সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণসহ আটটি জাতীয় দিবস বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকারের এমন অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত বিস্ময়ের সঙ্গে বাড়িয়েছে উদ্বেগও। কারণ এমন এক সময় সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যখন দেশ নিত্যপণ্যের আকাশচুম্বী দাম, দুর্নীতিতে সর্বশান্ত ভঙ্গুর অর্থনীতি, ঋণের দায়ে জর্জরিত এক অশান্ত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যেই সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ার ধীর গতির কারণে সমালোচিত হয়েছে। এরই মধ্যে এই আট জাতীয় দিবস বাতিলের সিদ্ধান্ত সরকারকে আরও বিতর্কিত করে তুলেছে।
সরকারের এ সিদ্ধান্তটি যে সম্পূর্ণ যুক্তিহীন তা বলা যায় না। আসলে ইতিহাসের বহুগামীতা আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তা অস্বীকার করে গত ১৫ বছরের শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধকে একচেটিয়াভাবে বর্ণনা করেছে। এতে অনেকের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এটা ঠিক যে ঐতিহাসিক বিষয়গুলোর কিছু কিছু সংশোধন ও কিছু পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা সরকারের প্রতি মানুষের মনে নানান রকমের ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তাই ক্ষমতাচ্যুত সরকারের রাজনৈতিক বৈধতার বিরুদ্ধে একটি সমন্বিত বহিঃপ্রকাশ ঘটবে এটা তো প্রত্যাশিত।
অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্তের পক্ষে তথ্য উপদেষ্টা এই দিনগুলোকে আওয়ামী সরকারের 'ফ্যাসিবাদী আচরণ' বলে উল্লেখ করেছেন। দিবসগুলোর বেশিরভাগই একটি পরিবারকেন্দ্রিক। আট দিবসের মধ্যে পাঁচটিই শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীর সঙ্গে সম্পর্কিত।
তবে জাতীয় দিবস হিসেবে পালনের তালিকা থেকে ৭ মার্চ ও ৪ নভেম্বরকে ছেঁটে ফেলায় আহত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছেন অনেকে। আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের পথযাত্রার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য দিনগুলোর মধ্যে ৭ মার্চ অন্যতম। আমরা কি এমন ঘটনাগুলোকে খারিজ করতে পারি যেগুলো আমাদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ? এই প্রশ্ন তো থেকেই যায়।
৭ মার্চের ভাষণ, একক কোন রাজনৈতিক দলের না। এমনকি শেখ মুজিবেরও নয়। এটা সমগ্র জাতির।
তবে তথ্য উপদেষ্টা ৭ মার্চ গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা জাতীয় দিবসের গুরুত্ব পায় না বলে মন্তব্য করেছেন। তার এ মন্তব্য আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদানকে ম্লান করে দেয়।
নতুন প্রজন্মের জন্য বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পুনঃপাঠন অবশ্যই প্রয়োজন। তবে এই দায়িত্ব সরকারের আমলাদের হাতে না দিয়ে শিক্ষক, ইতিহাসবিদ এবং সর্বোপরি বৃহত্তর শিক্ষিত সমাজের ওপর ছেড়ে দেওয়া ভাল। এছাড়া বর্তমান স্পর্শকাতর সময়ে উপরোক্ত জাতীয় দিবস দুটি বাতিল করায় হঠকারী না হয়ে দ্বান্দ্বিক মতামতগুলোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই হওয়া উচিত আমাদের পথ। আমরা সরকারকে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানাই।
লেখক: দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক (ডেইলি স্টার থেকে ভাবানুবাদ)