারল মাত্র ১২১টি আসন। কেন এমন হলো? সংখ্যাটি ক্ষমতা থেকে বহু দূরের শুধু নয়, জনগণের সমর্থনের দিক থেকেও প্রান্তিক। ব্রিটেনের মতো একটি রক্ষণশীল দেশে কনজ়ারভেটিভ বা রক্ষণশীলরা এতো নাজুক পরিস্থিতিতে আগে খুব কমই পড়েছে। যে কারণে এবারের নির্বাচনে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনককে সরকারি আবাস ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট ছাড়তে হয়েছে এমন একটি অসহায় অবস্থায়, যেখানে তার দল কনজ়ারভেটিভ পার্টিকে (টোরি) কার্যত নাস্তানাবুদ করে ব্রিটিশ ক্ষমতার লাগাম হাতে নিল লেবার পার্টি।

বিশ্বব্যাপী যখন কর্তৃত্ববাদ ও যুদ্ধবাজদের উত্থান হচ্ছে, তখন ব্রিটেনে অপেক্ষাকৃত উদার ও বামঘেষাঁ লেবার পার্টির ক্ষমতায় আরোহণ চাঞ্চল্যকরই বটে। তবে এজন্য কনজ়ারভেটিভ পার্টির শাসন নীতির ব্যর্থতা বহুলাংশে দায়ী, যা ব্রিটেনের জনমতকে বিরাট আকারে প্রভাবিত করেছে লেবার পার্টিকে ক্ষমতায় আনতে। মূলত ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময় থেকে ব্রিটেনের ভঙ্গুর অর্থনীতি, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, দেশের প্রখ্যাত জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা (এনএইচএস)-র ব্যাপক অবনতি, অভিবাসন সমস্যা-সহ সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধিতে ব্রিটিশ জনগণ সরকারের প্রতি বিরক্ত ছিলেন। সেসব ক্ষোভের কথা তারা প্রকাশ্যেই ও খোলামেলা ভাবেই জনমত সমীক্ষাগুলোতে বলেছেন। সরকারের নীতিতে গতিহীনতার বিরুদ্ধেও তাদের আপত্তি ছিল। অনেকেই প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনকের নেতৃত্বে কনজ়ারভেটিভ পার্টির সরকারকে স্থবির বলেছেন।

সবচেয়ে বেশি আপত্তি এসেছে কনজ়ারভেটিভ পার্টি বা টোরিদের নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক কাঠামোর বিরুদ্ধে। গত পাঁচ বছর ধরে টোরিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, তিন বার প্রধানমন্ত্রী বদল ইত্যাদিও প্রভাবিত করেছে এ বারের ভোটকে। ঐতিহ্যগতভাবে ব্রিটিশরা স্থায়ীত্ব ও ধারাবাহিকতায় আস্থাশীল। কনজ়ারভেটিভ পার্টির পক্ষে তেমন আশার আলো দেখানো সম্ভব হয়নি। তাদের নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে বার বার প্রধানমন্ত্রী বদলের ফলে দেশে যে দোদুল্যমান শাসন কায়েম হয়েছিল, জনতা তা পছন্দ করেনি।

জনতার বিরক্ত হওয়ার কারণও সঙ্গত। গণতন্ত্র বৈপ্লবিক পন্থার বদলে স্থায়ীত্বকে নীতি হিসাবে মেনে নেয়। কনজ়ারভেটিভ পার্টি ব্রিটেনে স্থায়ী সরকার দিতে পারেনি। কনজ়ারভেটিভ পার্টি দেশ শাসনে স্থিতিশীলতাও প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কারণ, লিজ় ট্রাস-এর ৪৯ দিনের বিশৃঙ্খলাময় শাসনের শেষে ২০২২ সালের অক্টোবরে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনক। সকলের আশা ছিল, পূর্বসূরিদের টালমাটাল নেতৃত্বের পরে দল তথা দেশের রাজনীতিতে স্থিতি আনতে সক্ষম হবেন তিনি। তার নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতির কিছুটা উন্নতিও হয়। ১১ শতাংশের মূল্যবৃদ্ধির হারকে তিনি ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হন।

কিন্তু কিছু উন্নতি সত্ত্বেও, ব্রেক্সিট-পরবর্তী অর্থনৈতিক সঙ্কট, কোভিড মহামারির ধাক্কা এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের জেরে দেশের ব্রিটেন দুরবস্থা দাঁড়িয়েছিল, তাতে বিশেষ নিরাময় ঘটাতে পারেন নি ঋষি সুনক। মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি শুল্ক বৃদ্ধি, বাসস্থানের ঘাটতির মতো সমস্যা দুর্ভোগ বাড়িয়েছে ব্রিটিশ জনসাধারণের। সামাজিক কল্যাণের অনেকগুলো খাতেই রাশ টানতে হয়েছিল সরকারকে। যা জনতার উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং এর প্রভাব দেখা যায় নির্বাচনে কনজ়ারভেটিভ পার্টির ভরাডুরির মাধ্যমে।

পাঁচ বছর আগে কনজ়ারভেটিভ পার্টির ব্রেক্সিটের পক্ষে প্রচারে বিপুল সাড়া মিলেছিল। ‘গেট ব্রেক্সিট ডান’ স্লোগানে ভর করে ‘হাউস অফ কমন্‌স’-এর ৩৬৫টিতে জিতে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেছিলেন বরিস জনসন। কিন্তু ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সরকারি বাসভবনে আড়াই বছরের বেশি কাটাতে পারেননি তিনি। দলের অন্দরে বিদ্রোহ এবং কোভিডবিধি ভেঙে পানভোজনের আসর বসানোর অভিযোগ মাথায় নিয়ে ২০২২ সালে জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। তার পর লিজ় ট্রাসের ৪৯ দিনের প্রধানমন্ত্রিত্ব পর্বের শেষে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন ঋষি।

অন্য দিকে, অভিবাসন নিয়ে টোরি সরকারের কার্যকলাপ বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। দেশের নির্বাচন ২০২৫ সালের মধ্যে হওয়ার কথা হলেও, বিরোধীদের বিপাকে ফেলতে দ্রুত সাধারণ নির্বাচন করার পদক্ষেপ নেন সুনক। কিন্তু তার এই রাজনৈতিক চাল দলকে রক্ষা করার বদলে কনজ়ারভেটিভদের আরো সঙ্কটে ফেলে।

নতুন প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ভোট প্রচারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তিনি দেশের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারেই এ বার মন দেবেন। লেবার পার্টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, চাকরিরতদের জন্য শুল্ক বৃদ্ধি করা হবে না, আয়কর, জাতীয় বিমা বা ভ্যাট-এর প্রাথমিক, উচ্চ বা বাড়তি হারে কোনো বৃদ্ধি করা হবে না। এসবই সামাজিক কল্যাণ বা সোস্যাল ওয়েলফেরার সম্পর্কীত তথা জনকল্যাণ বিষয়ক। তার বক্তব্য ভোটারদের মধ্যে আশা জাগিয়ে তাদের ভোটকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে।

কিয়ার স্টারমার দাবি করেছেন, মানুষের কষ্ট লাঘব করতে দেশের জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবায় বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হবে, কাজের সময়ের বাইরে যাতে স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করেন তার জন্য দেওয়া হবে উৎসাহ ভাতা। সুনকের অভিবাসন নীতিও বর্জন করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। বলা যায়, কনজ়ারভেটিভ পার্টির নীতির অনেক কিছুই লেবার পার্টির নতুন নেতা সংস্কার করবেন। এ বারের নির্বাচনী প্রচারে কিয়ার স্টারমারের দল একাধিক বিষয় তুলে ধরেছে। তাদের ইস্তাহারে শিক্ষক নিয়োগ, নারী-শিশুদের প্রতি যত্নবান হওয়া, স্থিতিশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা-সহ একাধিক বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে, যা সাধারণ ভোটারদের তাদের পক্ষে প্রণোদিত করেছে।

তবে, চোদ্দো বছর পর ক্ষমতায় এসে লেবার পার্টির সামনে এখন বিরাট চ্যালেঞ্জ— যে সব প্রতিশ্রুতি তারা দিচ্ছেন, তা পালন করা বর্তমান পরিস্থিতিতে সহজসাধ্য হবে কিনা? বিশ্ব পরিস্থিতি ও ইউরোপীয় বাস্তবতায় অনেক সমস্যাই তাদের মোকাবেলা করতে হবে। তাদেরকে নতুন পথ তৈরি করে চলতে হবে। যে পথ বাস্তবিকই কঠিন। ঋষির শাসনকালে একাধিক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় ব্রিটেন। সে সব কাটলেও জনমত অন্য কথা বলছিল। জনমত সমীক্ষার পূর্বাভাসকে সত্যি প্রমাণ করে বড় জয় পেল লেবার পার্টি। প্রধানমন্ত্রী হলেন কিয়ার স্টারমার। লেবার পার্টির বিপুল জয়ের পর সমর্থকদের উদ্দেশে তার বার্তা, ‘‘পরিবর্তনের কাজ শুরু হবে আজ থেকেই।’’

এ বারের ব্রিটেনের ভোটে মূলত লড়াই ছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক এবং লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার মধ্যে। সেখানেই ঋষির দলকে হারিয়ে শেষ হাসি হাসলেন কিয়ার। ব্রিটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন তিনিই। ৬১ বছর বয়সি রাজনীতিবিদ কিয়ার স্টারমার প্রধানমন্ত্রী হলেও তাকে প্রথম থেকেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বলে মনে করছেন অনেকেই। বর্তমানে দেশ যে যে সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে তাকে।

১৯৬২ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন কিয়ার স্টারমার। বেড়ে উঠেছেন সারের অক্সটেডে। পড়াশোনা শেষে আইনজীবী হিসাবে পেশাগত জীবন শুরু করেন। তার পরই রাজনীতিতে প্রবেশ। তার বাবা ছিলেন পেশায় কাঠমিস্ত্রি। আর মা ন্যাশনাল হেল্‌থ সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নার্স হিসাবে কাজ করতেন। ছোট থেকেই পড়াশোনার প্রতি খুবই মনযোগী ছিলেন স্টার্মার। তবে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় ছাত্রজীবনেই। প্রথমে লিডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক হন। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন কিয়ার স্টারমার।

পরিবারে তিনিই প্রথম যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। ১৬ বছর বয়সেই রাজনীতিতে যুক্ত হন। লেবার পার্টি ইয়ং সোশ্যালিস্টে যোগ দেন তিনি। কলেজের পড়াশোনা শেষ করে আইনজীবী হয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯৮৭ সালে একজন ব্যারিস্টার হিসাবে কাজ শুরু করেন তিনি। মানবাধিকার ব্যারিস্টার হিসাবে কর্মজীবনে সাফল্যও লাভ করেন তিনি। ২০০২ সালে কুইন্স কাউন্সেল হিসাবে নিযুক্ত হন। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের জন্য উত্তর আয়ারল্যান্ড পুলিশিং বোর্ডের আইনি উপদেষ্টা ছিলেন স্টার্মার। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাবলিক প্রসিকিউশনের ডিরেক্টরও ছিলেন তিনি। সেই সময়কালে স্টিফেন লরেন্স হত্যার মতো মামলা সামলেছেন তিনি। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৪ সালে রানি এলিজ়াবেথের থেকে ‘নাইট’ উপাধি পান তিনি।

তবে নামের আগে ‘স্যার’ উপাধি খুবই কম ব্যবহার করতে দেখা যায় তাকে। তার পরের বছরই সাংসদ হন তিনি। লন্ডনের হলবর্ন অ্যান্ড সেন্ট প্যানক্রাস আসন থেকে লেবার পার্টির সাংসদ হয়ে আবার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন তিনি। তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হওয়ার মাস কয়েক পরেই মাকে হারান। জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তার। তথাপি তিনি লেবার পার্টিতে নিজের অবস্থান মজবুত করেন। ২০২০ সালে লেবার নেতৃত্বের ভোটে বিপুল জয় পান তিনি। তার পরই দলের রাশ চলে আসে তার হাতে। তার বক্তৃতায় বার বার উঠে এসেছে বৈশ্বিক নিরাপত্তা, জলবায়ু সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ভিত্তিতে বিশ্বের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা।

দুই সন্তানের পিতা স্টারমার। ২০০৭ সালে তার প্রেমিকা ভিক্টোরিয়াকে বিয়ে করেন তিনি। ভিক্টোরিয়াও স্টার্মারের মায়ের মতো পেশায় নার্স। যুক্ত রয়েছেন ন্যাশনাল হেল্‌থ সার্ভিসের সঙ্গে। পোড় খাওয়া রাজনীতিকের মতো তিনি তরুণ ঋষি সুনককে উড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। তার নেতৃত্বে ব্রিটেন স্বদেশে কতোটা স্থিতিশীল আর বিশ্বে শাক্তিশালী হতে পারে, সেটাই দেখার বিষয়।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

মেধাবীদের ‘ব্রেইন-ড্রেইন’ ও বৈষম্য ঠেকাতে উত্তপ্ত শিক্ষাঙ্গন!



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

চাকরিতে বিদ্যমান কোটাপ্রথা নিরসন নিয়ে সারাদেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ক্রমান্বয়ে ফুঁসে উঠেছে। পাশাপাশি পেনশনে ‘প্রত্যয় স্কিম’ সংযোজন নিয়ে দেশের ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের অনির্দিষ্ট ধর্মঘটের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় নতুন যুক্ত হওয়া প্রত্যয় স্কিমের রূপরেখায় নানা বৈষম্যমূলক বিষয় আঁচ করে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা এ কর্মসূচির বিরোধিতা করে আসছেন।
নতুন ঘোষণায় নানা বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে বলে এটা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

এদিকে, অর্থমন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষকদের দাবি অযৌক্তিক! এটা ছড়িয়ে পড়ার পর তাঁর পদত্যাগ দাবি করে এই আন্দোলন আরো বেশি গতিবেগ পেয়েছে।

শিক্ষকেরা অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আপনি আপনার অফিসে যারা বসেন তাদের পেনশনকে স্কিমের আওতায় আনেন দেখবেন, তারাও আন্দোলনে নেমে যাবে।’

বিভিন্ন প্রতিবাদ সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা উল্লেখ করেছেন, ‘শিক্ষকদের জন্য যে প্রত্যয় স্কিম আরোপ করা হয়েছে, তা তাদের পারিবারিক সুরক্ষা নষ্ট করছে। এ প্রত্যয় স্কিমের ফলে মেধাবীরা আর শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হবেন না।’

সব থেকে বড় বিষয় ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদকাল ৬৫ থেকে কমিয়ে ৬০ বছর করা হয়েছে। মাসিক চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা, বৈশাখী ভাতা নতুন প্রত্যয় স্কিমে প্রদান করা হবে না। ...তারা ‘প্রত্যয় স্কিম’ থেকে শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন ও প্রতিশ্রুত সুপার গ্রেডে অন্তর্ভুক্তির দাবি আদায় না-হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন’।

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) একজন সাবেক সদস্য বলেছেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। তাই, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত সম্মানটুকু দিতে হবে। আমাদের কাজ আন্দোলন করা নয়, আন্দোলনকে প্রশ্রয়ও দিই না। আমরা টাকার জন্য লড়ি না। আমরা দাঁড়িয়েছি, আমাদের সম্মানের জন্য! টাকার জন্য দাঁড়াতে হলে আমরা বিদেশেই ভালো ভালো রিসার্চে থেকে যেতে পারতাম। কোটি কোটি টাকা উপার্জন করতে পারতাম। কিন্তু আমরা দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসি’! ‘আমাদের বড় বড় গাড়ি, বাড়ির দরকার নেই। আমরা খুবই সাধারণ জীবনযাপন করি। আমাদের ছাত্ররা আসে বড় বড় গাড়িতে অথচ লোকাল বাসে উঠি আমরা। বর্তমানে আমাদের দেশে ভালো ভালো ছাত্রদের ধরে রাখা যাচ্ছে না। শিক্ষকতাও করতে চাচ্ছেন না অনেক মেধাবী ছাত্র। অনেকেই পরবর্তী জীবনে পেনশনের দিকে তাকিয়ে শিক্ষকতা করতে আসেন। এটিও যদি চলে যায়, তবে ভালো মেধাবী ছাত্ররা শিক্ষকতায় আসবেন না’।

এদিকে, ১ জুলাই থেকে সার্বিক অচলাবস্থায় চরম ভোগান্তির শিক্ষার শিক্ষার্থীরা সেশনজটের আশঙ্কা করছেন।

তবে কোনো কোনো শিক্ষক নেতা বলেছেন, করোনাকালের মতো তারা পরবর্তীতে বিশেষ ব্যবস্থায় ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সেশনজট পুষিয়ে দেবেন।

যোগাযোগমন্ত্রী শিক্ষকদের সঙ্গে ৪ জুলাই বৈঠক করার কথা বললেও অজানা কারণে তা স্থগিত করা হয়েছে।

এদিকে, আন্দোলনের ছয়দিনেও সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ের কাউকে এই চলমান ধর্মঘট নিরসনে কোনো ধরনের উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।

দেশের শিক্ষাঙ্গনসহ বিভিন্ন রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের তুমুল আন্দোলনের মাধ্যমে। দেশের ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়ে ৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরাও এই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েছেন।

৭ জুলাই থেকে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। প্রয়োজনে হরতালের ডাক দেওয়া হতে পারে এবং অভিভাবকদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে- বলেছেন আন্দোলনকারীরা।

শিক্ষার্থী ও শিক্ষক একই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ইস্যু নিয়ে সারাদেশে শিক্ষাঙ্গন অচল করে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন অথচ কর্তৃপক্ষ সেটা আমলে না নিয়ে কালক্ষেপণ করছেন, এমন ঘটনাও বিরল।

‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা চার দফা দাবি উল্লেখ করেছেন।

দাবিগুলো হলো- ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখা; ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুতসময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে (সব গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দেওয়া এবং সংবিধান অনুযায়ী কেবল অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা; সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া এবং দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।’

অন্যান্য কোটায় বিভিন্ন ভাতা ও সুবিধাদি নিয়ে তেমন কোনো অসন্তোষের কথা না জানালেও শুধু সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি নিয়ে অনেক বিতর্ক দানা বেঁধেছে।

বিশ্বের বহু গণতান্ত্রিক ও উন্নত দেশে সরকারি-বেসরকারি চাকরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, প্লট-ফ্ল্যাট প্রাপ্তি, বিদেশি নাগরিক, পরিবহনের টিকিট ইত্যাদিতে কোটা পদ্ধতি সংরক্ষিত থাকে।

সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমতা সৃষ্টি ও বৈষম্য দূরীকরণের জন্য কোটা রাখা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে চাকরিতে নানা কোটার আড়ালে প্রায় ৬৩ ভাগ চাকরি বণ্টন করা হচ্ছে, যা মেধাবী ও বঞ্চিতদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক ও অমানবিক।

প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে এদের টিকে থাকতে হলে এবং এদেশকে সত্যিকারভাবে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশের কাতারে এগিয়ে নিতে হলে প্রকৃত মেধাবীদেরকে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়ে আসতে হবে এটাই বাস্তবতা!

সুতরাং সরকারের উচিত আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া ও চলমান সংকটের সমাধান দ্রুত নিশ্চিত করা।

এছাড়া বর্তমানে আমাদের দেশে ভালো ভালো ছাত্রদের ধরে রাখা যাচ্ছে না। দেশে তাদের জন্য উত্তম কর্মক্ষেত্র ও উপযুক্ত বেতন নেই। এজন্য বুয়েটসহ সব নামি-দামি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিদেশে গিয়ে আর দেশে ফেরত আসতে চান না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বিদেশে ডিগ্রি অর্জন করতে গিয়ে দেশে ফেরত আসতে চান না। কারণ, দেশে গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। দেশে তাদের বেতন এত কম যে, একটি মানসম্পন্ন জীবন-যাপন করা খুব কষ্টকর। তার ওপর ছাত্র ও দলীয় রাজনীতির অনৈতিক চাপ শিক্ষাঙ্গনের সার্বিক শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশকে কলুষিত করে রেখেছে। এজন্য মেধাবী ব্রেইনগুলো বিদেশের ড্রেইনে (মেধা পাচার) গড়িয়ে যায়।

এভাবে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে, নিজের মেধাবী সন্তানদের উন্নত সেবা থেকে। অথচ বাংলাদেশে হাজার হাজার বিদেশি এসে উচ্চপদে চাকরি করে বিরাট অংকের অর্থ নিয়ে চলে যাচ্ছে। তারা ঠিকমতো রাষ্ট্রীয় করও দিচ্ছেন না বলে জানা গেছে।

আমাদের নীতি-নির্ধারকদের বিশেষ করে জানা থাকা দরকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্পর্শকাতর জায়গা যেগুলো সব সময় আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে দেশকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে থাকে। সেখানে এমন বৈষম্যমূলক প্রকল্প নিয়ে শিক্ষকদেরকে অসন্তষ্ট করার দরকার কী ছিল! বেশ কয়েকবছর ধরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো শান্ত থাকায় কোনো সেশনজট চোখে পড়েনি। সেখানে এমন বৈষম্যমূলক প্রকল্প চাপিয়ে দিয়ে ক্যাম্পাস অশান্ত করার ঘটনা জাতির বিবেককে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে।

কোন কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কাজ ফেলে রেখে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে যেতে শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের পথে নামতে বাধ্য করা হলো! এই আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে আরো সময়ক্ষেপণ বা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হলে শিক্ষাঙ্গনে যে জট ও নতুন ক্ষতির দাগ তৈরি হবে, তার দায়ভার কে বহন করতে আসবে!

সে কারণে আর দেরি না করে এই বৈষম্যমূলক প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করা উচিত সরকারের। ভবিষ্যতের মেধাবীদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করে ধরে রাখা, বাংলাদেশে বিদেশীদের অবৈধ চাকরি করা কমানো এবং ক্রমাগত আমাদের ‘ব্রেইন-ড্রেইন’ঠেকাতে ‘প্রত্যয় প্রকল্প’ প্রত্যাহার করে সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হোক এবং এভাবে দেশের শিক্ষা ও গবেষণাকে আমরা সবাই মিলে বাঁচাতে সচেষ্ট থাকি!

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। E-mail: [email protected]

;

বন্যার্তদের জন্য ভাবার সময় কোথায় তাদের?



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে দেশের বেশকিছু জেলা বন্যা কবলিত । শনিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বন্যায় আক্রান্ত ১৫টি জেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষ। কবলিত মানুষেরা নিদারুণ এক অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করছেন। প্রয়োজনীয় খাবার কিংবা বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকটে রয়েছেন তারা।

সরকারের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের মাঝে নগদ অর্থ ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রের স্বীয় কর্তব্যের অংশ হিসেবেই এ সহায়তা প্রদান হয়ত সামনের দিনগুলিতেও করে যেতে হবে সরকারকে।

কিন্তু দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রাকৃতিক দূর্যোগের সঙ্গে নিত্যদিন লড়াই করলেও রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠনসমূহের এ নিয়ে কোন কর্মসূচি বা হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে না। জনগণের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ানোই রাজনৈতিক দলগুলির ঘোষিত প্রধান কর্তব্য হলেও এ দূর্যোগে তারা দিব্যি সুখনিদ্রায় আছেন বলেই মনে হচ্ছে।

সরকারি কি বিরোধী, ডান কিংবা বাম-কাউকেই এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন সহায়তামূলক কর্মসূচি গ্রহণের খবর আমরা দেখিনি। আমরা লক্ষ্য করে আসছি, নির্বাচনকে সামনে রেখে অসংখ্য রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের আবির্ভাব ঘটে। এই তো সেদিনের ঘটনা! স্মরণ করতে কারোরই কষ্ট হওয়ার কথা নয়, গেল বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে মনোনয়ন ফরম কেনা-বেচায় দলের অফিসের বাইরে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছিল। মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্ধে কুরুক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল বড়-ছোট রাজনৈতিক দলগুলির অফিস প্রাঙ্গন।

এসব হঠাৎ রাজনীতিক বনে যাওয়া ব্যক্তিরা নিজেদেরকে জনসেবক, জননেতা ইত্যাদি বহু বিশেষণে মাঠ-ঘাট কাঁপিয়ে তুলেছিলেন। যদিও নির্বাচন পেরিয়ে যেতে না যেতেই তারা এক রকম হাওয়া হয়ে গেছেন। শুধু যে অচেনাদেরই এই দলে দেখা যায়-তাও নয়। বরং বহু তথাকথিত ব্যক্তিসর্বস্ব দলের ‘জাতীয়’ নেতাদেরও দেখা যাবে এই হাওয়া হয়ে যাওয়াদের মিছিলে।

আসা যাক, বড় রাজনৈতিক দল বা সহযোগী অঙ্গ বা সংগঠনের বিষয়ে। আমরা যদি সমসাময়িক কালের ঘটনা মূল্যায়ন করি তবে এটি স্পষ্ট যে, দূর্যোগকবলিত মানুষদের পাশে রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তার হাত প্রশস্ত করার প্রবণতা খুবই সামান্য। তথাকথিত ত্রাণ বিতরণের যে যৎকিঞ্চিৎ প্রবণতা দেখা যায় তাকে সহায়তার চেয়ে ফটোসেশন বলাই শ্রেয়!

স্যোশাল মিডিয়ার পর্দায় ঘুরতে থাকা করোনাকালে এক বৃদ্ধাকে মাস্ক দেওয়ার সেই ছবির কথা কারোর ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ২০-২৫ জন রাজনৈতিক কর্মী এক অশীতিপর মলিন বস্ত্রের বৃদ্ধাকে সামান্য ২ টাকার মাস্ক তুলে দিতে ফটোসেশন করে তা ফেসবুকে ছেড়েছিলেন! এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করা হলেও বাস্তবে দূর্গত মানুষদের সহায়তায় তথাকথিত রাজনৈতিক কর্মসূচি যে এর চেয়ে শ্রেয়তর কিছু নয়, তা বলাই বাহুল্য।

চলমান বন্যার মাঝেই আরও দুঃসংবাদ এসেছে। গণমাধ্যমের খবরে যা জানা যাচ্ছে, এবছরের আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে আরেকটি বন্যা হওয়ার আশঙ্কা করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। খবরে যা জানা যাচ্ছে, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, রংপুর, জামালপুর, ফেনী, রাঙামাটি, বগুড়া, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, সিরাজগঞ্জ ও কক্সবাজার জেলা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, এ বন্যায় এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ২০ লাখ মানুষ।

প্রতিদিনই অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে নতুন বন্যার্তদের নাম। এই যখন পরিস্থিতি, তখন জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ মানুষগুলোর থাকার কথা দূর্গতদের সবচেয়ে কাছে। কিছু দিতে না পারলেও অন্তত ভরসা দিয়ে তাদের পাশে থাকার চেষ্টাও দূর্গতদের সাহস যুগাতো। 

প্রকৃতঅর্থে দূর্যোগের এই সময়গুলো হওয়া উচিত ছিল-রাজনীতির মানুষদের নিজেদেরকে সত্যিকারের জনসেবক হিসেবে প্রমাণ দেওয়ার। কিন্তু ক্ষমতার চেয়ার দখল বা অধিকার করার দৌঁড়ে তারা যতটা মরিয়া, তার সিকি শতাংশও যদি দূর্গত বা পীড়িত মানুষের সেবায় দেখা যেত তবে রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীদের মানুষ দেবতা জ্ঞান করত হয়ত!

অন্যদিকে, দেশের বিপুল সংখ্যক বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ডের দিকে যদি নজর দিই হবে দেখব-দূর্গত মানুষদের জন্য তাদের গৃহীত কর্মসূচি বলতে যা আছে তা ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে কিন্তু গোয়ালে নেই’ দৃষ্টান্তের মতোই। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, ক্লাব-সমিতি পূর্বে যেমন অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে স্বতঃস্ফূর্ত ছিল, বর্তমানে সেই প্রবণতাও কেন যেন হারাতে বসেছে।

ঔপনিবেশিক যুগে বাংলায় যুবজাগরণের মহান উদগাতা স্বামী বিবেকানন্দ যুবকদের আপন কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘নেতা হতে যেও না, সেবা করে যাও।’ আমরা মনীষীদের বাণীর প্রভাব সেই যুগের বা পরবর্তী যুগের রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে প্রবলভাবে দেখেছি। মহামারী কিংবা দূর্যোগে পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোই হয়ে উঠেছিল তাদের রাজনীতি বা ধর্মচর্চার অনুষঙ্গ। 

কোটাবিরোধী আন্দোলন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দেশজুড়ে নতুন প্রবর্তিত পেনশন স্কিম প্রত্যাহারের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনে রাজধানী ঢাকা উত্তাল। এমপি আনার হত্যা, প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান গুটিকয়েক কর্তাব্যক্তির দুর্নীতির খবর নিয়ে চলছে হইচই, মুখরোচক আলোচনা-সবার দৃষ্টি এখন সেদিকেই নিবদ্ধ। কিন্তু দেশের প্রত্যন্ত জনপদে বন্যাকবলিত ২০ লাখ মানুষের নিত্যদিনের মরণপণ সংগ্রামের কতটাই বা আমরা ধারণ করছি? সরকার বা সংস্থাসমূহ যে প্রচেষ্টা জারি রেখেছিল, অন্য সবার হাত যদি তাতে পড়ত; তবে দূর্গতদের এই দুর্দশা আর থাকতো না। তবে বাস্তবতা সম্পূর্ণ উল্টো।  তাই শিল্পী হায়দার হোসেনের গানের কথায় আমাদেরও প্রশ্ন, ‘কি দেখার কথা কি দেখছি?/কি শোনার কথা কি শুনছি?/কি ভাবার কথা কি ভাবছি? কি বলার কথা কি বলছি?’

;

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে পরিবর্তন: একটি পর্যবেক্ষণ



মো: বজলুর রশিদ
মো: বজলুর রশিদ, ছবি: বার্তা২৪.কম

মো: বজলুর রশিদ, ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ একটি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে অবস্থিত। গত কয়েক দশকে, গ্রামীণ অঞ্চলে বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ঘটেছে যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই পরিবর্তনগুলো একদিকে যেমন গ্রামীণ জীবনের মানোন্নয়ন করেছে, অন্যদিকে নতুন চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি করেছে।

প্রথমত, অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করা জরুরি। কৃষি বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। উন্নত প্রযুক্তি এবং কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, ফসল উৎপাদন বেড়েছে এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ধান, গম, আলু, এবং অন্যান্য খাদ্যশস্যের উৎপাদনেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এছাড়া, কৃষি খাতে বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতা ও প্রণোদনা কৃষকদের অবস্থার উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শিক্ষার হার বেড়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি বিনিয়োগ এবং বিভিন্ন এনজিওর প্রচেষ্টা শিক্ষার মানোন্নয়নে সহায়ক হয়েছে। এছাড়া, নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা নারীদের ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে শিক্ষার মান ও শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা এখনও রয়ে গেছে।

তৃতীয়ত, স্বাস্থ্য খাতেও পরিবর্তন দেখা গেছে। গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। টিকা কার্যক্রম এবং মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিশু মৃত্যুহার এবং মাতৃমৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া, পুষ্টি বিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রামীণ জনগণের স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। তবে, স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

চতুর্থত, যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। গ্রামীণ এলাকায় সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে, যা গ্রামের মানুষদের শহরের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সহায়ক হয়েছে। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের প্রসার ঘটেছে, যা তথ্যপ্রবাহ সহজতর করেছে এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। ই-কমার্স এবং অনলাইন ব্যাংকিং সেবাও গ্রামীণ অর্থনীতিকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি, যা মূলত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে লক্ষ্য করে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় নারীর ক্ষমতায়ন, স্বনির্ভরতা, এবং উদ্যোক্তা তৈরি করতে ক্ষুদ্রঋণ অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।

ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হয়েছে। অনেক দরিদ্র পরিবার ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করেছে এবং তাদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসা, যেমন গবাদি পশু পালন, কৃষি, ক্ষুদ্র হস্তশিল্প, এবং পোলট্রি খামার ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে বিকাশ লাভ করেছে। এই ঋণ সুবিধা পেয়ে গ্রামীণ জনগণ আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে।

ক্ষুদ্রঋণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল নারীর ক্ষমতায়ন। গ্রামীণ নারীরা প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঋণ সুবিধা পেত না এবং আর্থিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ছিল। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে নারীরা ঋণ নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করেছে এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে। এর ফলে, নারীরা পরিবারের আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করছে এবং সামাজিকভাবে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে।

ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ছোট ও মাঝারি ব্যবসা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা বেকারত্ব হ্রাসে সহায়ক হয়েছে। এছাড়া, ক্ষুদ্রঋণ সুবিধার মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।

তবে, ক্ষুদ্রঋণের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। উচ্চ সুদের হার অনেক সময় ঋণগ্রহীতাদের জন্য চাপ সৃষ্টি করে এবং ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। এছাড়া, কিছু ক্ষেত্রে ঋণের টাকা সঠিকভাবে ব্যবহার না হওয়ায় ঋণগ্রহীতারা আর্থিক সংকটে পড়ে। এজন্য, ঋণ প্রদানের পাশাপাশি ঋণগ্রহীতাদের প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করেছে, নারীর ক্ষমতায়ন করেছে, এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। যদিও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে রেমিট্যান্স অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক পরিবর্তনের এক প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে।

প্রথমত, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে রেমিট্যান্সের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। অনেক গ্রামীণ পরিবারই প্রবাসে কর্মরত সদস্যদের পাঠানো অর্থের উপর নির্ভরশীল। এই অর্থের মাধ্যমে তারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে, সন্তানের শিক্ষা নিশ্চিত করে, এবং স্বাস্থ্যসেবা পায়। প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে গ্রামের মানুষজন তাদের বাসস্থান উন্নত করতে পেরেছে, কৃষিতে বিনিয়োগ করতে পেরেছে, এবং ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করতে পেরেছে। ফলে, গ্রামের অর্থনৈতিক কাঠামো দৃঢ় হয়েছে এবং দারিদ্র্যের হার কমেছে।

দ্বিতীয়ত, রেমিট্যান্সের মাধ্যমে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নত হয়েছে। প্রবাসী আয় থেকে গ্রামের মানুষজন রাস্তা, ব্রিজ, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণে অবদান রেখেছে। এছাড়া, রেমিট্যান্সের মাধ্যমে গ্রামের স্কুল, মসজিদ, এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্র উন্নত করা সম্ভব হয়েছে। ফলে, গ্রামীণ জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে এবং সামাজিক সেবাগুলোর প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

তৃতীয়ত, রেমিট্যান্সের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনও ঘটেছে। প্রবাসী আয়ের ফলে গ্রামের মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। অনেক পরিবারই প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছে। এছাড়া, রেমিট্যান্সের ফলে নারীর ক্ষমতায়নও বেড়েছে। অনেক প্রবাসী পুরুষ তাদের স্ত্রীদের জন্য ব্যাংক একাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করেছে এবং তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে, নারীরা আরও স্বাধীন এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠছে।

তবে, রেমিট্যান্সের কারণে কিছু নেতিবাচক প্রভাবও দেখা গেছে। প্রথমত, অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসী আয়ের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা গ্রামীণ অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা হ্রাস করে। প্রবাসী আয়ে কোনো সমস্যা হলে গ্রামীণ পরিবারগুলো আর্থিক সমস্যায় পড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, প্রবাসে কর্মরত সদস্যদের দীর্ঘ অনুপস্থিতি পরিবারে মানসিক চাপ এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। পরিবারের সদস্যরা অনেক সময় প্রিয়জনদের অনুপস্থিতিতে একাকিত্ব এবং হতাশায় ভোগে।

এছাড়া, রেমিট্যান্সের সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং ব্যবহার একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক সময় প্রবাসী আয় সঠিকভাবে বিনিয়োগ না হওয়ায় এর সম্ভাব্য সুফল পাওয়া যায় না। গ্রামীণ জনগণের অর্থনৈতিক শিক্ষা এবং বিনিয়োগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

রেমিট্যান্সের ইতিবাচক প্রভাব আরও বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, প্রবাসী আয়ের সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং বিনিয়োগের জন্য গ্রামীণ জনগণকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা উচিত। দ্বিতীয়ত, রেমিট্যান্সের মাধ্যমে গ্রামীণ অবকাঠামো এবং সামাজিক সেবাগুলোর উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, প্রবাসী কর্মীদের সুরক্ষা এবং তাদের পরিবারের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

সামগ্রিকভাবে, রেমিট্যান্স গ্রামীণ পরিবর্তনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এটি গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, সামাজিক পরিবর্তন, এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে। তবে, রেমিট্যান্সের নেতিবাচক প্রভাবগুলো মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি, যাতে এই আয়ের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে গ্রামীণ উন্নয়নকে আরও গতিশীল করা যায়।

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হলো গার্মেন্টস শিল্প। যদিও মূলত শহরাঞ্চলে গার্মেন্টস শিল্পের অধিকাংশ কারখানা অবস্থিত, তবু এ শিল্প গ্রামীণ সমাজে বিভিন্ন ধরনের প্রভাব ফেলেছে। গ্রামীণ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনে গার্মেন্টস শিল্পের ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে গেলে আমরা দেখতে পাই, এই শিল্প কীভাবে জীবিকা, উন্নয়ন, এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সহায়ক হয়েছে।

প্রথমত, গ্রামীণ অর্থনীতিতে গার্মেন্টস শিল্পের একটি বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। এই শিল্প গ্রামীণ মানুষদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে কাজ করার জন্য প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়, এবং গ্রামীণ এলাকার অনেক নারী ও পুরুষ শহরে এসে এই শিল্পে কর্মসংস্থান পেয়েছে। এদের মধ্যে বিশেষ করে নারীদের জন্য গার্মেন্টস শিল্প একটি বড় ধরনের কর্মসংস্থানের সুযোগ এনে দিয়েছে। ফলে, গ্রামীণ মানুষের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা এসেছে।

দ্বিতীয়ত, গার্মেন্টস শিল্প নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে নারীরা সাধারণত গৃহস্থালির কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে, গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করার সুযোগ পেয়ে তারা নিজেদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে পেরেছে। ফলে, নারীরা পরিবারে এবং সমাজে আরও বেশি সম্মান ও মর্যাদা পাচ্ছে। তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারা পরিবারের খরচে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।

তৃতীয়ত, গার্মেন্টস শিল্পের মাধ্যমে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ঘটেছে। গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করে উপার্জিত অর্থ অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য ব্যয় করতে পারে। ফলে, গ্রামীণ শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নেও গার্মেন্টস শ্রমিকদের আয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে পরিবারগুলো উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারে।

তবে, গার্মেন্টস শিল্পের প্রভাব শুধু ইতিবাচক নয়, এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। প্রথমত, গ্রামীণ শ্রমিকরা প্রায়ই শহরে কাজ করতে এসে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। নিম্নমানের কর্মপরিবেশ, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, এবং কম বেতন তাদের জীবনে কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। অনেক সময় তারা শহরের উচ্চ ব্যয়বহুল জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না, ফলে আর্থিক সংকটে পড়ে। দ্বিতীয়ত, পরিবার থেকে দীর্ঘদিন দূরে থাকার কারণে মানসিক চাপ এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

এছাড়া, গ্রামীণ এলাকায় গার্মেন্টস শিল্পের প্রসারের ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত দুর্বলতা একটি বড় সমস্যা। অনেক গ্রামীণ এলাকায় পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ, পানি, এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব রয়েছে, যা শিল্পের উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে। এছাড়া, স্থানীয় জনগণের প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতার অভাবও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

গার্মেন্টস শিল্পের ইতিবাচক প্রভাব আরও বাড়ানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, গ্রামীণ এলাকায় গার্মেন্টস কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা উচিত। দ্বিতীয়ত, শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও বেতন কাঠামো উন্নয়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, স্থানীয় জনগণের প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা উচিত। এছাড়া, গ্রামীণ এলাকায় অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

সামগ্রিকভাবে, গার্মেন্টস শিল্প গ্রামীণ পরিবর্তনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, এবং সামাজিক পরিবর্তনে সহায়ক হয়েছে। তবে, এই শিল্পের নেতিবাচক দিকগুলো মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি, যাতে গার্মেন্টস শিল্পের সুফল আরও ব্যাপকভাবে গ্রামীণ উন্নয়নে প্রয়োগ করা যায়।

তবে, এই পরিবর্তনগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জও রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ গ্রামীণ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, এবং নদীভাঙন কৃষি ও বসতবাড়ির ক্ষতি করে এবং মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে ফেলে। এছাড়া, ভূমির দখল এবং জমির ব্যবহার নিয়ে বিরোধ গ্রামীণ এলাকায় সামাজিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করছে।

সামাজিক পরিবর্তনের দিক থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। গ্রামীণ সমাজে নারীর ভূমিকা ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীরা এখন শুধু ঘরের কাজেই সীমাবদ্ধ নয়, তারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছে এবং পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। নারীদের স্বনির্ভরতা এবং ক্ষমতায়ন গ্রামীণ সমাজের সামাজিক কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে।

অন্যদিকে, গ্রামীণ এলাকায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যাগুলো এখনও রয়ে গেছে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী এখনও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল স্রোতে সম্পূর্ণভাবে যুক্ত হতে পারেনি। এই জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষভাবে নীতিমালা ও কর্মসূচি প্রণয়ন জরুরি।

গ্রামীণ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি। কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস এবং জৈব কৃষির প্রসার ঘটেছে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও পদ্ধতির ব্যবহার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, যা পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়ক হচ্ছে।

সামগ্রিকভাবে, গ্রামীণ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো একটি প্রগতিশীল ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, এবং সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। তবে, বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য যথাযথ নীতিমালা ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এভাবে, গ্রামীণ বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

মো: বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

;