‘গণমাধ্যম সংস্কার মানেই সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া’

, যুক্তিতর্ক

| 2024-11-28 14:38:22

মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী পাঁচ দশক ধরে সাংবাদিকতা করছেন। ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মানুষের বাকস্বাধীনতা, মুক্ত গণমাধ্যম ও স্বাধীন সাংবাদিকতা নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন আলোচনায় আসছে। অন্তর্বর্তী সরকার গণমাধ্যমের সংস্কারের বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। গণমাধ্যম সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু সেই ভাবনা ও মতামত নিয়ে বিস্তারিত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন খবরের কাগজ-কে। বার্তা২৪.কম এর পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হলো: 

গণমাধ্যম সংস্কারের ব্যাপারে আপনার ভাবনা কী? সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু বলে আপনি মনে করেন?

মতিউর রহমান চৌধুরী : গণমাধ্যম সংস্কার কীভাবে করা সম্ভব, তা জাতির কাছে পরিষ্কার না। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন সংস্কার কাজ শুরু করেছে। কিন্তু গণমাধ্যম সংস্কার কীভাবে করা সম্ভব, তা জাতির কাছে স্পষ্ট নয়। গণমাধ্যমের কী সংস্কার করবে? কারা সম্পাদক হবে? সবকিছুই যেন ধোঁয়াশা মনে হচ্ছে। গণমাধ্যম সংস্কারের দায়িত্বটা আমাকে নিতে বলা হয়েছিল, কিন্তু আমি সেই দায়িত্ব নিতে রাজি হইনি। গণমাধ্যমের কোন জায়গায় সংস্কার করতে হবে? গণমাধ্যমকে কেন সংস্কার করতে হবে? সেটা আমার মাথায় আসছে না। আমার মনে হচ্ছে, গণমাধ্যম সংস্কার করা মানেই সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া। আমরা গণমাধ্যমের অবাধ ও নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতা চাই। কারও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে গণমাধ্যম থাকতে চায় না। গণমাধ্যম সংস্কার কেন করা প্রয়োজন? এ বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট না করলে আমরা কেন সেই বিষয়ে মতামত দেব? বর্তমান সরকার মনে করছে, যেসব গণমাধ্যম বিগত সরকারের সময় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, সে অবস্থা থেকে যেন বের হয়ে আসে। কোনো অবস্থাতেই যেন দলীয় ভূমিকা পালন না করে। এভাবে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। রাজনৈতিক বিশ্বাসের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। আমি মনে করি, অনেক সাংবাদিক ভুলভ্রান্তি করেছেন। অনেক সিনিয়র সাংবাদিক রাজনৈতিকভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। এটা ঠিক হয়নি। একজন মানুষের নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বাস থাকতেই পারে। কিন্তু সাংবাদিকতা আর রাজনীতি এক বিষয় নয়। আমি সবসময় স্বাধীন গণমাধ্যম চাই। গণমাধ্যম কোনো অবস্থাতেই যেন স্বাধীনতার নামে হঠকারিতা না করে।

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হচ্ছে, অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল হচ্ছে। এসব ব্যাপারে আপনার অবস্থান জানতে চাই।

মতিউর রহমান চৌধুরী : এ ব্যাপারে আমি তথ্য উপদেষ্টার সামনেই বলেছি, এরকম ঢালাওভাবে সাংবাদিকদের অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল করবেন না। এভাবে বাতিল করাটা ঠিক হবে না। সাংবাদিকরা কোনো অপরাধে জড়িত কি না, আগে সেটা প্রমাণিত হোক, তারপর অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল করুন। কোনো সাংবাদিক যদি অপরাধী বা ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। যেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চান, মুক্ত সাংবাদিকতা চান, তাহলে কেন সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। আমি নিজেও দুবার ভুক্তভোগী হয়েছি। ১৯৭৯ সালের শেষ দিকে আমি যখন সংবাদের রিপোর্টার ছিলাম, তখন ‘মন্ত্রীরা কোরআন শরিফ নিয়ে শপথ নিয়েছেন তারা ঘুষ খাবেন না এবং কোনো তথ্য পাচার করবেন না’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট করেছিলাম। ওই রিপোর্ট ছাপানোর পর আমার অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল করা হয়েছিল। যদিও দুই সপ্তাহের মধ্যে পুনরায় বহাল হয়েছিল।

এরশাদের সময় কলাম লিখেছিলাম সাপ্তাহিক খবরের কাগজে। শিরোনাম ছিল ‘দুর্নীতিপরায়ণদের উল্লাসের নৃত্য’। সেটি নিয়ে অনেক ঘটনা ঘটেছিল। আমার গাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া এবং আমার নামে হুলিয়া জারি করা হয়েছিল। এরপর আমার অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল করা হয়। তবে এবার সাংবাদিকদের ওপর যেটা করা হয়েছে সেটা দুর্ভাগ্যজনক। সাংবাদিকদের অ্যাক্রেডিটেশন বাতিলের সিদ্ধান্তটি অগণতান্ত্রিক হয়েছে।

সাংবাদিকরা বর্তমানে কতটা স্বাধীন বা নিরপেক্ষভাবে সাংবাদিকতা করতে পারছে; এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই।

মতিউর রহমান চৌধুরী : সংবাদপত্র এখনো স্বাধীন আছে, তবে সেলফ সেন্সরশিপ বহাল আছে এখনো। সাংবাদিকরা অনেক কিছুই জানে, দেখে কিন্তু লিখতে পারে না। এটাই হলো সেলফ সেন্সরশিপ। এখন অবশ্য কেউ আমাদের টেলিফোন করে বলে না যে, এই খবর বা রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশ করবেন না।

সরকারের সমর্থক বা সহযোগী হিসেবে মিডিয়াকে দোষারোপ করা হচ্ছে। সম্পাদক হিসেবে আপনি এ বিষয়কে কীভাবে দেখছেন?

মতিউর রহমান চৌধুরী : কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তার রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে সরকারকে সমর্থন করতে পারে। সবাই জানে ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকা লেবার পার্টির সমর্থক। যেদিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন শেষ হয়, তারপরের দিন থেকে গার্ডিয়ান ট্রাম্প সরকারের সমালোচনা করে আসছে। এটা হচ্ছে গার্ডিয়ানের পলিসি। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো- সরকারের আনুগত্য পাওয়ার জন্য এত বেশি তোষামোদী করে, যা জনগণের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সাংবাদিকরাও অনেক ভুল করেছে। আমাদের রাষ্ট্রকে সমালোচনাও করতে হবে। এখন সাংবাদিকরা যদি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশংসা করে, পরবর্তী সরকার এসে যদি বলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কথা বলেছেন বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাহলে সেটাও করা ঠিক হবে না।

সাংবাদিকদের ওপর মানুষের প্রত্যাশা অনেক কি বেশি?

মতিউর রহমান চৌধুরী : গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। জনগণ সবসময় সত্য কথা জানতে চায়। জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে আমাদের কথা ও কাজের তেমন মিল পাওয়া যায় না। আগের সরকারের সময় সাংবাদিকদের আচরণে অনেক অমিল ছিল। মানুষ পরিবর্তন চায়, আমরা যদি সে আগের মতোই থেকে যাই, তাহলে মানুষের আশা ভঙ্গ হবে।

বলা হয়ে থাকে, শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিবাদ বানানোর ক্ষেত্রে সাংবাদিকদেরও ভূমিকা রয়েছে। আপনি কী মনে করেন?

মতিউর রহমান চৌধুরী : শুধু সাংবাদিক না, অনেকেই চোখের সামনে সরকারের কর্মকাণ্ড দেখেছে, খুব কম মানুষই প্রতিবাদ করেছে। যারা সরকারের কর্মকাণ্ডে প্রতিবাদ করেছে, তাদেরও দেশ ছাড়তে হয়েছে, আমাকেও দেশ ছাড়তে হয়েছে। ২০১৬ সালে আমাকে আট মাস দেশে আসতে দেওয়া হয়নি। এ বছর শেখ হাসিনা সরকার পতনের তিন দিন আগে আমাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। সাংবাদিকরা সম্মিলিতভাবে সরকারের প্রতিবাদ করলে হয়তো এমন ঘটনা ঘটত না। শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিবাদ বানানোর ক্ষেত্রে সাংবাদিকদেরও ভূমিকাও কম না। সাংবাদিকরা এতটাই সরকারের তোষামোদী করেছে যে, প্রেস কনফারেন্সের সময় দুই ঘণ্টার বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে।

শেখ হাসিনা সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি, পেশাজীবী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খবর বের হচ্ছে। কিন্তু সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন কোনো গণমাধ্যম কারও বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেনি। কেন?

মতিউর রহমান চৌধুরী : দুর্নীতির বিরুদ্ধে একেবারেই করেনি এমন না। দুর্নীতির অনেক খবর সাংবাদিকরা জানত, হয়তো সুবিধা নেওয়ার জন্য অনেকে তেমন কথা বলেনি। সরকারের অনেক কিছুই মেনে নিয়েই সাংবাদিকতা করা হচ্ছে বলে আজ দেশের এই অবস্থা। এভাবে সঠিক বা স্বচ্ছ সাংবাদিকতা সম্ভব না।

আমরা দেখছি, সাংবাদিক সমাজ দ্বিধাবিভক্ত, এর নেপথ্যে কারণ কী?

মতিউর রহমান চৌধুরী : সাংবাদিকদের অনেক অনুরোধ করেছি একত্রিত থাকার জন্য। তাহলে দেশের এই অবস্থা হতো না। স্বৈরাচারী শাসকদের বড় একটা কৌশল হলো- তারা ক্ষমতায় এসেই সাংবাদিকদের দ্বিধাবিভক্ত করতে থাকে। সাংবাদিক ইউনিয়নকে ভাগ করাটাও স্বৈরাচারী সরকারের সুবিধার জন্য করা হয়েছিল। যেমন ‘সম্পাদক পরিষদ’ ভেঙে দিয়ে এডিটর গিল্ড তৈরি করা হয়েছিল। সম্পাদকদের দ্বিধাবিভক্ত করার জন্য চেষ্টা করেছে কিন্তু সফল হতে পারেনি। স্বৈরাচারী সরকারের কাছে সাংবাদিকরাও অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছে। ফলে দেশে এত বড় একটা পরিবর্তন ঘটে গেল।

সাংবাদিক সমাজের ঐক্যের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন?

মতিউর রহমান চৌধুরী : যদিও সাংবাদিকদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত দেখতে পাচ্ছি, তারপরও তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। সাংবাদিকদের অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল করা হচ্ছে এটা কখনো ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। সাংবাদিকদের মধ্যে অবশ্যই ঐক্য থাকতে হবে।

একজন সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে সাংবাদিক সমাজের ঐক্যের কোনো উদ্যোগ নেবেন কি?

মতিউর রহমান চৌধুরী : সাংবাদিকদের ঐক্যের জন্য কেউ যদি উদ্যোগ নেন, তাহলে আমি অবশ্যই সহযোগিতা করব। এখন অনেক সাংবাদিক পলাতক, কেউ কেউ আত্মগোপনে আছে। আমি জন্মের পর থেকে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত। আমি কখনো এত সাংবাদিক দেশের বাইরে থাকতে দেখিনি। সাংবাদিকদের এমন দুরবস্থা আগে কখনো দেখিনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ যদি এগিয়ে আসে, তাহলে আমি অবশ্যই সাধুবাদ জানাব এবং সহযোগিতা করব।

সাংবাদিকতায় নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। কেন এই অবক্ষয়?

মতিউর রহমান চৌধুরী : সাংবাদিকরা নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে ফেলেছে। তাদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা থাকলে দেশের এই অবস্থা হতো না। প্রথিতযশা সাংবাদিক যেমন- মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, আহমেদ হুমায়ুন সবার মধ্যেই রাজনীতি ছিল। কিন্তু তারা কখনো কাগজে-কলমে রাজনীতি প্রমাণ করেননি। ফলে জনগণ বুঝতে পারেনি আসলে তারা কোন দলের সমর্থক। এমনকি তারা লেখার মধ্যেও কোনো দিন প্রকাশ করেননি। বিগত সরকারের আমলে দেখা গেছে তারা আগে আওয়ামী লীগ পরে সাংবাদিক। আমাদের আগে সাংবাদিক হতে হবে, তারপর রাজনীতির বিষয়টা আসবে। বাংলাদেশের নির্বাচনের সময় প্রধান বিচারপতিও ভোট দিতে যান, তিনি কি তার কর্মকাণ্ডে প্রমাণ করেন যে তিনি কোন দলের লোক। এখানেই নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন

সার্বিকভাবে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা নিয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই

মতিউর রহমান চৌধুরী : আমি এখন সাংবাদিকতার অবস্থান ভালো দেখছি। জনগণের মধ্যে এখন কিছুটা বোধগম্যতা এসেছে। দেশ একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিকরা অনেক ভুলভ্রান্তি করেছে। তবে এখনো ভালো সাংবাদিকতার সময় আছে। পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো সাংবাদিকদের চেহারা পালটে দিতে পারে। তবে সাংবাদিকদের সৎ সাহস থাকতে হবে। সমাজ যখন বদলে যায় তখন সমাজের সবাই একই কাতারে চলে যায়। এজন্য নতুন প্রজন্মকে সৎ, সাহসী ও মুক্ত সাংবাদিকতা করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

খবরের কাগজ’র সৌজন্যে 

এ সম্পর্কিত আরও খবর