উপাচার্যহীন বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষার উন্নয়ন

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান | 2023-08-27 09:46:44

সম্প্রতি গণমাধ্যমে অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিয়োগকৃত 'উপাচার্য', ‘উপ-উপাচার্য’ ও ‘কোষাধ্যক্ষ’ কর্তৃক পরিচালিত না হওয়ার বিষয়টি বেশ প্রাধান্য পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হিসেবে সম্পৃক্ত হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একজন উপাচার্য তার মেয়াদ শেষ করলেও নতুন উপাচার্য নিয়োগ পেতে বেশ কিছু মাস অপেক্ষা করতে হয়। উপাচার্যহীন একটি বিশ্ববিদ্যালয় মাঝিবিহীন একটি নৌকার মত। যার সাথে সম্পৃক্ত থাকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক-প্রশাসনিক সার্বিক পরিবেশসহ হাজার হাজার শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর দৈনন্দিন জীবন। একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে দাঁড়িয়ে বিষয়টি বড়ই বেমানান। উপাচার্য ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয় যা উচ্চশিক্ষার উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায়।

দুই.

আচার্যের অনুমোদনক্রমে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব নির্ধারিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করার কথা থাকলেও মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিয়োগকৃত 'উপাচার্য', 'উপ-উপাচার্য' ও 'কোষাধ্যক্ষ' কর্তৃক পরিচালিত না হওয়ায় অনুষ্ঠানে উপস্থিতির বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী অপারগতা প্রকাশ করে প্রশংসার যোগ্য কাজ করেছেন। এভাবে কি কোন বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে? পত্রিকায় প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বশেষ তথ্য মতে, বর্তমানে একাডেমিক কার্যক্রম চলছে এমন ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮টিতে (২৬.৬৭%) উপাচার্য নেই, ৮২টিতে (৭৮.০৯%) উপ-উপাচার্য নেই এবং ৫৫টিতে (৫২.৩৮%) কোষাধ্যক্ষ নেই। আর উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ কেউ নেই এমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ২০টি (১৯.০৫%)। তিনটি পদ পূর্ণ আছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা মাত্র ১০টি। অথচ, প্রচলিত আইন হলো, যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ পদে জনবল সার্বক্ষণিক থাকা অপরিহার্য।

তিন.

অন্যদিকে, এটি ভালো যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি অনেকদিন ধরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শৃঙ্খলিত নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করছে। তবে, দু:খজনক বিষয় হলো 'বোর্ড অব ট্রাস্টিজ' বা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সঙ্গে সংযুক্ত ব্যক্তিবর্গ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত ও ইতিবাচক কিছু করা যাচ্ছে না। প্রায় প্রতি বছর ইউজিসি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বেসরকারি কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকগণকে সতর্কতা জারি করে থাকে। এতে একদিকে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ইউজিসি’র দৈনতাও প্রকাশ পায় এই অর্থে যে, তারা এক্ষেত্রে ইতিবাচক কোনো কিছু করতে পারছেন না। আদালতে রিট করে হোক আর যেভাবেই হোক ঐ সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকই শিক্ষার্থী ভর্তি করে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। আর প্রয়োজন যেহেতু কোনো আইন মানে না, তাই কিছু শিক্ষার্থী যে কোনো কারণেই হোক ভর্তি হয়ে থাকেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক ও প্রশাসনিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নিয়ম হল, মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ দেওয়া উপাচার্য ব্যতীত শিক্ষার্থীদের সনদপত্রে অন্য কেউ স্বাক্ষর করতে পারেন না। তার স্পষ্ট অর্থ হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের 'বোর্ড অব ট্রাস্টিজ' কর্তৃক নিয়োগ দেওয়া ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের স্বাক্ষর করা সনদপত্র বৈধ নয়। এখন প্রশ্ন হলো, 'উপাচার্য', 'উপ-উপাচার্য' ও 'কোষাধ্যক্ষ' পদে 'ভারপ্রাপ্ত' হিসেবে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বা রিজেন্ট বোর্ডের না থাকলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সেই এখতিয়ার আছে কী? অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সুবিধা হলো, 'উপাচার্য', 'উপ-উপাচার্য' এবং 'কোষাধ্যক্ষ' প্রত্যেকটি পদে নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের 'বোর্ড অব ট্রাস্টিজ' কর্তৃক প্রস্তাবিত তিনজনের নাম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি একজনকে পরবর্তী চার বছরের জন্য নিয়োগ দেন। পছন্দমত কাউকে নিয়োগ প্রদানে সুবিধা বেশি থাকায় এই নিয়মটি পরিপূর্ণভাবে তাদের অনুসরণ করা উচিত। আর তাই এটি ধ্রুব তারার মত সত্য যে, প্রচলিত আইন পরিবর্তন না করলে ইউজিসি ইতিবাচক কিছু করতে পারবে না। শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ মানুষের মৌল মানবিক অধিকারের সাথে সম্পৃক্ত কোনো বিষয় নিয়ে 'যেমন খুশি, তেমন সাজো' ধরণের কোনো ব্যবস্থা যেন গড়ে উঠতে না পারে, রাষ্ট্রকে তার দায় নিতে হবে এবং যথাযথ উপায়ে তা নিয়ন্ত্রণও করতে হবে। কেননা একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ উপযোগী দেশপ্রেমিক দক্ষ জনবল তৈরি করা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়ভারের পাশাপাশি রাষ্ট্রের দায়ভারও কম নয়।

চার.

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) উপাচার্য গত ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ পদত্যাগ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈষ্ঠ্যতম অধ্যাপককে উপাচার্যের চলতি দায়িত্বে নিয়োগ দানে সহযোগিতা করে মন্ত্রণালয় নি:সন্দেহে বাস্তবসম্মত কাজ করেছে। যিনি ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয় 'ভর্তি পরীক্ষা' সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেছেন এবং প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অনেক কিছু তিনি ভালো বোঝেনও বটে। ভাগ্য ভালো যে, বশেমুরবিপ্রবি-কে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মত দীর্ঘদিন (প্রায় ৫ মাস) উপাচার্য শূন্য থাকতে হয়নি। কেননা দেশের উচ্চশিক্ষার কল্যাণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটি দিনও উপাচার্যহীন থাকা কাম্য নয়। ইউজিসি'র তথ্য মতে, দেশের ৪৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১টিতে (০২.২২%) উপাচার্য নেই; উপ-উপাচার্য নেই ২৯টিতে (৬৪.৪৪%), এবং কোষাধ্যক্ষ নেই ২৮টিতে (৬২.২২%)।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবর তুলনামূলক বড় না হলে সেখানে 'উপ-উপাচার্য' না থাকাটা দোষের কিছু নয়; বরং 'উপ-উপাচার্য' থাকলে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক রেষারেষি, দলীয় কোন্দল প্রভৃতি বৃদ্ধি পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। তবে, অত্যন্ত দু:খের এবং অপ্রত্যাশিত বিষয় হলো, 'উপাচার্য' ও 'কোষাধ্যক্ষ'-এই দুই পদ শূন্য থাকা। একটু দেরিতে হলেও 'উপাচার্য' পদে হয়তো কেউ নিয়োগ পান, তবে 'কোষাধ্যক্ষ' পদ দীর্ঘদিন শূন্য থাকাটা অযৌক্তিক যা কোনভাবেই বাস্তবসম্মত নয়।

প্রশাসনিক ও একাডেমিক সকল দায়িত্বের পাশাপাশি কোষাগারের অতিরিক্ত দায়িত্ব থাকলে একজন উপাচার্যের জন্য যেমন তা বাড়তি চাপের সৃষ্টি করে, তেমনি পরোক্ষভাবে হলেও উপাচার্যকে 'একনায়কতান্ত্রিক' মনোভাবাপন্ন করে তুলতে পারে। শত শত কোটি টাকার আয়-ব্যয় ও কোষাগার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত একজন 'কোষাধ্যক্ষ' থাকাটা শুধু যৌক্তিকই নয়, বরং তা অধিক বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

বাংলাদেশের তুলনামূলক পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শত শত অধ্যাপক আছেন যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততার গভীরতার ওপর যদিও নির্ভর করে সব কিছু। তবে, সার্চ কমিটি করে হোক আর অন্য যেভাবেই হোক অতি দ্রুত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শূন্য পদগুলো পূরণ করা জরুরি। পাশাপাশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে যেন 'কোষাধ্যক্ষ' পদটি পূরণ করা হয়, সেই ব্যবস্থা নিশ্চয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিবে। যদিও ইতোমধ্যে ইউজিসি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে শূন্য পদগুলো পূরণ করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করেছে। তবে, একসাথে প্রায় দেড়শত থেকে দুইশত জন 'একাডেমিক এক্সিলেন্স' ও প্রতিথযশা গবেষকমনস্ক অধ্যাপক পাওয়া কঠিন হলেও অসম্ভব কিছু নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো শূন্য থাকলে হতাশার পাশাপাশি একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে যে প্রভাব এবং ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয় তা উচ্চশিক্ষার জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান, পারদর্শিতা ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন; একাডেমিক ও গবেষণার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রয়েছে এমন অনেক সাবেক উপাচার্য, প্রথিতযশা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বর্তমানে দায়িত্বরত উপ-উপাচার্য রয়েছেন, যাদেরকে বেসরকারি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা এবং রাষ্ট্রের উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। একজন উপ-উপাচার্যকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার একইপদে নিয়োগ দেওয়ার অর্থ হলো তিনি তার আগের মেয়াদে সফল হয়েছেন। তাহলে তাকে দ্বিতীয়বার উপাচার্য পদে কেন নয়? এই খুঁটিনাটি বিষয়গুলোও সরকার নতুন করে ভেবে দেখবে বলে বিশ্বাস করতে চাই। মেধা সৃষ্টিতে মেধাকে কাজে লাগানো জরুরি।

 

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান: পি.এইচ.ডি গবেষক, ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর