ঢাকার বায়ু মান বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম। বায়ু মান পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্য মতে গত রোববার বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা ছিল প্রথম। এর আগেও কয়েকবারই ঢাকা দূষণে প্রথম হয়েছে।
ঢাকার বায়ু এতো দূষিত কেন? এ প্রশ্নের জবাবে বলতে হয়, একটি শহর বা এলাকার বায়ু দূষিত হওয়ার জন্য যে উপাদান ও উপকরণ বা উপলক্ষ্য দরকার হয় ঢাকায় তার সবকিছুই আছে। প্রশ্ন হচ্ছে এ কারণগুলোতো অন্যান্য শহরেও আছে, তাহলে ঢাকার বায়ুই কেন এতো দূষিত হবে? অন্যান্য শহরেওতো যানজট আছে, আছে জনসংখ্যার আধিক্য, কলকারখানা-তবে কেন ঢাকা এতো দূষিত? এক কথায় এর জবাব-অব্যস্থাপনা।
সময় ও বাস্তবতার প্রয়োজনে উন্নয়ন, কলকারখানা, যানবাহন সবই লাগবে, তারতম্য হয় এসবের ব্যবস্থাপনায়। শহর বা নগর ব্যবস্থাপনা বলতে যে একটি কথা আছে ঢাকায় তা আজ পর্যন্তও দেখা যায়নি। শুধু ঢাকা কেন দেশের কোনো জেলা বা শহরই পরিকল্পনা অনুযায়ী গড়ে ওঠেনি, বেড়েও উঠছে না। হয়তো এভাবেই একদিন পরিত্যক্ত বা মৃত নগরে পরিণত হবে ৪০০ বছরের পুরোনো এই শহর।
এই শহরে যে যেখানে যা পারছে তাই করছে। হাসপাতালের পাশে ঘরবাড়ি, তার পাশে বিশ্ববিদ্যালয়, তার পাশে সুপারমার্কেট, তার পাশে মাছের আড়ত আরও কতো কি। এভাবেই বেড়ে উঠেছে ঢাকা।
পরিবেশ অধিদফতর ঢাকার দূষণের জন্য বেশি দায়ী করেছে ইটভাটাকে। ঢাকার আশপাশের উপশহরগুলো ইটভাটায় সয়লাব। আর আশপাশের শহর বা জেলাগুলোতেও একই কথা। সাভার, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদীসসহ আশেপাশের জেলাগুলো যেনো ইটভাটার শহর। এভাবে সারা দেশেই ইটভাটা গড়ে উঠেছে যত্রতত্র। আমাদের দেশে উন্নয়ন মানে দালান কোঠা। যত দালান তত উন্নয়ন। দালানের জন্য ইট লাগে। কথায় বলে ইটের ওপর ইট, মাঝে মানুষ কীট। কথাটি হয়তো নগরায়নের আর্থ-সামাজিক দিকটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। কিন্তু এর পরিবেশগত বিষয়টিই আজ সবচেয়ে বেশি সত্য। নগরায়নের পরিবেশগত প্রভাবে মানুষ আজ যেন কীটে পরিণত হয়েছে।
পরিবেশ অধিদফতর বলছে, ঢাকা ও এর আশপাশের পাঁচ জেলায় ৬২ শতাংশের বেশি অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করেছে। কিন্তু এরপরও ঢাকার বায়ু মানের উন্নয়ন হয়নি। মূল বিষয় হলো অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ করলেই কি বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ হবে? বৈধ ইটভাটা থেকে বায়ু দূষণ হয় না একথা কে বলেছে? আর বৈধ না অবৈধ তা নির্ভর করে ইটভাটা তৈরি করার আগে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে অনুমতি নেয়া হলো কি না তার ওপর। এখন ইটভাটার চিমনীর ওপর জেলা প্রশাসনের অনুমোদনপত্র লটকাইয়া দিলে তা থেকে দূষিত বায়ু বের হবে না এ কথা জেলা প্রশাসনও বিশ্বাস করে না।
মূল কথা হলো ইটভাটা স্থাপনের জন্য আদৌ কোনো নীতিমালা আমাদের আছে কি? একটি জেলায় কোথায় কতটি ইটভাটা স্থাপন করা যাবে বা যাবে না, ইটভাটার প্রযুক্তিমান কী হবে সে বিষয়েও নীতিমালা প্রয়োজন। ইটভাটা স্থাপনের জন্য একটি পরিবেশ নীতিমালা আমাদের নেই যার ভিত্তিতে জেলা প্রশাসন তার অধিক্ষেত্রের মধ্যে একটি ভাটা স্থাপনের অনুমতি দিতে পারবে বা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে। বর্তমান আইনে পুরো বিষয়টি জেলা প্রশাসকের এখতিয়ারাধীন। আইনে মৌলিক কিছু নীতিমালা আছে বটে, কিন্তু সেগুলো যথেষ্ট নয়। এছাড়া ইটভাটার দূষণ মান নির্ধারণ ও তদারকির বিষয়টিও এখানে জরুরি। সে প্রযুক্তি ও লোকবলও আমাদের নেই।
কিন্তু ঢাকার দূষণ কি শুধু ইটভাটা বন্ধ করলেই কমবে? যানবাহন, কলকারখানা, দৈনন্দিন বর্জ্য, নির্মাণসংশ্লিষ্ট দূষণসহ আরো নানা মাত্রার ও ধরনের দূষণে ছেয়ে গেছে আমাদের ঢাকা। উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ধুলা ও যানবাহনের ধোঁয়ায় ঢাকার জনজীবন বিপন্ন।
বায়ু দূষণে ঢাকা দিল্লি সমানে সমান। বছর দুই আগে দূষণের কারণে দিল্লিতে জরুরি অবস্থাও জারি করা হয়েছে। আমাদের দেশে এখনও জরুরি অবস্থা জারি করা হয়নি বটে, তবে আমরা ঢাকারবাসীরা সারাবছরই জরুরি অবস্থার মধ্যে থাকি। তাই আলাদা করে আর জরুরি অবস্থা জারির দরকার পড়ে না।
ব্যক্তিগত অবকাঠানো উন্নয়নের পাশাপাশি দেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবমান। দেশজুড়ের চলছে নানা প্রকল্প। ঢাকায় বর্তমানে মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ চলছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সড়ক নির্মাণ ও পুন:নির্মাণের কাজতো চলছেই। যতো প্রকল্প, ততো উন্নয়ন, যত উন্নয়ন তত দূষণ। এই উন্নয়ন ও দূষণের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপনই পরিবেশ বিজ্ঞান ও উন্নয়নের ভাষায় টেকসই উন্নয়ন। আমাদের উন্নয়ন ও পরিবেশ চিন্তার মাঝে কখনোই এই ভারসাম্যটি স্থাপন করা যায়নি। সবচেয়ে বড় সংকট এখানেই।
এসবে মাঝেও ঢাকা এগিয়ে চলছে, চলবে। ঢাকা যেনো এক অভিভাবকহীন মহানগর। খুব শিগগিরই ঢাকা পেতে যাচ্ছে দুই নগরপিতা। আগে ছিল এক, এখন দুই। কথায় বলে, বাবা ঠিক তো ঘর ঠিক। নগরের ক্ষেত্রেও তাই। সীমাবদ্ধতা আমাদের আছে সত্যি। কিন্তু সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা সদিচ্ছার।
সম্পদের সদিচ্ছা চাদা দিয়ও দূর করা যায়। জাতি চাঁদা দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ করেছে। নিজের পয়সা দিয়ে পদ্মা সেতুও নির্মাণ করে ফেলেছে প্রায়। বঙ্গবন্ধু কন্যার সদিচ্ছা ছিল। কিন্তু আমাদের বঙ্গসন্তানদের সদিচ্ছার বড়ই অভাব। বঙ্গসন্তান দুই আসন্ন নগরপিতা একটি পরিচ্ছন্ন ঢাকা গড়তে কতটা সদিচ্ছা পোষণ করেন সেটাই দেখার। এদের মধ্যে একজন আগেও মেয়র ছিলেন। কথার চেয়ে তাকে কাজেই বেশি প্রমাণ দিতে হবে যদি তিনি আবার মেয়র হন।
বাকি যারা প্রার্থী তাদের কথা ও কাজ দুই-ই এক হওয়া চাই। কথা দিয়ে কথা রাখতে হয়। হ্যামিলনের মেয়র কথা দিয়ে কথা রাখেননি। নগরের ইদুর দমন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওয়াদা বরখেলাপের জন্য হারিয়ে যায় হ্যামিলনের সব শিশুরা। পরিত্যক্ত হয় হ্যামিলন। খুব বেশি কিছু দরকার নেই। কয়েকটি কাজ করলেই মেয়রদের পূর্ণ মেয়াদে ঢাকা ফিরে পেতে পারে তার প্রাণ। আমাদের ঢাকা বেড়ে উঠুক যত্ন ও ভালোবাসায়। সদিচ্ছা থাকলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মেয়ররা গড়ে তুলতে পারেন পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, নিরাপদ প্রতিবেশ, প্রাণময় ঢাকা।