চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-27 05:08:02

রোববার দুপুরে যখন কাকরাইলের ভুইয়া ট্রেড সেন্টারে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সদ্য বহিষ্কৃত ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের ব্যক্তিগত কার্যালয়ের তালায় কুড়ালের কোপ পড়ে, তখন আমি একটি সাম্রাজ্যের পতনের শব্দ শুনি। আমার কানে বাজতে থাকে, 'চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়, আজিকে যে রাজাধিরাজ, কাল সে ভিক্ষা চায়...।'

তিন সপ্তাহ আগেও এই ভুইয়া ট্রেড সেন্টার ছিল প্রবল প্রতাপশালী ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের সাম্রাজ্য। তিনি যখন চলতেন, তখন সঙ্গে থাকতো গাড়ি আর মোটর সাইকেলের বিশাল বহর। সম্রাটের নিরাপত্তায় সেই বহরে থাকতো সশস্ত্র ক্যাডাররা। স্টাইলটা অনেকটা রাজকীয়, অনেকটা গডফাদারিয়।

গত দুই বছর ধরে ভুইয়া ট্রেড সেন্টারই তার আখড়া। আটতলা এই ভবনেই ছিল তার অফিস, থাকার ব্যবস্থা, মিনি ক্যাসিনো, বার, অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা, রাজনৈতিক কর্মীদের খাওয়ার ব্যবস্থা, সভার ব্যবস্থা। সারাক্ষণই গমগম করতো অফিস এবং তার প্রাঙ্গণ।

সম্রাট যখন আসা-যাওয়া করতেন পুরো এলাকা তটস্থ থাকতো। সেই সম্রাট তার সাম্রাজ্যের সামনে মাইক্রোবাসে অসহায় বসে। কুড়াল দিয়ে কলাপসিবলের তালা ভাঙ্গার পর সম্রাটকে যখন গাড়ি থেকে নামানো হলো, তার গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, মাথায় হেলমেট, হাতে হাতকড়া; চারদিকে র‍্যাব, পুলিশ আর সাংবাদিক, কোনো স্লোগান নেই, কোনো জয়ধ্বনি নেই। এ যেন নিজের দরবারে এক পতিত সম্রাটের আগমন। সত্যিই চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়।

তবে সম্রাটের সাম্রাজ্যে অভিযান দেখতে খুব ভালো, দারুণ নাটকীয়তা আছে; অধিকাংশ টিভি সরাসরি সম্প্রচার করেছে। অভিযানে ক্যাঙ্গারুর চামড়া, বিদেশী মদ, ইয়াবা ইত্যাদি উদ্ধার দেখানো হয়েছে। ক্যাঙ্গারুর চামড়া রাখার দায়ে তাকে তাৎক্ষণিক ছয় মাসের কারাদণ্ডও দেয়া হয়েছে। অফিস ছাড়াও তার দ্বিতীয় স্ত্রীর বাসা ও ভাইয়ের বাসায়ও একই সময়ে অভিযান চালানো হয়েছে।

কিন্তু গ্রেপ্তার পরবর্তী পুরো বিষয়টা আমার কাছে হাস্যকর লেগেছে। শেখ হাসিনা যুবলীগের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ১৪ সেপ্টেম্বর, যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভুইয়াকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হয় ১৮ সেপ্টেম্বর, অভিযান শুরুর পরও সম্রাট দিন সাতেক কর্মীবাহিনীসহ অফিসেই ছিলেন, তারপর তিনি হাওয়া হয়ে যান, কুমিল্লা থেকে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয় অভিযান শুরুর ১৯ দিন পর। সম্রাট নিশ্চয়ই বোকা নন যে এতটা সময় পেয়েও বাসা বা অফিসে র‍্যাবের উদ্ধার করার জন্য জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখবেন।

ক্যাঙ্গারুর চামড়া রাখা নিশ্চয়ই বিশাল অপরাধ। কিন্তু সম্রাটের মত মনস্টারকে কারাগারে পাঠানোর জন্য বেশ ছোট।

চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকেই আলোচনায় সম্রাট। গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ নেতাদের সবাই তাদের গডফাদার হিসেবে সম্রাটের নাম বলেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কোনো মামলায় তার নাম নেই। অপরাধী হলে পুলিশ তাকে ধরবে, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু কাউকে ধরতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে কেন জানি না। সম্রাটকে ধরা তো দূরের কথা মামলার আসামি করতেও অনুমতি লাগে। এতই যদি ভয়, তাহলে ধরতে হলো কেন? সম্রাটকে কেন গ্রেপ্তার করা হয়েছে? এখন পর্যন্ত ক্যাঙ্গারুর চামড়া ছাড়া আর কিছু পাইনি। হা হা হা।

আচ্ছা অত অপরাধ দরকার নেই। সম্রাট বছরের পর বছর কাকরাইলে আট তলা একটি ভবন জোর করে দখল করে রেখেছেন, এটাই তো অনেক আগেই তাকে গ্রেপ্তারের জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু হয়নি। এবং নিশ্চিত করে বলতে পারি, এমনকি সম্রাটকে গ্রেফতারের পরও ভবন মালিকরা মামলা করবেন না। জানের ভয় সবারই আছে। সবার চোখের সামনে কাকরাইলের মত জায়গায় আটতলা ভবন দখল করে রাখাই প্রমাণ করে সম্রাট কতটা বেপরোয়া। আর এটা কিন্তু যুবলীগের কার্যালয় নয়, সম্রাটের ব্যক্তিগত কার্যালয়। সমস্যাটা এখানেই কখনো কখনো কাউকে কাউকে আমরা পদের চেয়ে বড় করে ফেলি। সম্রাট তেমন একজন। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি। আচ্ছা আপনি দক্ষিণ যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের নাম জানেন? মহানগর উত্তরের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের নাম জানেন? আচ্ছা বাদ দেন, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদকের নাম জানেন? হা হা হা।

গত কয়েকদিনের নিউজ দেখলে মনে হয়, যুবলীগে দইটা পদ- চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী আর মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট।

এখন এটা ভাবা দরকার, কিভাবে সম্রাটরা ‘সম্রাট’ হয়ে ওঠে। এখন কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে, যুবলীগ আসলে চালাতেন সম্রাট। তার টাকায় সংগঠন চলতো, নেতারাও চলতেন। আপনার স্বামী কোত্থেকে টাকা এনে সংসার চালান, সেটা আপনাকে জানতে হবে। না জানাটা অপরাধ। তেমনি আপনার সংগঠনের মহানগর পর্যায়ের একজন নেতা কোত্থেকে কোটি কোটি পায়, সেটা আপনাকে জানতেই হবে। না জানাটা অপরাধ। সম্রাটের বিশাল ভক্তবাহিনী, ক্যাডারবাহিনী, কর্মীবাহিনী আছে। তিনি নাকি অনেক দান-খয়রাত করতেন। গরীব মানুষকে সহায়তা করতেন।

অনেকে বলছেন, তিনি তৃণমূল থেকে উঠে আসা নেতা। তিনি কর্মী পালতেন, পুষতেন। সবই ঠিক আছে। কিন্তু সম্রাটের চালচলন তো রাজনৈতিক নেতার মত নয়, গডফাদারের মত। রাজনীতিতে গডফাদারদের কোনো ঠাই থাকা উচিত নয়।

একটা খুব জরুরি কথা বলেছেন সম্রাটের স্ত্রী শারমিন চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের কমিটি করার পর যেন তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য একটা ফান্ড দেয়া হয়। খুব ভালো পরামর্শ।

তাহলে আর রাজনৈতিক সম্রাটদের সৃষ্টি হবে না। সম্রাট গ্রেপ্তার হওয়ারা পর একজন জানতে চাইলেন, তার কী হবে? আমি বললাম, কী হবে জানি না।

আপাতত ক্যাঙ্গারুর চামড়ার রাখার অপরাধে ছয় মাসের কারাদণ্ড থাকলো। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক। তবে তার কতটা মামলা পর্যন্ত বা আদালত পর্যন্ত যাবে, কতটা প্রমাণ করা যাবে তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। হয়তো কয়েকমাস জেল খেটে বেরিয়ে আসবেন। তবে সম্রাট তার সাম্রাজ্য আর ফিরে পাবেন না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত।

একজন সম্রাটকে কারাগারে নিয়েই এই প্রক্রিয়া বন্ধ হবে না। সিস্টেম না বদলালে, সম্রাটের জায়গা নেবে নতুন কোনো সম্রাট। তাই আর যেন কোনো সম্রাট সৃষ্টি না হয়, সেটা নিশ্চিত করাটা জরুরি।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর